সম্প্রতি ‘ইনফোসিস’-এর বিরুদ্ধে উঠেছে গণ-ছঁাটাইয়ের অভিযোগ। কোম্পানিটি কর্মীদের ভয় দেখানোর জন্য বরখাস্ত প্রক্রিয়ার সময় ‘বাউন্সার এবং নিরাপত্তা কর্মী’ মোতায়েন করে। কর্পোরেটের অন্দরে ‘থ্রেট কালচার’ নতুন নয়। শ্রমিক-আন্দোলনের কথা প্রচারিত হয়, মালিকের জঙ্গিপনা প্রকাশ্যে আসে কি? লিখছেন সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়।
মালিকের জঙ্গিপনার সঙ্গে তো তেমন পরিচিত নই আমরা। শুধু শ্রমিকের জঙ্গি আন্দোলনের কথাই প্রচার করা হয়ে থাকে। সম্প্রতি ‘ইনফোসিস’-এ শিক্ষানবিশ কর্মীদের প্রতি একপ্রকার গণ-ছঁাটাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। শুধু তা-ই নয়, সেই ছঁাটাই ঘিরে উঠে আসছে সংস্থার আচরণ নিয়ে বেশ কিছু অভিযোগ, যা শুনলে শিহরিত হতে হয়। অভিযোগ– কোম্পানিটি কর্মীদের ভয় দেখানোর জন্য বরখাস্ত প্রক্রিয়ার সময় ‘বাউন্সার এবং নিরাপত্তা কর্মী’ মোতায়েন করেছিল। এতটাই কর্তৃপক্ষর নির্দয় আচরণ যে, যখন ছঁাটাই হওয়া এক কর্মী কাতর আর্জি জানায়– ‘রাতটুকু অন্তত অফিসে থাকতে দিন কাল সকালে চলে যাব।’ তখন এই ইনফোসিস কর্তৃপক্ষ তার আর্জি শুনতেই চায়নি।
এদিকে, ইনফোসিসের মাইসোর শাখায় কর্মী ছঁাটাই নিয়ে সরব হয়েছে ‘ন্যাসেন্ট ইনফরমেশন টেকনোলজি এমপ্লয়িজ সেনেট’। এই ছাঁটাইকে ‘অবৈধ’ অভিযোগ করে ইনফোসিসের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী মনসুখ মান্ডব্যকেও চিঠি দিয়েছেন এই সংগঠনের সভাপতি হরপ্রীত সিং। এইভাবে ৭০০ জনকে ইচ্ছাকৃতভাবে ছাঁটাই করা হয়েছে– যঁারা আড়াই বছর ধরে নিয়োগের অপেক্ষায় ছিলেন। তারপর ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে যোগ দিয়েছিলেন, কিন্তু নিয়োগের কিছু মাস কাটতেই ছাঁটাই করা হল। এমন অভিযোগ পাওয়ার পরে, কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রক কর্নাটক সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছে।
৭ ফেব্রুয়ারি ইনফোসিসের মাইসোর ক্যাম্পাসে প্রশিক্ষণরত নতুনদের ব্যাচ ধরে ডেকে তাদের হাতে বরখাস্তর নোটিস ধরিয়ে দেওয়া হয় এবং ওই দিন সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে ক্যাম্পাস ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কর্মী ছঁাটাই প্রক্রিয়াটি যে গোপনে করতে চেয়েছিল ইনফোসিস কর্তৃপক্ষ, তারও ইঙ্গিত মিলেছে। বরখাস্ত হওয়া যুবক-যুবতীদের নিরাপত্তা কর্মী এবং বাউন্সার দ্বারা পাহারা দেওয়া একটি ঘরে জড়ো করা হয়েছিল। তাদের বাসগুলোকে এমনভাবে রাখা হয়েছিল, যাতে অন্য কর্মী এবং ভ্রমণরত মার্কিন ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে আড়াল করে রাখা যায়। এমনকী, তখন ওই কর্মীদের ফোন ব্যবহার করতেও বাধা দেওয়া হয়, যার ফলে তারা বাইরের সাহায্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া কোম্পানিটি আগেই ই-মেলের মাধ্যমে সতর্ক করেছিল যে, তারা যেন এই কার্যক্রম সম্পর্কে গোপনীয়তা বজায় রাখে।
তবে ইনফোসিসের যুক্তি, শিক্ষানবিশ কর্মচারীদের নিযুক্ত করার পর তাদের প্রত্যেককে অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় উত্তীর্ণ হতে হয়। তিনবারের চেষ্টাতেও কেউই উত্তীর্ণ হতে না পারায়, তাদের ছঁাটাই করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়োগপত্রর শর্তাবলিতেও লেখা রয়েছে বলে দাবি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাটির। এদের তিনবার পরীক্ষার সুযোগ দিয়েও কোনও লাভ হয়নি। পাশাপাশি বলা হয়েছে– ৭০০ জন কর্মীকে ছঁাটাই করা হয়নি, ছঁাটাইয়ের সংখ্যা ৩৫০।
সমালোচনার মুখে পড়ে ইনফোসিসের ব্যাখ্যা কতটা সঠিক, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বেশ কিছু প্রতিবেদন ইঙ্গিত দিয়েছে এই ২০২৪ ব্যাচকে আগের বছরের তুলনায় অনেক বেশি কঠিন মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হয়েছে, যা অনেকের পক্ষে পাস করা প্রায় অসম্ভব করে তুলেছিল। আগে যারা ব্যর্থ হত, তারা পরবর্তী প্রশিক্ষণ পর্বে যেতে পারত, কিন্তু নতুন ব্যবস্থায় সঙ্গে সঙ্গে বরখাস্ত করার নিয়ম চালু করা হয়। পুরো ঘটনায় ইনফোসিসের কর্মীদের মধ্যে বিশেষত যারা তুলনায় নতুন নিয়োগ হয়েছে, তারা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে বেশ চাপে রয়েছে।
এদিকে, কর্পোরেটের অন্দরে সাংঘাতিক ‘থ্রেট কালচার’ বিরাজ করে। কোনও কর্মীর প্রতি ম্যানেজমেন্টের দুষ্কর্মের কথা জানলেও চাকরি হারানোর ভয়ে তা প্রকাশ করতে সাহস পায় না অন্যান্য সহকর্মী। ফলে তা প্রকাশ্যে আসার সম্ভাবনা কম থাকে। কর্ম-সংস্কৃতি কলুষিত করার জন্য মূলত আঙুল ওঠে কর্মীদের দিকেই। কিন্তু বছরখানেক আগে একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ আধিকারিককে তার অধস্তন সহকর্মীদের সঙ্গে মিটিং করার সময় চরম দুর্ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছিল। শুধু বেসরকারি ব্যাঙ্ক বলে নয় বিভিন্ন কর্পোরেট অফিসেই বসের সঙ্গে মিটিং মানেই তো তটস্থ হয়ে থাকে অধস্তন সহকর্মীরা।
আর যদি ইনফোসিসের কথাই বলি, তাহলে ভুললে চলবে না, কয়েক মাস আগে সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণমূর্তি তরুণ প্রজন্মকে সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টা কাজ করতে নিদান দিয়েছিলেন। উৎপাদনশীলতার নিরিখে অন্য দেশের তুলনায় ভারত পিছিয়ে থাকায় প্রতিযোগিতার বাজারে উন্নত দেশের সঙ্গে লড়তে এটা দরকার বলে বার্তা দেন। কিন্তু দেখা যায়, তার কিছু আগে প্রকাশিত ‘ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন’-এর (আইএলও) রিপোর্ট ভিন্ন কথা বলছে। বিশ্বের ১০টি বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্য গড়ে ভারতের সাপ্তাহিক কাজের সময় সবচেয়ে দীর্ঘ।
আইএলও’ রিপোর্ট অনুসারে, সমৃদ্ধি এবং সাপ্তাহিক কাজের সময়ের মধ্যে বরং একটি বিপরীত সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ যেসব দেশে কাজের সময় কম, তাদের মাথাপিছু জিডিপি আদৌ কম নয়। শীর্ষ ১০টি অর্থনীতির মধ্যে ভারতে সাপ্তাহিক কাজের সময় সবচেয়ে বেশি এবং মাথাপিছু জিডিপি সবচেয়ে কম। শীর্ষ অর্থনীতির দেশগুলির মধ্যে ফ্রান্স সবচেয়ে কম সাপ্তাহিক কাজ করে ৩০.১ ঘণ্টা, অথচ মাথাপিছু জিডিপির নিরিখে অন্যতম সর্বোচ্চ ৫৫,৪৯৩ ডলার। প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৪৭.৭ ঘণ্টা কাজ করে ভারতীয়রা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কাজ করা দেশের তালিকায় সপ্তম। ‘ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন’-এর ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুসারে কাতার, কঙ্গো, লেসোথো, ভুটান, গাম্বিয়া এবং সংযুক্ত আরব এমিরেটসের গড় কাজের ঘণ্টা ভারতের চেয়ে বেশি।
চাকরি থাকাকালীন নিজেকে দক্ষ মনে করা লোকেরা ইউনিয়নকে চিরকালই একটু নিচু চোখে দেখে এসেছে। ঠেকায় না পড়লে, চাকরি না হারালে তারা তো ইউনিয়নের প্রয়োজন বোধ করে না। সেই মানসিকতার জন্যই বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে ইউনিয়নের তেমন অস্তিত্ব নেই। আবার ইউনিয়নের একটা নেতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে অনেকের কাছে। কারণ ইউনিয়নের দাবিদাওয়ার বিষয়টা যতটা নেতিবাচক প্রচারে আসে, ম্যানেজমেন্টের চাপের কথাটা সেভাবে আসে না। উল্টে ওই কাজের চাপের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটাই বেঁচে থাকার অঙ্গ হিসাবে প্রচার করা হয়। চাকরি চলে যাওয়া মানে কর্মী অদক্ষ, কিন্তু বলা হয় না ম্যানেজমেন্ট অপদার্থ।
তাছাড়া বিগত কয়েক বছর ধরে রাষ্ট্রীয় আইনে শ্রমিকদের সুরক্ষা কমেছে এবং শ্রমিক সংগঠনকে দুর্বল হতে দেখা গিয়েছে। বহু ক্ষেত্রে শ্রমিক সংগঠন লোপ পেয়েছে। প্রচার করা হচ্ছে ছঁাটাইয়ের সুযোগ রাখা, চাকরির শর্ত অলিখিত রাখা এবং ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার খর্ব করার মাধ্যমে আরও বেশি নিয়োগ সৃষ্টি করা সম্ভব, দক্ষ শ্রমিককে আরও বেশি মজুরি দেওয়া সম্ভব। কথাটা কতটা সত্যি? কার্যত নিয়োগ বৃদ্ধি হচ্ছে কতটা? সার্বিক ভাবে প্রকৃত মজুরি কতটা বাড়ছে? সর্বনিম্ন মজুরি সারা দেশে কতটা মানা হচ্ছে? চাকরির অভাবে তো অনেকেই ন্যূনতম মজুরির দাবি না-করেই কম বেতনে কাজে যোগ দিচ্ছে।