তাজমহলের অপ্রামাণ্য কাহিনি বাজারে ছড়ানোর আয়োজন করেছেন অমরীশ গোয়েল ‘দ্য তাজ স্টোরি’-তে। ইতিহাস সেখানে পুরাণের মতো কল্পকথা হয়ে উঠেছে। এমন চলচ্চিত্র প্রদর্শন কি বন্ধ করে দেওয়া উচিত? তাজমহল নির্মাণের আসল ইতিহাসটাই বা কী? লিখছে দেবাশিস পাঠক।
ঘটনাটা এই ‘এসআইআর’, ‘সিএএ’ আবহে তাড়িত প্রতিবেশে সংঘটিত হয়নি। হয়েছিল ৬০ বছর আগে। পুরুষোত্তম নাগেশ ওক ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন। ঘুম ভাঙল। তিনি ঘুম থেকে উঠে দাবি করে বসলেন, আগ্রার তাজমহল আসলে একটি হিন্দু ধর্মস্থান! খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে এটি নির্মিত হয়েছিল। পুরুষোত্তম ইংরেজি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষকতা করেছেন। আদালতে আইনজীবীর কাজও করেছেন। কিন্তু তিনি কস্মিনকালেও ইতিহাসবিদ ছিলেন না। এহেন পুরুষোত্তম নাগেশকে তঁার বন্ধুরা বোঝালেন– তাজমহল তো খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর স্থাপত্যের নিদর্শন নয়। সপ্তদশ শতাব্দীর নিদর্শন। চতুর্থ শতাব্দীর স্থাপত্যকলায় তাজমহলের মতো কুশলতা থাকতে পারে না। পুরুষোত্তম তখন চতুর্থ শতকের নমুনা তাজমহলে খুঁজে খুঁজে বের করতে শুরু করলেন। কল্পনাবিলাসকে বাস্তবোচিত করে তোলার অভিপ্রায়ে। আর তারই সুতো ধরে ১৯৮৯-তে তিনি বেশ কিছু নিবন্ধ, এমনকী একটা আস্ত বই লিখে ফেললেন, যেগুলোর প্রতিপাদ্য বিষয় একটাই– তাজমহল অতীতে হিন্দু মন্দির ছিল। এবারও ইতিহাসবিদদের পাশে পেলেন না। এমনকী, শীর্ষ আদালত ২০০০ সালে ‘পাগলের প্রলাপ’ বলে তাজমহল নিয়ে তাঁর দাবি উড়িয়ে দিল।
কিন্তু ২০১৪-তে নরেন্দ্র মোদির দিল্লি দখলের পর থেকে ইতিহাস বোঝার প্রিজমটা উলটে গেল। খেয়ালখুশি মতো তত্ত্ব খাড়া করে ইতিহাসের পাতায় সুবিধামতো গুঁজে দেওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেল। হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয় আর ফেসবুক পাঠশালা থেকে ভূরি ভূরি অধ্যবসায়ী ইতিহাস বের হতে লাগল। চলচ্চিত্রে, পরিবর্তিত হয়ে, প্রতিষ্ঠিত হতে লাগল মনগড়া কাল্পনিক ইতিহাস।
এরকম একটা প্রতিবেশে আমরা পেলাম ‘দ্য তাজ স্টোরি’। তুষার অমরীশ গোয়েলের ছবি। অন্যতম অভিনেতা পরেশ রাওয়াল, বিজেপির প্রাক্তন সাংসদ। ‘দ্য তাজ স্টোরি’ আর কিছুই নয়, ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ কিংবা মিঠুন চক্রবর্তী ও অনুপম খের অভিনীত ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’-এর মতো সুনির্দিষ্ট দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নির্মিত রাজনৈতিক প্রচারধর্মী ছবি।
এই ‘দ্য তাজ স্টোরি’-তে ইতিহাস নয়, গল্পের গরু গাছে উঠে গেল। ঐতিহাসিক নথি, নিদর্শন, পোক্ত জ্ঞান ছাড়া অনেক ব্যক্তিই এই মতামত ছড়াতে শুরু করল যে, তাজমহল অতীতে হিন্দু মন্দির ছিল। ইতিহাস, কিংবদন্তি, কল্পনা– সব ঘণ্ট পাকিয়ে গেল। তথ্যের ডানা খসিয়ে কাল্পনিক সত্যের উড়ান শুরু হল। সংগীত সোমের মতো কেউ কেউ এটিকে পর্যায়ক্রমে শিব মন্দির এবং পিতৃস্মৃতিতে নির্মিত সৌধ হিসাবে চিহ্নিত করতে শুরু করলেন। নাগেশ পুরুষোত্তম ও অমরীশ গোয়েলের সৌজন্যে শাহজাহান তো বটেই, ঔরঙ্গজেবও খাবি খেতে শুরু করলেন নিজ-নিজ সমাধিতে। কারণ, সংগীত সোম এমন কথাও বললেন যে, তাজমহল নাকি শাহজাহানের স্মৃতিতে ঔরঙ্গজেব কর্তৃক নির্মিত সমাধিসৌধ।
‘লিখিত’ ইতিহাস কিন্তু কোনও দিনই এসবে সায় দেয়নি। সেই ‘প্রামাণ্য’ ইতিহাস বলছে, শাহজাহানের প্রিয়তম পত্নী আর্জুমন্দ বানু বেগম তঁার চতুর্দশতম সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে প্রয়াত হন। তঁারই সমাধিসৌধ হিসাবে নির্মিত হয়েছিল তাজমহল। এটির মুখ্য স্থপতি ছিলেন উস্তাদ আহমেদ লাহোরি। শাহজাহানের ঠাকুরদা আকবরের সেনাপতি মান সিংহর নাতি, অম্বর-রাজ জয় সিংহর জমি ছিল ওটা। জয় সিংহ উত্তরাধিকার সূত্রে ওই জমি পান। তঁার কাছ থেকে ওটি প্রিয়তম পত্নীর সমাধি সৌধ নির্মাণের জন্য নেন শাহজাহান। বিনামূল্যে নেননি।
বিনিময়ে মুমতাজ মহল বিশ্রাম নিতেন যে বিশাল বিশাল হাভেলিতে, তার মধ্যে থেকে চারটি জয় সিংহকে প্রদান করেন শাহজাহান। এসবই লিখিত ইতিহাসের নথি। এ সংক্রান্ত বাদশাহি ফরমান, রাজকীয় সম্মতিপত্র, শাহজাহানের বক্তব্য ও জয় সিংহর রাজি হওয়া– সবকিছু লিখিত দলিলের আকারেই আছে। অথচ ‘দ্য তাজ স্টোরি’-তে দেখানো হল, ওই তাজমহলের জন্য জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে স্থানীয় লোকজন কেমন করে বাদশাহর উপর খেপে গিয়েছিল। তাজমহলের জমি নিতে গিয়ে শাহজাহান প্রজা বিদ্রোহের মুখে পড়েন, সেসব দৃশ্য।
ইতিহাস বলছে, তাজমহলের নির্মাণ কার্য শুরু হয়েছিল ১৬৩২-এ। ভারত তো বটেই পশ্চিম এশিয়া থেকে শ্রেষ্ঠ কারিগরদের নিয়ে আসা হয়েছিল ওই কাজের জন্য। বাগদাদ থেকে এসেছিলেন মহম্মদ হানিফ। তিনি ছিলেন প্রধান কারিগর। মাসে এক হাজার তন্খা ছিল তঁার মজুরি। তাজমহলের চূড়াটা বানিয়েছিলেন কায়ুম খঁা। লাহোর থেকে আগ্রায় আনা হয়েছিল তঁাকে। আর চূড়ায় কোরানের যেসব আয়াত খোদাই করা আছে, সে-কাজ করেছিলেন আমানত খান সিরাজি। সমাধিস্থলের মেঝেতে মোজাইকের কাজ করেছিলেন স্থানীয় রাজমিস্ত্রিরা, যঁারা মূলত হিন্দু ছিলেন।
২২ বছর ধরে ২০ হাজার কর্মীর শ্রমের ফসল এই তাজমহল। এর সাদা মার্বেল পাথরগুলো এসেছিল জয়পুর থেকে। আর, নীলা এসেছিল শ্রীলঙ্কা থেকে। স্ফটিক আনা হয়েছিল চিন থেকে। আরব থেকে আমদানি করা হয় প্রবাল। তাজমহল নির্মাণে দু’টি গম্বুজ নির্মাণকৌশল ব্যবহার করা হয়। মুঘল যুগে হুমায়ুনের স্মৃতিসৌধে এই প্রকৌশল ব্যবহৃত হয়েছিল। তার আগে এমন স্থাপত্যকৌশল এ-দেশে আসেনি। আসলে, তুরস্ক থেকে আগত এই স্থাপত্যকৌশল তুর্কি আগমনের পূর্বে ভারতে দেখা যায়নি।
তাজমহলের স্থাপত্যশৈলী যে আদতে তঁাদেরই অবদান, এমন কথা অনেকেই বলেছেন। একাধিক পাশ্চাত্য পণ্ডিত আবার দাবি করেছেন, ভেনিসের পর্যটক জেরোনিমো ভেরোনিও, যিনি পেশায় একজন জহুরি ছিলেন, তিনি ছিলেন তাজমহলের প্রধান স্থপতি। এরপর ‘তারিখ-ই-তাজমহল’-এ মুঘল বেগ দাবি করেন তাজমহলের নকশা প্রস্তুত করেন মুহম্মদ এফেন্দি। অনেকেরই অভিমত, পুরুষোত্তম যতটা ইতিহাসবিদ, ওই এফেন্দিও ততটাই স্থপতি! আবার
১৯ শতকের মধ্যভাগে একদল ব্যক্তি দাবি করে বসলেন– ফরাসি জহুরি অস্তিন দে বোর্দো-র প্রতিভার ফলশ্রুতি তাজমহল। যঁারা এই দাবি করলেন, তঁারা খেয়ালই করলেন না তাজমহল নির্মাণ যে-বছর শুরু হয়, সে বছরই ওই অস্তিন সাহেব পরলোকগমন করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, পুরুষোত্তম যেমন তঁার ভাবাবেশে মনে করেন খিস্টান ধর্ম আসলে যিশু নয় কৃষ্ণ প্রবর্তিত নীতি, কৃষ্ণ-নীতি আদতে খ্রিস্ট নীতি, তদনুরূপ তাজমহলের অকথিত কাহিনি বাজারে ছড়ানোর আয়োজন অমরীশ গোয়েলের ‘দ্য তাজ স্টোরি’-তে। ইতিহাস সেখানে পুরাণের মতো কল্পকথা হয়ে উঠেছে। এ ধরনের চলচ্চিত্রর প্রদর্শন বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কিন্তু করবেটা কে!
‘দ্য তাজ স্টোরি’ মুক্তি পেয়েছে ৩১ অক্টোবর। মুক্তির দিন দর্শক আসনের ১৫ শতাংশও ভরেনি। অথচ, যাঁরা দেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অর্ধেক সংখ্যক দর্শকের ছবিটা ভালো লেগেছে। এখানেই তো আশঙ্কার সিঁদুরে মেঘ ঘনাচ্ছে।
(মতামত নিজস্ব)
