shono
Advertisement
Assam

হিমন্তের চাঁদমারি ফলপ্রসূ হবে?

হিটলারের জার্মানিতে রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘নিষিদ্ধ’ হয়েছিল।
Published By: Subhodeep MullickPosted: 10:21 PM Nov 04, 2025Updated: 10:21 PM Nov 04, 2025

যে-কায়দায় বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিতে 'বাংলাভাষী' মানেই বাংলাদেশ থেকে আসা 'অনুপ্রবেশকারী' বলে মনে করা হচ্ছে, সেখানে 'আমার সোনার বাংলা' গাওয়াকে 'রাষ্ট্রদ্রোহ' বলে চিহ্নিত করার কায়দায় আসলে অসমিয়া ভাবাবেগকেই সুড়সুড়ি দিতে চেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সংঘাত তাঁর অসমিয়া ভোটব্যাঙ্ককে পুষ্ট করতে পারবে তো? লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী

Advertisement

বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর আক্রমণের মধ্যে দিয়ে গত কয়েক মাস ধরে বিজেপি গোটা দেশে যে বাঙালি-বিদ্বেষী রাজনীতি ছড়িয়ে দিয়েছে, সেটারই এক চরম রূপ প্রকাশ পেল অসমে রবীন্দ্রনাথকে আঘাত করার ঘটনায়। প্রকাশ্য সভায় রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের দু’-লাইন গাওয়ার জন্য ৮৫ বছর বয়সের এক কংগ্রেস নেতার রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলার মুখে পড়ে যাওয়া সত্যিই অকল্পনীয়। হুমকি এসেছে খোদ সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার মুখ থেকে। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হল, বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর এই হুমকির পর দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠলেও মুখে কুলুপ গেরুয়া নেতাদের।

দেশে দেশে স্বৈরাচারী শাসক ও কট্টর জাতীয়তাবাদীরা রবীন্দ্রনাথকে বরাবর আক্রমণ করে গিয়েছেন। এটা নতুন কিছু নয়। হিটলারকে দিয়ে সেই ধারার সূচনা হয়েছে। সেই কবে হিটলারের জার্মানিতে রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘নিষিদ্ধ’ হয়েছিল। ছয়ের দশকে রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ হয়েছিল আয়ুব খানের পাকিস্তানে। এমনকী প্রবল রবীন্দ্রানুরাগী ও শান্তিনিকেতনের প্রাক্তনী ইন্দিরা গান্ধীর জমানায় ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণার পর দেখতে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন‌্য’-র মতো পঙ্‌ক্তিতে সেন্সরশিপের খাঁড়া নেমে আসছে, ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী’ গানে চিনের যোগ আছে কি না, তা নিয়ে তথ্যমন্ত্রকের আধিকারিক সন্দেহ প্রকাশ করছেন, ইত‌্যাদি। আসলে এটাই স্বৈরতন্ত্রের রূপ। রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদ ও উদার জাতীয়তাবাদকে কোনও স্বৈরাচারী আমলই মেনে নিতে পারেনি। অসমের মুখ্যমন্ত্রীর আচরণের মধ্যে দিয়ে সার্বিকভাবে সেখানকার বিজেপি সরকারের চরিত্রটাই প্রকাশ পেয়েছে। এখন বাংলাদেশের কট্টর মৌলবাদী শাসকদের একাংশের গলাতেও একই সুরে রবীন্দ্র বিদ্বেষ শোনা যাচ্ছে। ‘আমার সোনার বাংলা’-কে জাতীয় সংগীতের স্থান থেকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি তোলা হচ্ছে সেখানে।

এটা পরিষ্কার বুঝতে হবে যে, অসমের মুখ্যমন্ত্রী যা করেছেন, তা মোটেও বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। এটি অত্যন্ত সুচিন্তিত পদক্ষেপ। এর সঙ্গে যেমন বিজেপির অসমের ভাষাভিত্তিক মেরুকরণের রাজনীতির সম্পর্ক রয়েছে, তেমনই সারা দেশে যেভাবে তারা বাংলাভাষীদের একাংশের গায়ে ‘বাংলাদেশি’ তকমা লাগিয়ে ধর্মীয় বিভাজন করতে চায়, তারও যোগ রয়েছে। তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে রয়েছে কট্টর হিন্দুত্ববাদী আরএসএসের চিরকালীন রবীন্দ্রবিরোধী ভাবধারা। এককথায় বলা যায় ‘আমার সোনার বাংলা’-র গায়ে রাষ্ট্রবিরোধিতার লেবেল সঁাটিয়ে অধুনা বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতির অন্যতম ‘পোস্টার বয়’ হিমন্ত এক ঢিলে অনেক পাখি মারতে চেয়েছেন।

‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি প্রথম প্রকাশ্যে গাওয়া হয় ১৯০৫ সালে কলকাতার টাউন হলে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের মঞ্চ থেকে। তবে রবীন্দ্রনাথ গানটি কবে লিখেছিলেন, সেই তারিখ নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। এই গানটি নিয়ে বিশিষ্ট রবীন্দ্র জীবনীকার প্রশান্ত পাল তাঁর ‘রবিজীবনী’ (পঞ্চম খণ্ড) গ্রন্থে লিখেছেন, “গানটির পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি, রচনার তারিখও জানা নেই। সত্যেন রায় লিখেছেন: ‘বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ৭ আগস্ট (১৯০৫) কলিকাতার টাউন হলে যে সভা হয়েছিল, সেই উপলক্ষে... রবীন্দ্রনাথের নূতন সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ বাউল সুরে গীত হয়েছিল।... ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ সেপ্টেম্বর তারিখের সঞ্জীবনী পত্রিকায় এই গানটি রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরে প্রথম প্রকাশিত হয়।’... এই তথ্য সঠিক হলে গানটি এর আগে শান্তিনিকেতনে রচিত হয়েছিল।... শিলাইদহের ডাক-পিওন গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে’ গানটির সুরে রবীন্দ্রনাথ ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি রচনা করেন।” সেই সময় রবীন্দ্রনাথের লেখা আরও কয়েকটি স্বদেশি গানের সঙ্গে ‘আমার সোনার বাংলা’ কীভাবে লোকের মুখে মুখে ঘুরেছিল, তা তখনকার সংবাদপত্রের প্রতিবেদন তুলে ধরে প্রশান্ত পাল তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের দান ওই ভাবাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বদেশী গানগুলি– গান গেয়ে তিনি একটি জনসম্প্রদায়কে একটি জাতিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছিলেন।’ পরবর্তী কালে বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের মতোই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা প্রদানকারী গান হয়ে উঠেছিল ‘আমার সোনার বাংলা’। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে স্বীকৃতি দিতে বঙ্গবন্ধু তাই এই গানের প্রথম দশ লাইনকে নবগঠিত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত করেন।

বস্তুত, ‘আমার সোনার বাংলা’-সহ বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের পর্যায়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের সব গানই গত সোয়াশো বছর ধরে বাঙালি জাতি ও সংস্কৃতির প্রতীক। সচেতনভাবেই সেই প্রতীককে হিমন্ত নিশানা করেছেন ‘এনআরসি’ ও ‘এসআইআর’-এর আবহে। এবং উল্লেখযোগ‌্য যে, সেটা করা হয়েছে অসমের বরাক উপত‌্যকার করিমগঞ্জের এই ঘটনাকে ঘিরে। যে বরাক উপত‌্যকা বাংলা ভাষা আন্দোলনের জন‌্য ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। ভাষা আন্দোলনে এই উপত‌্যকায় ১১ জন শহিদ হয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ আক্রান্ত সেই বরাক উপত‌্যকায়! গায়ক জুবিন গর্গের ‘রহস‌্যমৃত্যুর’ পর বিধানসভা ভোটের আগে রাজনৈতিকভাবে হিমন্ত কিছুটা চাপে রয়েছেন। আসলে, সিএএ বিরোধী অান্দোলন থেকেই জুবিন অসমিয়া জাতিসত্তা অান্দোলনের একটা গুরুত্বপূর্ণ
মুখ হয়ে উঠেছিলেন। যে আন্দোলনের অভিমুখ বরাবরই বাঙালি-বিরোধী। অসমিয়ারা মনে করে সেখানকার বাঙালিরা আদতে বাংলাদেশ থেকে অাসা ‘অনুপ্রবেশকারী’। যে অনুপ্রবেশকারীরা তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিপন্ন তো করছেই, তাদের চাকরি ও কাজের সুযোগকেও কেড়ে নিচ্ছে। এই অসমিয়া ভাবাবেগকে সুড়সুড়ি দিতেই হিমন্ত চঁাদমারি করেছেন বাঙালি সংস্কৃতির প্রতীককে। অসমিয়া ভাবাবেগকে খুশি করতে ধাক্কা দিতে চেয়েছেন বাঙালির অাত্মপরিচয়কে। কংগ্রেসের সভায় ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়ার মতো সামান‌্য ঘটনাকে যুক্তিহীনভাবে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে বৃহত্তর বাংলাদেশের স্লোগানে উসকানি দেওয়ার চক্রান্ত হিসাবে।

যে-কায়দায় বিজেপিশাসিত রাজ‌্যগুলিতে বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের গায়ে ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে জেলে ভরা হচ্ছে, সোনালি বিবিদের মতো বীরভূমের আদত বাসিন্দাদের জোর করে ‘পুশব‌্যাক’ করা হচ্ছে, বিজেপিশাসিত দিল্লিতে সরকারি নথিতে বাংলাকে ‘বাংলাদেশি’ ভাষা বলা হচ্ছে, তার সঙ্গে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়াকে রাষ্ট্রদ্রোহ বলে চিহ্নিত করার কায়দায় তেমন কোনও তফাত নেই। হিমন্ত, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে, সংঘাতে নেমে তাঁর অসমিয়া ভোটব‌্যাঙ্ককে কতটা পুষ্ট করতে পারবেন, তা বিধানসভা ভোটের ফল বলবে। তবে এভাবে ধীরে ধীরে রবীন্দ্রনাথকেও সংঘাতে নামিয়ে আনার কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের যে ছক তাকে প্রতিহত করতে সব বাঙালিকেই পথে নামতে হবে। এটা শুধু বিজেপির কতিপয় নেতার অশিক্ষার বহিঃপ্রকাশ বলে লঘু করার কোনও সুযোগ নেই। বাঙালি সংস্কৃতির উপর এত বড় আঘাত যে সাম্প্রতিকে দেখা যায়নি, সেটা সবাইকে মাথায় রাখতে হবে। ‘আমার সোনার বাংলা’ এখনও বাঙালির অত‌্যন্ত প্রিয় গান। এই গান গাওয়ার অধিকারের উপর আক্রমণকে যদি এখনই প্রবলভাবে প্রত‌্যাঘাত না করা যায়, তাহলে অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে বাংলাতে দাঁড়িয়ে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়াকে গেরুয়া বাহিনী ‘বিচ্ছিন্নবাদী কাজ’ বলে দাগানো শুরু করবে।

বিজেপির আগ্রাসী সাংস্কৃতিক একীকরণের কর্মসূচিকে কোনওভাবে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। ওদের যাবতীয় ভোটব‌্যাঙ্কের সমীকরণ ও রাজনৈতিক কৌশলের আড়ালেই কট্টরবাদী হিন্দু জাতীয়তাবাদের দর্শন লুকিয়ে থাকে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর আক্রমণের মধ্যে দিয়ে গত কয়েক মাস ধরে বিজেপি গোটা দেশে যে বাঙালি-বিদ্বেষী রাজনীতি ছড়িয়ে দিয়েছে, সেটারই এক চরম রূপ প্রকাশ পেল অসমে রবীন্দ্রনাথকে আঘাত করার ঘটনায়।
  • প্রকাশ্য সভায় রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের দু’-লাইন গাওয়ার জন্য ৮৫ বছর বয়সের এক কংগ্রেস নেতার রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলার মুখে পড়ে যাওয়া সত্যিই অকল্পনীয়।
Advertisement