সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ, ডাক্তারদের প্রতি সশ্রদ্ধ না হলে সমাজ আমাদের ক্ষমা করবে না। কিন্তু ডাক্তারদের প্রতি ক্রোধের উৎস কী?
হঠাৎ করে গাড়ি এসে থামল। ডাক্তারবাবুকে তুলে নিয়ে চলে গেল একদল আততায়ী। পথে চোখ বেঁধে দেওয়া হয়েছে। যাতে কোন পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে– তা ডাক্তারবাবু বুঝতে না পারেন। কিছু রাস্তা গাড়িতে, কিছু হেঁটে, কখনও সামান্য থেমে, ডাক্তারবাবু গিয়ে পৌঁছলেন ঘন জঙ্গলের মধ্যে। এবার চোখ খুলে দেওয়া হয়েছে। সামনে যিনি দঁাড়িয়ে– তঁাকে কে না চেনে এ তল্লাটে। অন্ধকার জগতের প্রসিদ্ধ নাম। কিন্তু কাকে দেখতে হবে? ডাক্তারবাবু বুঝতে পারেন না। একটি আঙুল নির্দেশের মতো দেখিয়ে দেয়– ঘরের ভিতরে শায়িত কারও প্রতি। ডাক্তারবাবু ভয়ে-ভয়ে ঘরে যান। সেখানে অন্ধকারই বেশি। আলো কম। তাও চিনতে অসুবিধা হয় না তঁার। ইনি যে এই সারা অঞ্চলের ঘোষিত ঈশ্বর।
এ ব্যক্তির কৃপাদৃষ্টি থাকলে মৃত্যুও স্পর্শ করে না। ‘ডন’ হয়েও তিনি হয়ে উঠেছেন ভগবানের মতো। ডাক্তারবাবু নাড়ি ধরেন। এবং বুঝতে পারেন, তঁার আসার আগেই এখানে মৃত্যুর পায়ের ছাপ পড়েছিল। ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে জীবনের ধুকপুকানি। এত বড় ‘ডন’ বা ‘মসিহা’ বা ‘রবিনহুড’– যাই বলা হোক, আপাতত নির্জীব দেহ মাত্র। কঁাপতে কঁাপতে ডাক্তারবাবু ঘর থেকে বেরন। অনেকগুলি চোখ উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে তঁার দিকে। ডাক্তারবাবু মৃদুভাবে ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দিলেন– সব শেষ। সঙ্গে সঙ্গে ‘গুম’ শব্দে গর্জে উঠল আগ্নেয়াস্ত্র। দড়াম করে পড়ে গেলেন ডাক্তারবাবু। এবার তঁার দেহও প্রাণহীন, স্পন্দনশূন্য।
‘পাতাললোক’ ওয়েব সিরিজে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে কপালে যেমন আতঙ্কের ঘাম জমে, তেমনই মনে পড়ে যায়, এমন কতই না সিনে-অনুষঙ্গ রয়েছে, যেখানে ডাক্তারবাবুকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ডনের ডেরায়। ডনেরা আহত হলে তাদের তো উপায় থাকে না প্রকাশ্যে ডাক্তারের কাছে গিয়ে চিকিৎসা করানোর, আর হসপিটালে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। ফলে, ডেরাতেই ‘মিনি হসপিটাল’ তৈরি করে চিকিৎসা ও শুশ্রূষা চলে। অনুরাগ কাশ্যপের ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর’ আমাদের দেখিয়েছে– সর্দার খান, যে মায়াদয়াহীন অন্যকে কোতল করার বেলায়, কিন্তু তার ছেলের দেহ যদি ছুঁয়ে যায় গুলি, মুহূর্তে কেমন উতলা হয়ে পড়ে! চিৎকার করে, হল্লা মচিয়ে কেমন মাথায় তোলে বাড়ি! চ্যাংদোলা করে নিয়ে যায় ছেলেকে হসপিটালে।
সেখানকার ডাক্তারবাবু অবাক! যার গুলি লেগেছে, সে তো দিব্যি দঁাড়িয়ে! বিরক্ত সর্দার খান হুকুম ঝাড়ে– এখনই অপারেশন করো। ঠিক তখন লোডশেডিং হয়। ডাক্তারবাবু বলেন, অন্ধকারে কিছু করা যাবে না আর। প্রত্যুত্তরে, সর্দার খান, বন্দুক ধরে ডাক্তারের কপালে। এখনই করতে হবে।
ডাক্তারদের প্রতি এই যে অনমনীয় মনোভাব, ক্ষমতা-পাল্লায় ডাক্তারের অধীত বিদ্যাকে ওজন করার চেষ্টা, এ জিনিস তো সমাজে হামেশাই দেখা যায়। রোগীর কিছু হলে ডাক্তারের দোষ! সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি মনে করিয়ে দিয়েছে যে, চিকিৎসকদের প্রতি যত্নবান না হলে সমাজ কখনও ক্ষমা করবে না আমাদের। এই পর্যবেক্ষণ আইনি দায়রা পেরিয়ে জীবনের রামধনুকে ঝিকিয়ে তোলে যেন।
