অম্লানকুসুম চক্রবর্তী: অমুককুমার তমুক লিখে দিলেন তিনটে শব্দ। ‘কোনও মানে হয়?’ ব্যাকগ্রাউন্ডটা কালো। এরপরে ঝড়ের মতো যে মেসেজগুলো কমেন্ট বক্সে পড়তে থাকল, তা অনেকটা এরকম।
–ঠিকই বলেছ। সবজিতে হাত দিলেই ছ্যাঁকা লাগছে।
–আবার অকালে চলে গেল কে? আবার কি কোনও আত্মহত্যা? খুলে বলো।
–শব্দবাজির দাপট থামানো সম্ভব নয়। কেউ কথা শোনে না, কেউ কথা রাখেনি।
–সত্যিই কোনও অর্থ হয় না! ভীষণ দমবন্ধ লাগছে আজ সকাল থেকে।
–যুদ্ধবিরতি অত সহজে হয় না কি। একপক্ষকে তো থামতে হবে আগে।
–কী হয়েছে? ভালোভাবে বলো।
–পাশে আছি দাদা।
–‘শেয়ার’ করলাম।
–আরআইপি।
–গা ঘিনঘিন করছে সকাল থেকে। কী হচ্ছে এসব চারদিকে?
অমুককুমার তমুক শুধু ওই তিনটি শব্দ লিখেই ছুটি নিয়েছেন সেদিনের মতো। দু-চারদিনের বিরতি। তারপরে আবার সামাজিক মাধ্যমে তাঁর ওয়ালে লিখে দিলেন– ‘সর্বনাশ’। ফের চালু হয়ে গেল কমেন্টের শাওয়ার, আগেরবারের মতো। অমুককুমার তমুকের ফলোয়ার বাড়তে লাগল ঝড়ের গতিতে। তিনি ‘বিখ্যাত’ হয়ে গেলেন। তবে স্বস্তি নেই মোটে। আরও অগুনতি অমুককুমার তমুকের সঙ্গে তাঁর অন্তহীন লড়াই। নিত্যনতুন উদ্ভাবন ক্ষমতা না-থাকলে তিনি কয়েক দিনের মধ্যে বাসি হয়ে যেতে বাধ্য।
আরও একটি শর্ত আছে এই খেলায়। যতটা পারা যায়, কম সংখ্যক শব্দে পোস্টটা ছুড়ে দিতে হবে গ্যালারিতে। এরপরের অস্ত্রের নাম হল, নীরবতা, স্তব্ধতা। ওরা যা খুশি বলে বলুক। ওদের কথায় কী আসে-যায়! উপচে পড়ুক কমেন্ট বক্স। ওটাই পাখির চোখ।
বিপণনের দুনিয়ায় যাকে ‘কার্টেন রেজার স্ট্র্যাটেজি’ বলা হয়ে থাকে, তা কি দ্রুত ঢুকে পড়ছে সামাজিক মাধ্যমে, আমাদের ব্যক্তিগত প্রোফাইলেও? সেলফি, পাঁচতারা রেস্তরাঁয় ডিনার, বুকে নতুন গাড়ির চাবির বিরাট কাটআউট, দুর্দান্ত লোকেশনে বেড়িয়ে আসা, নয়া ঘড়ি, ঝিনচ্যাক ফ্ল্যাট– এসবের ছবি পোস্ট করতে করতে কি ক্রমাগত ঝিমিয়ে পড়ছি আমরা? ক্লান্ত হওয়ার কারণ অবশ্য একটাই। রিঅ্যাকশন ক্রমে কমিয়া আসিতেছে। কর্মসূত্রে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আমার এক বন্ধু এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি বলল, "এমন ছবি দেখলে তার আদর্শ কমেন্ট হিসাবে আমরা মনে মনে কী লেখার চেষ্টা করি জানিস? রাজার ঘরে যে ধন আছে, টুনির ঘরেও সে ধন আছে। ইএমআইয়ের কল্যাণে এ যে সব পেয়েছির দেশ! হ্যাঁ, তোমার নতুন গাড়ি হল, বাড়ি হল। বাট হোয়াট ইজ নিউ ইন দিস?" এমন সমবেত ভাবনাই কি সামাজিক মাধ্যমে পোস্টের ধরন বদলে দিতে বাধ্য করছে ক্রমশ? প্রশ্নটা জটিল। সহজ উত্তর নেই।
প্রতিদিনের বেঁচে থাকায় আমাদের চারপাশের বিজ্ঞাপনের কথা একবার মনে করার চেষ্টা করা যাক। অধিকাংশ বিজ্ঞাপনই সোজাসাপটা। মানে, "এই হল গিয়ে প্রোডাক্ট, ব্যবহার করলে আপনার এই লাভ হবে" জাতীয়। প্রচলিত আট লেনের হাইওয়ের পাশে সার্ভিস লেনের মতো চলে অন্য এক ধরনের বিজ্ঞাপন। এগুলোও বিজ্ঞাপন, কিন্তু সোজা ভাবে কিছু বলে না। একটা প্রতীকী উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরি, কলকাতা ছেয়ে গিয়েছে বিশালাকার, অগুনতি হোর্ডিংয়ে। সেখানে লেখা শুধুমাত্র দু’টি শব্দ– ছলাৎছল। এটুকু পড়ে মনে প্রশ্নচিহ্নের উদয় হতে বাধ্য– এরা বলতে কী চায়? একজন জিজ্ঞেস করবেন অন্যজনকে। প্রত্যেকে নিজের মতো করে এই শব্দযুগলের অর্থ তৈরি করে নেবেন। চোখ রাখবেন ওই হোর্ডিংয়ের জায়গায়। আর ক্রমাগত তা দেবেন হৃদ্মাঝারে জমে ওঠা সাসপেন্সে। এটাই হল ‘কার্টেন রেজার স্ট্র্যাটেজি’।
কয়েক দিন পরে পর্দা উঠে যায়, রাতারাতি। শহর জুড়ে যেখানে ‘ছলাৎছল’ দেখেছিলাম, দেখতে পাই সেখানে লেখা আছে, ‘কোন্নগরে গঙ্গার ধারে নতুন আবাসন। সাধ আর সাধ্যের যুগলবন্দি। রিভার ফেসিং ফ্ল্যাটের জানালা খুললেই ছলাৎছল। বুক করুন আজই।’ মার্কেটিং বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করে, এমন বিজ্ঞাপনে সাড়া পাওয়া যায় অনেক বেশি। লোকের মনে অনেক দিন ধরে ধীরে ধীরে রোপণ করা হয়েছে উত্তেজনা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তারা রহস্য উন্মোচন-পর্বের জন্য মুখিয়ে থাকে। একটি বিখ্যাত গাড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা তাদের নয়া ইলেকট্রিক মডেল বাজারে আনার আগে গাড়িটির শুধুমাত্র কয়েকটি অংশের (পার্টস) বিজ্ঞাপন দিয়েছিল ফলাও করে। সঙ্গে ছিল কাউন্টডাউন। লেখা ছিল, ‘ইলেকট্রিফাইং কিছু একটা হওয়ার জন্য বাকি আর মাত্র ৩ দিন।’ কাউন্টডাউন কমার সঙ্গে বিজ্ঞাপনের লেখাও বদলাতে থাকে ক্রমশ। বিরাট হোর্ডিংয়ে একবার দেখেছিলাম শুধু কাঁচা আমের ছবি।
আর-একটি কথাও লেখা ছিল না সেখানে। কয়েক দিন পরে ওই হোর্ডিংই বুঝিয়ে দেয়, কাঁচা আমের গন্ধওয়ালা কোনও ফ্রুট জুস বাজারে এনেছে একটি বহুজাতিক সংস্থা। মনে আছে, পাড়ায় সদ্য গড়ে ওঠা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের এক কর্মীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "এই আমের বিজ্ঞাপনের ব্যাপারটা কী জানেন?" উনি ফুড সেকশন সামাল দিতেন। মিচকি হেসেছিলেন। মুখ বন্ধ করে রাখার ট্রেনিং কি কোনওভাবে দেওয়া হয়েছিল ওঁদেরও? জানতে ইচ্ছা হয়।
এখনকার দিনে এ ধরনের বিজ্ঞাপনের নমুনা দেওয়া যেতে পারে অজস্র। এ যুগের বিপণনের নতুন ব্যাকরণ বই আমাদের শিখিয়েছে, খুল্লমখুল্লা না বলে রহস্যের মোড়কে পেঁচিয়ে কিছু বলা হলে তা লোকের মনে তৈরি করে অনেক প্রশ্ন। প্রশ্নের ‘উত্তর’ প্রকাশিত হলে তা মানুষের মনে দাগ কাটে বেশি। গভীর দাগ কাটার অর্থ হল– মনে থাকে বেশি। আর বেশি মনে থাকলে বাড়ে কোনও ব্র্যান্ডের প্রতি আনুগত্যও। প্রতিযোগিতার বাজারে এই আনুগত্য জরুরি। ‘এই যে আমার নতুন জিনিস’ বলার চেয়ে ‘বলো তো ঝোলায় নতুন কী আছে?’– প্রশ্নটি সব দিক থেকেই অনেক বেশি আকর্ষক।
মুশকিলটা হল, হবু ক্রেতাকে আগেভাগেই বন্দি করার জন্য বিপণনের দুনিয়ায় যা শুরু হয়েছে ইদানীং, তা ঢুকে পড়েছে আমাদের ব্যক্তিজীবনেও। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বর থেকেও আমরা বেশি ভরসা করি সোশাল মিডিয়ায় নিজের প্রোফাইলটিকে। শুনতে খারাপ লাগলেও ব্যক্তি প্রোফাইল তৈরি করার এক এবং একমাত্র উদ্দেশ্য হল– আমাকে দেখুন। পরম যত্নে যে মধু-মেশানো পোস্টগুলো করি আমরা, সেখানে মৌমাছির মায়াবী ভনভন না হলে আমাদের মনখারাপ হয়ে যেতে বাধ্য। চিরাচরিত পোস্টে তা না এলে ঘুরিয়ে কথা বলে লোক টানতে হয় বইকি। তবে এক্ষেত্রে আমাদের চেষ্টার কোনও বিরাম নেই। সামাজিক মাধ্যমে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়।
‘কার্টেন রেজার মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি’ কিছু দিন রহস্য জিইয়ে রাখার পরে তা উন্মোচন করে। কোকুন দশা থেকে ডানা মেলে বেরিয়ে আসে প্রজাপতি। বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়। মজার ব্যাপার হল, সামাজিক মাধ্যমে এমন পথ নিচ্ছেন যাঁরা, তাঁরা অনেক সময়ই আর ঝেড়ে কাশেন না। রহস্য থেকে যায় রহস্যতেই। শুধু ‘সহে না যাতনা’, ‘কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না’, ‘ফোট্ শালা’, ‘গেল গেল গেলে সব গেল’ কিংবা ‘এল কি অসময়’ লিখে আমরা যারা টুক করে পোস্ট করে দিচ্ছি ফেসবুকের দেওয়ালে, তারা জানি, যে মুহূর্তে উত্তর দিয়ে দেব, পোস্টের খেলা সেদিনের মতো শেষ। আমরা কমেন্ট উপভোগ করি। তারিয়ে তারিয়ে মজা নিই আমার জন্য আম আদমির ব্যয় করা সময়ের।
প্রসঙ্গত, এ ধরনের পোস্টে যদি ৫০০ কমেন্ট পড়ে এবং প্রতি কমেন্টদাতা লেখার জন্য যদি ১০ সেকেন্ড করেও সময় নিয়ে থাকেন, তাহলে আমি জনগণের থেকে ‘অর্জন’ করেছি ৫০০০ সেকেন্ড, মানে ৮৩ মিনিট। কম নয় কিন্তু।
এই প্রবণতাকে ‘গিমিক’ বললে আশা করি অতিশয়োক্তি হবে না। সন্ধেবেলা আলোর ধারে ঘুরঘুর করা পোকার মতো জেগে থাকে এমন পোস্ট। পরের দিন সকালে পড়ে থাকে ওদের নিথর দেহ। এমন পোস্ট এবং তার সঙ্গে লেপটে থাকা কমেন্টের ফলে তৈরি হচ্ছে ভুয়া মৃত্যুর খবর, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, সাম্প্রদায়িক অসমীকরণ এবং কাণ্ডজ্ঞানহীন সহমর্মিতা। এ ধরনের পোস্টের পুনরাবৃত্তি হতে থাকলে তা সমাজের জন্য ভালো হবে না। আমরা যারা এমন ‘পোস্ট’ করে, কমেন্ট খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলি, তারা রাখাল ছেলের ‘বাঘ এসেছে, বাঘ এসেছে’ সংলাপের কথা মনে করার চেষ্টা করে দেখতে পারি।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক খুচরো বিপণন সংস্থায় কর্মরত
amlankusum@gmail.com
