shono
Advertisement
Bangladesh

অদ্ভুত আঁধারের সাসপেন্স

ইউনুস সাহেব কথা রাখতে পারবেন কি?
Published By: Biswadip DeyPosted: 12:13 PM Nov 05, 2025Updated: 12:13 PM Nov 05, 2025

প্রায় দেড় বছরের পর বাংলাদেশ এসে দেখছি– সবার মনে একটাই জিজ্ঞাসা, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনটা কি সত্যিই এখানে হবে? না কি ঠোঁট ও পেয়ালার ফঁাক গলে গণতন্ত্র ফের চলকে পড়বে? উত্তরটা হন্যে হয়ে খুঁজছে সবাই। সেই অনুসন্ধানের নেপথ্যে খুনি নেকড়ের মতো ওত পেতে রয়েছে আরও একটি প্রশ্ন– ইন্ডিয়া কি কিছু করবে না? লিখলেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

ষোলো মাস পর ঢাকা এলাম। শেষবার এসেছিলাম যখন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন চিন-সফর করছেন। তার আগে থেকেই বাংলাদেশ উত্তাল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে। ছাত্রসমাজ সব ধরনের কোটা অপসারণের জন্য লেখাপড়া শিকেয় তুলে রাস্তায়। প্রতিদিন বিক্ষোভ, মিছিল ও সমাবেশে জনজীবন বিপর্যস্ত। ঢাকা প্রেস ক্লাবে ‘আওয়ামী লিগ’ নেতাদের বলতে শুনেছিলাম, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলেই সব শান্ত হয়ে যাবে। কারা কেন এসব করছে সব নাকি তঁার জানা।

এখন যঁারা ‘বড়’ নেতা, কেউ কেউ সরকারের মাথাও, অথচ সেই সময় ছাত্র, এমন দু’-একজনের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কথা হয়েছিল। মনে হয়েছিল, তঁারা যেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখোমুখি বসে ‘কোটা ব্যবস্থা’-র হেস্তনেস্ত করার অপেক্ষায় রয়েছেন। কারও কারও কথায় মনে হয়েছিল, একটু সহানুভূতির পরশ পেতে তঁারা মুখিয়ে আছেন। দিনের-পর-দিন লেখাপড়া শিকেয় তুলে এভাবে রাস্তা কামড়ে পড়ে থাকতে চাইছেন না।

শেখ হাসিনা ফিরলেন। ক’-দিন পরে সাংবাদিক সম্মেলনে কিছুটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই বললেন, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাতিপুতিরা ‘কোটা’ সংরক্ষণের সুবিধে পাবে না তো কি রাজাকারদের নাতিপুতিরা পাবে? সেই বিকেলেই ছিল আমার দিল্লি ফেরার ফ্লাইট। রাতে বাড়ি ফিরে খবর পেলাম, হাসিনার ওই মন্তব্যে তুলকালাম বেধে গিয়েছে। পরের দিন থেকে যা শুরু হয়,
তা ইতিহাস। জুলাই বিপ্লবের সে-কাহিনি পুনরাবৃত্তির আর প্রয়োজন নেই। পদ্মা-যমুনা-মেঘনা দিয়ে তারপর কত জল কোথায় গড়িয়েছে, তাও মোটামুটি সবার জানা। এতকাল পর এসে দেখছি, সবার মনে একটাই জিজ্ঞাসা, ফেব্রুয়ারির নির্বাচনটা কি সত্যিই হবে? না কি ঠোঁট ও পেয়ালার ফঁাক গলে গণতন্ত্র ফের চলকে পড়বে? উত্তরটা হন্যে হয়ে খুঁজছে সবাই। সেই অনুসন্ধানের নেপথ্যে খুনি নেকড়ের মতো ওত পেতে রয়েছে আরও একটি প্রশ্ন– ইন্ডিয়া কি কিছু করবে না?

ফেব্রুয়ারিতে ভোট হবে কি না এই দোলাচলে দেশটা পেন্ডুলাম। ফাটকা বাজারের সবচেয়ে বড় বাজি এটাই। এ নিয়ে একেকজনের একেকরকমের ব্যাখ্যা। সে-কথায় পরে আসছি। তার আগে বলি, ইন্ডিয়াকে নিয়ে প্রশ্নগুলির অধিকাংশ তঁাদেরই মনে, যঁারা এতকাল বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করেছেন। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার ফল ভোগ করেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী পরিবারের সদস্য রূপে গর্ববোধ করেছেন। যঁারা স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞ, এবং অকারণে ভারতকে ‘শত্রু’ ভাবেন না বা ‘যত নষ্টের গোড়া’ মনে করেন না। এই মহলের কারও কারও মনে এখনও এই আশার ঝলক দেখছি যে, হাসিনা এমনি-এমনি ইন্ডিয়ায় পড়ে নেই। ইন্ডিয়ার সাহায্যে একদিন ঠিকই বাউন্স ব্যাক করবেন। ফের দেশের হাল ধরবেন। ফেব্রুয়ারিতে ভোট হলে এঁরা বুথে না-গিয়ে ঘরে খিল দেবেন। বর্তমান শাসকদের তঁারা মানেন না। বিএনপিকেও ভোট দেবেন না। চঁাদসদাগরের মনসা পুজোর ঢংয়েও নয়। এঁদের কেউ কেউ বিএনপিকে ঠেকাতে জামাতদের পক্ষও নিতে পারেন। কোনও কোনও অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের মধ্যে এই মানসিকতা দৃশ্যমান। অবশ্য ভালবেসে নয়। জান-মান-সম্পত্তিরক্ষার তাগিদে।

এসব সম্ভাবনা আলোচিত হলেও মোক্ষম প্রশ্নটি ঘুরেফিরে সব শ্রেণি, সব পেশা, সব ধর্ম, সব মতের সাধারণ মানুষের মনে ঘাই মারছে–ভোটটা হবে তো? না কি কোনও বাহানায় পিছবে? সোমবার দুপুরে রাজনীতি চনমনে হয়ে ওঠে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে গণভোটের কথা বলা হলেও রাজনৈতিক দলগুলি এখনও একমত নয়। এই পরিস্থিতিতে সরকার জানিয়ে দেয়, দলগুলি এক সপ্তাহের মধ্যে মতামত না-জানালে সরকার নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে। গণভোট কবে হবে, কীভাবে হবে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে হবে নাকি তার আগে, সরকারই তা ঠিক করবে। আলোচনার জন্য আর কালক্ষেপ করবে না।

এই সিদ্ধান্তের প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই বিএনপি ২৩৭ আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে। জানায়, বেগম খালেদা জিয়া ৩টি ও তারেক রহমান ১টি আসনে লড়বেন। বোঝা যাচ্ছে, সরকারের উপর বিএনপি-ও চাপ বাড়াচ্ছে।

জাতীয় সনদ রূপায়ণের অর্থ সংবিধান সংশোধন। প্রশ্নটি ঘিরে এক অদ্ভুত জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। ভেবে দেখুন, এখন যঁারা দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তঁারা এই সংবিধানেই হাত রেখে শপথ নিয়েছেন। অথচ কেউ নির্বাচিত নন। অনির্বাচিতরা সংবিধান সংশোধন করার অধিকারী কী করে হতে পারেন, সে এক প্রশ্ন। দ্বিতীয় প্রশ্ন, নির্বাচনের আগে সনদ বাস্তবায়ন কীভাবে অনির্বাচিতরা করতে পারেন তা নিয়ে। তৃতীয় প্রশ্ন, নির্বাচিত সরকার সেই বাস্তবায়ন খারিজ করে দিলে কী হতে পারে তা ঘিরে। জীবনানন্দর ‘অদ্ভুত অঁাধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ’-এর মতো অদ্ভুত এক জটিলতা অক্টোপাসের মতো জাপটে ধরছে বাংলাদেশকে।
ফেব্রুয়ারি নির্বাচন নিয়ে তাই সবার মনে এত প্রশ্ন।

জটিলতা অন্যত্রও। জাতীয় সংসদের যে-ভোট প্রধান উপদেষ্টা মহম্মদ ইউনুস ফেব্রুয়ারিতে করতে চাইছেন, তার চরিত্র কেমন হবে সেটাও অজানা। বাংলাদেশের সংসদ এক কক্ষের। আমাদের লোকসভা-রাজ্যসভার মতো দুই কক্ষবিশিষ্ট নয়। অথচ সংসদ দুই কক্ষ করার দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে। এত দ্রুত তা করা সম্ভবপর কি না সেই সংশয় রয়েছে। এর চেয়েও বড় কথা, ছাত্রদের দল এনসিপি ও জামাত দাবি জানিয়েছে, সংসদের ভোট হোক ‘প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন’ (‘পিআর’) বা সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব অনুযায়ী। মুশকিলটা হল, আমাদের দেশের অধিকাংশের যেমন বিন্দুমাত্র ধারণা নেই রাজ্যসভার ভোট কীভাবে কোন অনুপাতে কোন-কোন অঙ্কের মধ্য দিয়ে হয়, ‘পিআর’ পদ্ধতি নিয়েও বাংলাদেশের কারও কোনও ধারণা নেই। এতকাল ধরে ভোট হয়ে এসেছে (যদিও সেই ভোট বহু সময় প্রহসন) যেভাবে, সেভাবেই ভোট চায় অন্যরা। ‘পিআর’ পদ্ধতির ঘোরতর বিরোধী বিএনপি। এ বিষয়ে সহমত না হলে ভোট কি আদৌ হতে পারবে? এই প্রশ্নেরও উত্তর সবাই খুঁজছে। সেখানেও সাসপেন্স।

এই সাসপেন্সের মধ্যে মাথা চাড়া দিচ্ছে এক অতি সাধারণ ‘লজিক’ বা যুক্তি। সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকায় এক রাজনৈতিক মাতব্বর সেই লজিক উপস্থাপন করলেন এইভাবে, ‘নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন, ভোটে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ কাদের? ভোট হলে কারা লাভবান হবেন? ক্ষমতালাভের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি কাদের? কারা ভোটে জিতে ক্ষমতা পেতে মুখিয়ে রয়েছেন?’

এরপর তিনি বললেন, ‘এবার উত্তরগুলো এক পাশে সরিয়ে রাখুন। আরও একবার নিজের কাছে জানতে চান, ভোট হলে কাদের হারার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি? কারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন? কারা মসনদ থেকে ছিটকে যাবেন কাদের আরোহনের পথ প্রস্তুত করে? উত্তরটা পেয়ে গেলে এবার লজিক খাটান। ভোট হলে যঁাদের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি, তঁারা কেন অন্যের আরোহনের পথ মসৃণ করে সরে দঁাড়াবেন? এতটা মহান সাজবেন? উত্তরটা পেলে ভোটের ভবিষ্যৎটা বুঝে নিন। ক্ষমতায় আসা কঠিন, তার চেয়েও কঠিন ক্ষমতা ত্যাগ করা।’

সর্বত্র এই সাসপেন্স। সবখানে চলছে এই উত্তরের সন্ধান। এরই মাঝে সত্য হল, গত রোজায় দাম বাড়েনি। এখন বাজার মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে। শুধু চাল, তেল ও মাছের দাম চোখ রাঙাচ্ছে। ইলেকট্রনিক ট্রাফিক সিগনালের কল্যাণে বহু রাস্তায় যানজট কমেছে। দুর্গাপুজো নির্বিঘ্নে কেটেছে। যদিও হিন্দুদের খেদ, নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থেকে কেন পুজো করতে হবে? স্থিতিশীলতার অভাবে হোটেল ব্যবসা ধুঁকছে। লগ্নি থমকে আছে। চাকরির বাজার খুব খারাপ। পুলিশ-প্রশাসন এখনও দুর্বল। ঘুরে দঁাড়ানোর একমাত্র দাওয়াই নির্বাচন। সেনা ও নির্বাচন কমিশন প্রস্তুত।

তবু সংশয়, ভোট হবে তো? ইউনুস সাহেব কথা রাখতে পারবেন কি? হাতে সময় ১০০ দিন।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • সবার মনে একটাই জিজ্ঞাসা, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনটা কি সত্যিই এখানে হবে?
  • নাকি ঠোঁট ও পেয়ালার ফঁাক গলে গণতন্ত্র ফের চলকে পড়বে? উত্তরটা হন্যে হয়ে খুঁজছে সবাই।
  • সেই অনুসন্ধানের নেপথ্যে খুনি নেকড়ের মতো ওত পেতে রয়েছে আরও একটি প্রশ্ন– ইন্ডিয়া কি কিছু করবে না?
Advertisement