‘এসসিও’ শীর্ষ সম্মেলনে পুতিন, মোদি ও শি জিনপিংকে একত্রে দেখে শুরু হয়েছে নানা জল্পনা। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরোধীরা এর জন্য ট্রাম্পকে দায়ী করেছেন। এ-দেশেও বিরোধীরা চিনের সঙ্গে হাত মেলানোর জন্য মোদির সমালোচনায় মুখর। কিন্তু বিশ্ব কূটনীতি আপাতত এই ত্রয়ীকে নিয়ে মেতে। নতুন অক্ষ তৈরি হল?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক মহলে বলা শুরু হয়েছে, ট্রাম্প গত কয়েক মাসে মোদিকে এতটাই কোণঠাসা করে দিয়েছেন যে, তিনি পুতিন ও শি জিনপিংয়ের মতো দুই একনায়ক রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে হাত মেলাতে বাধ্য হয়েছেন। চিনের তিয়ানজিনে ‘সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন’-এর (‘এসসিও’) শীর্ষ সম্মেলনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সংক্ষিপ্ত অাড্ডার ভিডিওটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ভাইরাল’।
কূটনীতিতে রাষ্ট্রপ্রধানদের শরীরী ভাষা সবসময় গুরুত্বপূর্ণ। স্বাভাবিকভাবে ক্যামেরার সামনে দঁাড়িয়ে এই তিন নেতার দেড় কি দু’-মিনিটের হাসি-ঠাট্টা বিশ্বের নজর কাড়ছে। এমন একটা ফ্রেম যে অপ্রত্যাশিত ছিল তা নয়। কিন্তু ‘এসসিও’-র মঞ্চে এই দৃশ্যটি রচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বহুমেরু বিশ্বের উত্থানের জল্পনাটি প্রবলভাবে সামনে চলে এসেছে। এবং অামেরিকাতেও ট্রাম্প-বিরোধীরা সরব হয়েছেন।
এরকম একটি পরিস্থিতির জন্ম দেওয়ার জন্য তঁারা ট্রাম্পকেই দুষতে শুরু করেছেন। ‘এসসিও’-র শীর্ষ সম্মেলনে মোদি-পুতিন ছাড়াও ২০ জন রাষ্ট্রপ্রধান হাজির ছিলেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফও ছিলেন। এমন একটি ছবি ‘ভাইরাল’ হয়েছে– যেখানে মোদি ও পুতিন পাশে দঁাড়িয়ে থাকা শাহবাজকে কোনও পাত্তা না দিয়ে একান্তে কথা বলছেন। ভারতের পক্ষে ‘এসসিও’-র মঞ্চের এই টুকরো-টুকরো ছবি কতটা অাশাব্যঞ্জক তা অবশ্য বোঝার সময় অাসেনি।
তবে কংগ্রেস-সহ মোদির সমালোচকরা ট্রাম্প-বিরোধীদের মতোই সরব হয়েছেন। কংগ্রেস প্রশ্ন তুলেছে, যে জিনপিং ২০২০-তে দখল করা লাদাখের জমি এখনও ছাড়েননি, ২০ জন ভারতীয় সেনাকে হত্যা করার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেননি, অরুণাচল-অসমকে শুকিয়ে মারার জন্য ব্রহ্মপুত্রের উপর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বঁাধটি দেওয়ার পরিকল্পনা থেকে এক চুল সরেননি এবং সদ্য ‘অপারেশন সিঁদুর’ চলাকালীন পাকিস্তানকে সবরকম সামরিক সাহায্য করলেন– সেই জিনপিংয়ের সঙ্গে এই বিরোধের জায়গাগুলি উত্থাপন না করেই মোদি কীভাবে একান্তে বৈঠক করেন?
জিনপিংয়ের ক্ষেত্রে যদিও মোদিকে তঁার চিরাচরিত অালিঙ্গন রাজনীতি করতে দেখা যায়নি। ‘এসসিও’-র মঞ্চে অভ্যর্থনা জানাতে মোদি ও পুতিনের জন্য জিনপিং ‘লাল কার্পেট’ পেতেছিলেন ঠিকই, কিন্তু করমর্দনের বেশি অগ্রসর হননি। করমর্দনের সময় মোদি কতটা বড় করে হেসেছেন ও জিনপিং কতটা গম্ভীর ছিলেন, তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। জিনপিংয়ের তুলনায় মোদির লম্বা হাসি অনেককে বিস্মিত ও বিরক্ত করেছে। যেমন, এই এসসিও-র মঞ্চেই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এর্দোগানের পিঠ চাপড়ে মোদি যেভাবে উষ্ণ করমর্দন করেছেন তা প্রবল সমালোচনা ডেকে এনেছে। ‘অপারেশন সিঁদুরের’ সময় পাকিস্তান ভারতকে নিশানা করেছিল এই এর্দোগানের সরবরাহ করা ড্রোন দিয়েই।
পহেলগঁাওয়ে জঙ্গি হামলার ক্ষত এখনও সারেনি। সাম্প্রতিক ভারত-পাক সংঘাতের স্মৃতিও খুব টাটকা। এই সংঘাতে পাকিস্তানকে সামনে রেখে অাড়াল থেকে লড়াই করেছে চিন ও তুরস্ক। ‘এসসিও’-তে তাদের সঙ্গে প্রকাশে্য গলাগলি মোদি বিরোধীদের কাছে সহজেই সমালোচনার সুযোগ এনে দিয়েছে।
তবে ঘরোয়া রাজনীতি দিয়ে বিশ্বমঞ্চে চলতে থাকা কূটনীতির ব্যাখ্যা করা ঠিক নয়। কোনও কোনও মহল থেকে প্রচার করা হচ্ছে যে, চিনের প্রেসিডেন্ট ‘এসসিও’-র মঞ্চ থেকে বিশ্ব রাজনীতির সম্ভাব্য নয়া শক্তি বিন্যাসের বার্তা দিতে নাকি অনেক পরিশ্রম করেছেন। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত করতে কয়েক দিন অাগেই তিনি তঁার বিদেশমন্ত্রী এবং দলের পলিটবু্যরোর সদস্য ওয়াং ই-কে দিল্লিতে পাঠিয়েছিলেন। দু’-দেশই পর্যটকদের ভিসা দেওয়া শুরু করেছে। বহু প্রতিক্ষিত মানস সরোবর যাত্রা ফের শুরু হয়েছে।
ওয়াং ই ভারত সফরে এসে তিনটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেছেন। প্রথমে তঁার সঙ্গে বহুমেরু বিশ্বের সম্ভাবনা নিয়ে বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শংকরের বৈঠক হয়। এরপর দু’-দেশের মধে্য দশ দফা ঐকমতে্যর একটি কাঠামো নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের অালোচনা হয়। সর্বশেষ ওয়াং ই মোদির সঙ্গে বৈঠক করেন। যে-বৈঠকের উপজীব্য ছিল শক্তিধর এশিয়া গঠন করার কাজে হাত দেওয়া। যেখানে ড্রাগন ও হাতির হাত মেলানোর প্রসঙ্গটি অাসে। ওয়াংয়ের সফর শেষ হওয়ার পর মার্কিন সংবাদমাধ্যমে জিনপিংয়ের চিঠির খবরটি ফঁাস হয়। যে-চিঠিটি জিনপিং মার্চ মাসে লিখেছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে। গালওয়ানে সংঘর্ষের পর মোদি ও জিনপিংয়ের প্রথম সাক্ষাৎটি ঘটেছিল গত অক্টোবরে রাশিয়ার কাজানে ব্রিকস সম্মেলনে। সেটার সূত্র ধরেই বরফ গলাতে জিনপিং চিঠিটি দিয়েছিলেন। এরপর ‘অপারেশন সিঁদুরের’ সময় চিনের ভূমিকা সব উদে্যাগে জল ঢেলেছিল। কিন্তু ট্রাম্প ভারতের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে রাতারাতি পরিস্থিতির বদল ঘটিয়ে দিয়েছেন। ওয়াং ই-র সফর ভারতের ক্ষতে প্রলেপ দিয়েছে।
রাশিয়া-ইন্ডিয়া-চায়না তথা ‘অারঅাইসি’ অক্ষ নির্মাণে অবশ্য দীর্ঘ দিন ধরে সচেষ্ট পুতিন। ‘এসসিও’-র মঞ্চে তৈরি হওয়া যে-দৃশ্যপট বিশ্বে অালোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে তা রূপায়িত করার ক্ষেত্রে পুতিনের অবদানকে কোনওভাবে খাটো করা যাবে না। চিন ও ভারত, তঁার এই দুই কৌশলগত অংশীদারকে এক মঞ্চে অানতে কোনও খামতি দেখাতে চাননি পুতিন। এখন প্রশ্ন, কত দিন এই ছবিটি স্থায়ী হবে? ট্রাম্পের ৫০ শতাংশ শুল্কের ধাক্কায় ভারতের রফতানি বাণিজ্য কমতে পারে প্রায় ৪ লক্ষ কোটি টাকার মতো। যার ফলে কাজ হারাতে পারেন প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ মানুষ। পণ্য অামেরিকায় রফতানি করে বেঁচে থাকে এমন বহু শিল্পসংস্থা ভারত থেকে পাততাড়ি গোটানোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে মোদি বহুমেরু বিশ্ব গঠনের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় শামিল হয়ে কতটা সময় ব্যয় করতে পারবেন? ভারত ও চিনের সীমান্ত-বিরোধের শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। এই বিরোধ পাশে সরিয়ে রেখে কি চিনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কোনও দিন ভারতের পক্ষে সম্ভব হবে একমেরু বিশ্বব্যবস্থাকে অান্তরিকভাবে চ্যালেঞ্জ ছোড়া? ফোটোগ্রাফে যে-দৃশ্য সহজে তৈরি করা যায়, বাস্তবে তাকে রূপ দেওয়া যথেষ্ট কঠিন।
