সম্প্রতি ব্রিটিশ কাউন্সিল করোনা-পূর্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুজো নিয়ে একটি গবেষণার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, যা জানাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের পুজোর সৃজনশীল অর্থনীতি রাজ্যের অর্থনীতির পক্ষে কতটা মঙ্গলজনক। কিন্তু করোনা-কালে জীবন ও অর্থনীতির দ্বন্দ্বের পরেও কি ছবিটা একই থাকবে? করোনা-পরবর্তী পুজো নিয়ে গবেষণা হলে এই বিষয়ে একটি তুলনামূলক ধারণা পাওয়া যাবে। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল
সেই কলেজ জীবনে অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর লেখায় পড়েছিলাম, দুর্গাপুজো কীভাবে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক হয়ে ওঠে। খুব সহজ ভাষায় তিনি আমার মতো একজন খুব সাধারণ পাঠককে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সাম্যবাদীরা যতই খোলাবাজারের কনজিউমারিজমের বিরুদ্ধে থাকুক না কেন, এই চলতি ব্যবস্থায় কনজিউমারিজম কিন্তু সঞ্চিত সম্পদকেই বিনাশ করে, মার্কসীয় পরিভাষায় যাকে বলে ‘অ্যাকিউমুলেটেড ওয়েলথ’।
পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুজো প্রকৃতপক্ষে এত বড় ইন্ডাস্ট্রি হয়ে ওঠে যে, নানা ধরনের আর্থিক পরিষেবার পরিসর তৈরি হয়। বাজার অর্থনীতির ভাষায় বলা যায়, ‘মানি সার্কুলেশন’ হয়। এই কোভিডকালে বিভিন্ন ব্যাংক, এমনকী, রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া বারবার এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে যে, এই ‘সার্কুলেশন অফ মানি’ কীভাবে কমে গিয়েছে এবং তা বাড়ানোর জন্য কতরকম কৃত্রিম স্টিমুলাস দেওয়ার চেষ্টা চলছে। যেমন, ঋণের সুদ কমিয়ে অথবা বাড়তি কোনও সুবিধা দিয়ে কনজিউমারকে আহ্বান জানানো হচ্ছে- এসো এসো, একবার পরখ করে যাও আমার পণ্য।
সম্প্রতি ব্রিটিশ কাউন্সিল পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুজো নিয়ে একটি গবেষণার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সেই স্টাডি থেকে জানা যাচ্ছে, দুর্গাপুজোর সৃজনশীল অর্থনীতি ৩২ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকার ব্যবসা তৈরি করে। ৩২ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকার এই উৎসব-অর্থনীতি পশ্চিমবঙ্গের জিডিপি-র ২.৫৮ শতাংশ।
[আরও পড়ুন: উদ্বাস্তু জীবনের আয়না হাতে এক ছিন্নমূলের বৃত্তান্ত]
এই ধরনের স্টাডি সম্ভবত প্রথম। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন দপ্তর ব্রিটিশ কাউন্সিলকে এই গবেষণাটি করার জন্য কমিশন করে। এই গবেষণা এবং সমীক্ষা ২০১৯-এর সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০-র জানুয়ারি পর্যন্ত চালানো হয়। দুর্গাপুজোয় মূর্তি স্থাপনা, নানা ধরনের ইন্সটলেশন, আলোকসজ্জা, বিভিন্ন খুচরো বিক্রয়, স্পনসরশিপ, বিজ্ঞাপন, খাদ্য এবং পানীয়- এই সমস্ত পণ্যের উপর আলাদা করে গবেষণা হয়েছে। গবেষণালব্ধ এই রিপোর্টের পোশাকি নাম হল ‘Mapping the Creative Economy around Durgapujo in 2019’।
এই রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, বাংলার পুজোর শিল্পকলা, থিমপুজোর ডেকরেশন ইত্যাদি কর্মযজ্ঞর মোট আর্থিক মূল্য হচ্ছে, ৮৬০ কোটি টাকা। সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে কলকাতার অ্যাকাউন্ট হল শতকরা ১৫ ভাগ শেয়ার। মূর্তির ইন্সটলেশনের জন্য তার যে সৃজনশীল অর্থনীতি, তার পরিমাণ ২৬০-২৮০ কোটি টাকা এবং শুধু কলকাতাতেই এই খরচের পরিমাণ ১২০ কোটি টাকা। কুমোরটুলি এই মূর্তি-অর্থনীতির শতকরা ৪০ ভাগ অংশীদারিত্ব বহন করে। যাঁরা সাবেকি পটুয়া, তাঁরা উত্তর কলকাতায় বসবাস করেন। আর যাঁরা ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে এই কাজ করছেন, এই সময় তাঁদের অর্থনীতি এখনও উজ্জীবিত হয়।
পুজোর এই সৃজনশীল অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান খুচরো বা রিটেল সেক্টরের, যার পরিমাণ ২৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। এই মরশুমে সবচেয়ে বেশি বিক্রিবাটা হয় এবং নানারকম অফার, ডিসকাউন্ট এবং সেলের পণ্য বিক্রি- এই সমস্তকিছু কিন্তু দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করেই হয়। সাহিত্য-প্রকাশনা, বই এসবের ব্যবসার পরিমাণও ২৬০-২৭০ কোটি টাকার মতো। ফিল্ম এবং বিনোদনের ক্ষেত্রে এই অর্থনীতির পরিসংখ্যান হচ্ছে ৫৩.০২ কোটি টাকা। এ ছাড়া শুধুমাত্র খাওয়াদাওয়া, ঝালমুড়ি থেকে শুরু করে চাইনিজ এবং রেস্তরাঁয় খেতে যাওয়া- সব মিলিয়ে প্রায় ২ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকার ব্যবসা হয়।
সুতরাং, উপভোক্তারা এই উৎসবের মরশুমে এবং দুর্গাপুজোর সময় যে খরচটা করে, সেটা তাদের সারা বছরের, এমনকী তার আগের মাসগুলির খরচের তুলনায় শতকরা ৩০ ভাগ বেশি। অর্থাৎ, এই সময় পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ব্যয় বেশি করে।
কোনও সন্দেহ নেই যে, এই গবেষণাটা বেশ জটিল। আর এটা খুব একটা সহজসাধ্য ছিল না। দেশজুড়ে এইরকম কোনও সৃজনশীল অর্থনীতির পরিসর নেই বলেই দাবি করছে ব্রিটিশ কাউন্সিল। অবশ্য তারাও এই ধরনের বিষয় নিয়ে রিসার্চ এই প্রথম করল বলে জানিয়েছেন ভারতের ‘ব্রিটিশ কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া’-র অধিকর্তা বারবারা উইকহ্যাম। ব্রিটিশ কাউন্সিলের পূর্ব এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অধিকর্তা দেবাঞ্জন চক্রবর্তী বলছেন, যে মেথডলজি ব্যবহার করা হয়েছে, তা খুব স্বচ্ছ এবং ভারতের যে-কোনও রাজ্যে এই মেথডলজি প্রয়োগ করে সৃজনশীল অর্থনীতির উপর একটা সবিস্তার, অখণ্ড গবেষণা সম্ভব।
এই রিপোর্টটা থেকে দেখা যাচ্ছে, এই উৎসবের সময় বাসে করে যাতায়াত শতকরা ১২০ ভাগ বেড়ে যায় এবং বিমান ও রেলের যাতায়াত শতকরা ১১ ভাগ বেড়ে যায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন-সচিব নন্দিনী চক্রবর্তী বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের সার্বিক অর্থনীতিতে দুর্গাপুজো এবং সামগ্রিকভাবে এই উৎসবের মরশুম সাংঘাতিকভাবে কর্মসংস্থানেরও সুযোগ দেয়। প্রচুর পরিবারের আয় এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে মস্ত বড় সাপোর্ট হল দুর্গাপুজো এবং শারদ-উৎসব।
এই রিপোর্ট পড়ে যেমন খুশি হওয়ার কারণ আছে, তেমনই আবার এই করোনাকালের দুর্গাপুজোতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের বেপরোয়া প্যান্ডেল হপিংয়ের যে চিত্র টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম এবং কলকাতার ভিড়ের যে মবোক্রেসির চেহারাটা দেখলাম, তাতেও কিন্তু ক্রমশ আতঙ্কিত হচ্ছি। চিকিৎসকরা সাবধান করেছেন। এমনকী, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্গাপুজোর প্রত্যেকটি উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে গিয়ে বারবার বলেছেন, আপনারা সামাজিক দূরত্ব মেনে চলবেন, অতি অবশ্যই মাস্ক পরবেন, মাস্ক না পরে প্যান্ডেলে ঢুকবেন না। আর দুর্গাপুজোর যে আচরণবিধি, অর্থাৎ রাজ্য সরকার যে প্রোটোকল তৈরি করে দিয়েছে, যা রাজ্যের প্রত্যেকটা ক্লাবের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে- সেগুলো যাতে মানা হয়।
সরকার বলতে পারে, রাজ্যের পুলিশ তৎপরতার সঙ্গে তা নিয়ন্ত্রণ করারও চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু যতক্ষণ না আমরা সাধারণ মানুষ এই ব্যাপারে সচেতন হব- ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কে আটকাবে? আমরা মাস্ক পরা নিয়ে এখনও চোর-পুলিশ খেলছি। যেন মনে হয়, এটা আমার নিজের ব্যাপার নয়, অন্য কারও জন্য এটা আমাকে করতে হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে, পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুজোর পর করোনার সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তাতে আমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে, করোনা এরপর আরও বেশি বেড়ে না যায়! শুধু তা-ই নয়, পশ্চিমবঙ্গে যদি এরপর থার্ড ওয়েভ এসে যায়, তাহলে তো তা বিরাট ভয়ের কারণ হবে। সে কথা মাথায় রেখে বলতে হয়, একদিকে যেমন এই উৎসবের অর্থনীতি আছে, উৎসবের আনন্দ এবং হইচই আছে- তেমনই তার পাশাপাশি রয়েছে করোনা-সচেতনতা। করোনার প্রাক্-লগ্ন থেকে বারবার এই প্রশ্নটাই উঠে এসেছে- আগে অর্থনীতি, না আগে জীবন? যদি আমার জীবনই না থাকে, তাহলে অর্থনীতি কীসের জন্য? এই আপ্তবাক্য সাধারণ মানুষের কাছে কতটা পৌঁছেছে, কতটা আমরা বুঝতে পেরেছি- তা টের পাওয়া গেল না এ বারের কলকাতার দুর্গাপুজোর দৃশ্য দেখে।
হতে পারে, মানুষ এতদিন ধরে গৃহবন্দি থেকে নানাবিধ আর্থিক সমস্যা, কর্মহীনতা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক হতাশায় জর্জরিত। ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই হতাশা থেকে বেরনোর একটা প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে এবারে। কিন্তু দুঃখ লাগে এটা ভেবে যে, বিমানবন্দরের কাছাকাছি এলাকা হওয়া সত্ত্বেও শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবের ‘বুর্জ খলিফা’ লেজার আলো দিয়ে সাজানো হল। তার জন্য এয়ারপোর্ট অথরিটির চিঠি আসে পুজো কমিটিতে এবং এই আলো বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই আলো দেখার জন্য যে ভিড় হয়েছিল, তা দেখে যেন মনে হচ্ছিল, পতঙ্গ যেভাবে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে- সেভাবেই মানুষ পিলপিল করে সেই আলো দেখতে যাচ্ছে। পরিস্থিতির ফেরে মণ্ডপ দর্শন বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। এই ধরনের উত্তেজনা কতটা কাঙ্ক্ষিত- সে প্রশ্নও মনে জাগছে।
তবে ব্রিটিশ কাউন্সিলের কাছে আমি অনুরোধ করব, যদি এই সমীক্ষাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। অর্থাৎ ২০১৯-এ যে সৃজনশীল অর্থনীতির পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল, এই করোনাকালীন দুর্গাপুজোর পর, যদি তারা ভবিষ্যতে সমীক্ষা করে দেখে, গবেষণা করে দেখে- তাহলে একটা তুলনামূলক চিত্র আমাদের কাছে ফুটে উঠবে। একটা পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে যে, পশ্চিমবঙ্গের উৎসবের এই সৃজনশীল অর্থনীতি করোনার জন্য কতটা ধাক্কা খেয়েছে বা কতটা প্রভাবিত হয়েছে।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক বিশিষ্ট সাংবাদিক
redhat.jayanta@gmail.com