shono
Advertisement

Breaking News

Bibhu Ranjan Sarkar

এক সাংবাদিকের শেষ লেখা

সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিককের সত্যনিষ্ঠ হওয়া সোনার পাথরবাটি হয়ে উঠেছে এদেশেও।
Published By: Amit Kumar DasPosted: 02:25 PM Aug 27, 2025Updated: 05:00 PM Aug 27, 2025

কিংশুক প্রামাণিক: বাংলাদেশের প্রবীণ সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের দেহ মুন্সিগঞ্জে মেঘনা নদীতে ভাসতে দেখে শিউরে উঠেছিলাম। আমাদের পেশার মানুষের এই পরিণতি!

Advertisement

অতঃপর তাঁর সর্বশেষ লেখাটি পড়ে মনটা কেঁপে উঠল। নিজের কর্মজগতে একজন মানুষ কতটা আঘাত পেলে, কতবার ক্ষতবিক্ষত হলে, শ্রমের মূল্য না-পেয়ে কত অসহায় হয়ে উঠলে এমন যন্ত্রণামাখা বিদায়বার্তা লিখতে পারেন! আবার তিনি যদি হন সাংবাদিক। সমাজের ‘চতুর্থ স্তম্ভ’– যাঁর পেশা মানুষকে সত্য সংবাদ পৌঁছে দেওয়া। হাজার আলোয় ভেসে থাকা একজন সাংবাদিকের ব্যক্তিগত জীবন আসলে কতটা আঁধারময় তা আবার প্রমাণ করে দিলেন পড়শি দেশের ‘আজকের পত্রিকা’-র অভিজ্ঞ সাংবাদিক। সারা জীবন মন্ত্রগুপ্তির আদর্শ পালন করলেও শেষবেলায় তিনি কিছুই গোপন করলেন না। বুকের উপর জমে থাকা পাথর সরিয়ে খুল্লমখুল্লা সত্যি কথাগুলি জানিয়ে দিয়ে গেলেন। বলা ভাল, পেশাটাকে বেআব্রু করে দিলেন।

একজন সাংবাদিকের কলম একটি সরকারের পতন ঘটাতে পারে, ‘এক্সক্লুসিভ’ কোনও স্টোরি পর্দার পিছনে ঘটে যাওয়া রহস্য উন্মোচিত করে দিতে পারে। তদুপরি, সাংবাদিক নিজের জীবনে তিমিরে নিমজ্জিত। ঘরে-বাইরে, অফিসে, অ্যাসাইনমেন্টে শুধুই সংঘাত-প্রতিঘাত! সত্যি কথাগুলি বললে বা লিখলে হয়তো বিভুরঞ্জনের সাংবাদিকতার জীবন শেষ হয়ে যেত। খুনও হয়ে যেতে পারতেন। সে-ই তিনি লিখলেন, মৃত্যুর ঠিক আগে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে অতি পরিচিত এই প্রবীণ নিহত হয়েছেন, না কি আত্মহত্যা করেছেন– সেই প্রশ্নের কিনারা হয়নি। গোটা ব্যাপারটা রহস্যে মোড়া। দেহ মিলেছে নদীতে। যদি খুন হন, তাহলে এমন আত্মবিশ্লেষণ করলেন এবং সবাইকে জানালেন কেন? লেখাটি ২১ আগস্ট ভোর পাঁচটায় লেখা। নিজেই সময় উল্লেখ করেছেন। সারা রাত ভেবে লিখেছেন হয়তো। সকাল ৯টা নাগাদ ‘বিডি নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’-এ লেখাটি মেল করেন। নিচে নোট দেন, ‘জীবনের শেষ লেখা হিসেবে এটা ছাপতে পারেন।’ তারপর থেকেই তিনি নিখোঁজ। একদিন পর দেহ ভেসে উঠল মেঘনায়। হইহই। সবটা দেখার পর আমার মনে হয়েছে এটি আত্মহনন। তিনি ‘খুন’ করেছেন নিজেকে। অথবা, তাঁকে খুন করেছে কোনও মানুষ নয়, খুনি আমাদের ‘সিস্টেম’।

তথাকথিত ‘ফ্যাসিস্ট’ শেখ হাসিনাকে তাড়িয়ে বাংলাদেশে যারা নির্বাচন এড়িয়ে ক্ষমতা ভোগ করছে, তাদের জমানায় যে ‘সুশাসন’ বলে যে কিছুই নেই তা প্রতিদিন দেখতে পাই। এমনই নৈরাজ্য যে খুনের আসামি, কুখ্যাত জঙ্গি বেকসুর খালাস হয়ে যায়! প্রকাশ্য রাস্তায় ইট দিয়ে থেঁতলে খুন করা হয় ব্যবসায়ীকে। পুলিশ দেখে না, জানে না। তারা বরং প্রাণভয়ে থানায় সিঁটিয়ে থাকে। আবার এ-ও দেখি, সেনা-পরিবৃত হয়ে জনসভা করতে এসে জনরোষের মুখে পড়ে সাঁজোয়া গাড়ি চেপে পালাচ্ছে ছাত্রনেতারা!

প্রফেসর ইউনূস নোবেল জিতেছেন। সারা বিশ্ব তাঁকে চেনে। ক্ষমতার আসনে বসে তিনিই হয়ে গেলেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র। সংবাদপত্রের টুঁটি টিপে ধরা চলছে। তিনি চুপ। বাংলাদেশে কবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে, কেউ জানে না। ক্ষমতাভোগীরা এত আরাম পেয়েছে যে ভোট করার গরজ নেই। বিভুবাবুর শেষ লেখায় আর একবার বাংলাদেশের পরিস্থিতি উঠে এল।

সাংবাদিকতা একজন সাংবাদিকের জীবনে কী অসহনীয় পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা ওই প্রবীণ নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন। এমন নয় যে শুধু বাংলাদেশ, তাঁর কথাগুলি ভারতের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও অনেকখানি প্রযোজ্য। বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক জগতের অনুপ্রবেশে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিককের সত্যনিষ্ঠ হওয়া সোনার পাথরবাটি হয়ে উঠেছে এদেশেও। তাও আমাদের সব হারিয়ে যায়নি। সোশ‌্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে সাংবাদিকতার মূল ধারায় আঘাত হানার চেষ্টা হলেও সত্যনিষ্ঠ, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ভারতে এখনও বেশ শক্তিশালী। কথা বলার গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষিতই। কিন্তু বাংলাদেশে? যা চলছে, তা ভয়াবহ!

শেষ লেখায় ঢাকা সুশীল সমাজকে কি নাড়া দিতে পারলেন বিভুরঞ্জন? তারা কি আছে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার অবস্থায়? পাঁচ দশক সাংবাদিকতা করার পরও যেভাবে তিনি অবহেলা, অন্যায়, কণ্ঠরোধের স্বীকার হয়েছেন, তা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। লেখায় শুধুই অভিমান। না-পাওয়ার যন্ত্রণা। না-বলতে পারার কষ্ট। ধার-দেনায় ডুবে যাওয়া সংসার। ডাক্তারি পড়েও মেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। শারীরিক অসুবিধা ও অর্থের অভাবে ছেলের আমেরিকায় পড়তে যাওয়ার সুযোগ হারানো।

তবু তিনি ছিলেন আলোর বৃত্তেই। হুসেন মহম্মদ এরশাদের সাহচর্য থেকে খালেদা জিয়া, কোনওক্রমে কোট-প্যান্ট কিনে শেখ হাসিনার সিঙ্গাপুর সফরের সঙ্গী হওয়া থেকে মহম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ব্যক্তিপরিচয়। স্পষ্টতই বিভুরঞ্জন সরকার বাংলাদেশের সংবাদ জগতে কোনও অচেনা মুখ নন। বরং দেশের সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক মহলে অত‌্যন্ত পরিচিত নাম। সেই মানুষ আক্ষেপ করেছেন, আজ তাঁর লেখা নাকি ‘চলে না’। বলা হয়েছে, ‘কেউ নাকি পড়ে না। তাই বাজার নেই’। লিখেও অর্থ মেলে না। হাজার-হাজার টাকা বাকি। নিজের চিকিৎসা খরচ মাসে ২০-২২ হাজার টাকা। ধার-দেনায় ডুবে জীবন। কী করবেন, জানেন না। তিনিও এও বলেছেন, মন কু ডাকছে। লেখার জন্য কেউ রক্তচক্ষু দেখিয়েছে। তিনি অনুভব করছেন তাঁর লেখার বিরুদ্ধে অদৃশ্য চাপের জেরে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকও কথা বলা বন্ধ করে করে দিয়েছেন।

একটা মানুষ এত হতাশার পর বাঁচবে কীভাবে? আচমকা নদীতে লাশটা ভাসতে দেখে আমারও প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছিল তাঁকে ‘খুন’ করা হয়েছে। এবং এই খুনের অন্যতম কারণ হতে পারে– তিনি হিন্দু। হাসিনার পতনের পর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সম্পাদক শ্যামল দত্ত-সহ হিন্দু সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ, গ্রেফতারি নেমে আসে। তাঁদের বাদ দেওয়া শুরু হয় নানা জায়গা থেকে। কেউ-কেউ খুনও হন।

প্রাথমিক ভাবনার ঘোর কাটলে অবশ‌্য মনে হয়েছে, বিভুরঞ্জন আত্মহত্যা করেছেন। ছত্রে-ছত্রে যে-হতাশা ব্যঞ্জিত হয়েছে, তা তাঁকে হয়তো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ‌্য করেছে। তিনি যেহেতু হিন্দু, আওয়ামি লীগপন্থী হিসাবে ‘ট্যাগ’ লেগে আছে গায়ে, সেই জন্য তাঁর দেহের সঠিক ময়নাতদন্ত ও নির্ভুল রহস্যের কিনারা হওয়া আরও বেশি করে প্রয়োজন। তাঁর দাদা ও ছেলের বক্তব্যও শুনেছি। তাঁরা তেমন অভিযোগ কারও বিরুদ্ধে করেননি। খুন বলেও দাবি করেননি। ঠিক কী ঘটেছে তা খুঁজে বের করার জন্য পুলিশ প্রশাসনের উপর আস্থা রেখেছেন। ফলে এই মৃত্যুকে সামনে রেখে বাংলাদেশে হিন্দু নিধনের তত্ত্ব খাড়া করা অথবা এপার বাংলায় বিষ ছড়ানোর চেষ্টা করছেন যারা– তা ধোপে টেকে না।

এ-কথা সত্যি বাংলাদেশের ক্ষমতা বদল হওয়ার পর সবচেয়ে বিপদে পড়েছে হিন্দুরা। তাদের ‘তৃতীয় শ্রেণি’-র নাগরিক করে দেওয়া হয়েছে। আমার পরিচিত অনেকের মুখে শুনেছি উদ্বেগের কথা। তারা বলছে, আজ আক্রমণ হয়নি বলে কাল হবে না তার কোনও গ্যারান্টি নেই। যে কোনও দিন আমরা ভিটেমাটি ছাড়া হতে পারি। মহিলার সম্ভ্রমহানি হতে পারে। হতে পারে বাড়ি লুঠ। মৃত্যুও হতে পারে। কারণ, বর্তমান সরকার, হিন্দু কেন, কোনও নাগরিককেই নিরাপত্তা দিতে পারছেন না। বিরোধী মতের মূল্য নেই। মৌলবাদীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রশাসনের বড় পদ থেকে হিন্দুদের সরিয়ে দেওয়ার যে-প্রক্রিয়া একবছর আগে শুরু হয়েছিল, তা অব্যাহত। ফলে প্রায় দেড় কোটি সংখ্যালঘু বাংলাদেশে ভাল নেই। তদুপুরি, বিভুরঞ্জনের মৃত্যুর সঙ্গে সেই পরিস্থিতি গুলিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। আর যাই হোক, এর সঙ্গে ধর্মের কোনও সম্পর্ক নেই। বরং সাংবাদিকতার সংকটই প্রকট।

প্রখ্যাত জার্মান সাংবাদিক কার্ল ফন ওসিয়েৎস্কি একটি রাজনৈতিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। গোয়েবল্‌সের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তিনি মিথ্যা লিখতে রাজি হননি। দেরি না-করে হিটলার তাঁকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠান। প্রবল নির্যাতনের পর সাংবাদিক ১৯৩৮ সালে মারা যান। মজার কথা হল, ক্যাম্পে থেকেই তিনি ১৯৩৫ সালে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু নাৎসিরা তাঁকে দেশের বাইরে যেতে দেয়নি। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘কোনও অত্যাচারেই সত্য থেকে বিচ্যুত হওয়া যায় না।’কী আশ্চর্য, বিভুরঞ্জন বিদায়বার্তায় লিখে গেলেন আর-এক তত্ত্ব। তিনি বললেন, ‘সত্য প্রকাশ করলে জীবনের ঝুঁকি থাকে। তাই সত্য লিখে বাঁচা সহজ নয়।’

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • সমাজের ‘চতুর্থ স্তম্ভ’– যাঁর পেশা মানুষকে সত্য সংবাদ পৌঁছে দেওয়া।
  • হাজার আলোয় ভেসে থাকা একজন সাংবাদিকের ব্যক্তিগত জীবন আসলে কতটা আঁধারময় তা আবার প্রমাণ করেন পড়শি দেশের সাংবাদিক।
  • সারা জীবন মন্ত্রগুপ্তির আদর্শ পালন করলেও শেষবেলায় তিনি কিছুই গোপন করলেন না।
Advertisement