বাংলাদেশের লাগোয়া অসমেও একই সময়ে বিধানসভা নির্বাচন। সেখানে কিন্তু এসআইআর হচ্ছে না। হচ্ছে না ডবল ইঞ্জিনের ত্রিপুরাতেও। বিশেষ কারণে বেছে নেওয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গকে। বিজেপির রাজ্য নেতারা দিল্লির নেতাদের বুঝিয়েছেন, এসআইআর করলে এক কোটি মুসলিমের নাম তালিকা থেকে বাদ যাবে। যে ভোট বিজেপি পায় না। ৯০ শতাংশ পায় তৃণমূল। ফলে নাম বাদ দিতে পারলে কেল্লা ফতে। লিখছেন কিংশুক প্রামাণিক।
বিহারের ফলাফলের উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। এগজিট পোল মেলে না, মানুষ সেটা বুঝে গিয়েছে। ফলে কোন চ্যানেল কী রায় দিল, তা নিয়ে এখন কারও অাগ্রহ নেই। একটা চাল টিপলে সমস্ত ভাত সিদ্ধ হয়েছে কি না বোঝা যায়। কিন্তু দশজন মানুষ কী বলল, তার উপর নির্ভর করে এক লক্ষ মানুষের মত বোঝা যায় না। দুটো সম্পূর্ণ অালাদা বিষয়। এখন নজর দ্বিমুখী।
যদি বিজেপি-জোট ফের বিহারে জিতে যায় অমিত শাহর ‘টার্গেট’ হবে বাংলা। ’২৬ সালে বাংলার ভোট তাদের কাছে খানিকটা ‘এবার না হলে নেভার’-এর মতো। তারা যদি সফল না হয়, তবে এই রাজে্য তৃণমূল-বিরোধী মানুষের সমর্থনের অভিমুখ বদলে যেতে পারে। পক্ষান্তরে আরজেডি, কংগ্রেস ও বামপন্থীদের মহাগটবন্ধন পাটলিপুত্র দখলে আনতে পারলে নজর চলে যাবে দিল্লির দিকে। নরেন্দ্র মোদি চাপে পড়ে যাবেন। বাংলার দিকে তাকানোর সময় হবে না। কেন্দ্রের গদি রক্ষা-ই হবে মূল চ্যালেঞ্জ।
গত লোকসভা নির্বাচনে একক গরিষ্ঠতা হারায় বিজেপি। সরকার গঠন হয় শরিকদের সমর্থনে। মূলত যে-দু’টি ক্রাচের উপর ভর দিয়ে মোদিজি সোজা হয়ে দঁাড়িয়ে রয়েছেন– তঁাদের একজন চন্দ্রবাবু নায়ডু, দ্বিতীয়জন নীতীশ কুমার। দু’জনই চরম সুবিধাবাদী ও পাল্টিবাজ হিসাবে প্রভূত অখ্যাতি অর্জন করেছেন। কেউ-ই তঁাদের বিশ্বাস করে না। বিজেপিও করে না। তাদের তোষামোদ করে হাতে রাখতে হয়েছে সরকার গঠনের স্বার্থে।
তবে এও ঠিক, বিরোধী শিবিরের যা ছন্নছাড়া দশা তাতে রাতারাতি মোদি সরকার পড়ে গিয়ে ‘ইন্ডিয়া’ জোট সরকার তৈরি হবে তা মনে করা কষ্টকল্পনা। তেমন বিপদ হয়তো মোদির হবে না। তবে বিহারে হারলে বিজেপি নিঃসন্দেহে চাপে পড়ে যাবে। নীতীশ তখন কী করবেন, কেউ জানে না। তঁার কাছে মুখমন্ত্রিত্বই সব। সেটা পাওয়ার জন্য তিনি যেভাবে অতীতে এ-ডাল ও-ডাল করেছেন, তা অাবার করবেন। চন্দ্রবাবুও সুযোগ পেলে দর কষাকষি বাড়াবেন।
বিহারে নির্বাচনের মুখে ‘এসআইআর’ করে ৬৮.৬ লক্ষ মানুষের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রচুর ‘মৃত’ ভোটার যেমন রয়েছে, তেমন বাদ গিয়েছে বহু দলিতের নাম। দলিতরা গোবলয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে। ফলে বিহারে তাদের নাম বাদে আরজেডির ক্ষতি হবে বলে ধারণা। একধাক্কায় এত নাম তালিকা থেকে বাদ গেলেও বিধানসভার নির্বাচনের প্রথম দফায় রেকর্ড সংখ্যক মানুষ ভোট দিয়েছে। দ্বিতীয় বা অন্তিম পর্বেও বেশি ভোটের প্রবণতা। লক্ষণীয়, উল্লসিত তেজস্বী যাদব শিবির। তারা মনে করছে, বেশি ভোট মানে ‘অ্যান্টিইনকামবেন্সি’। লালুপুত্রের এই উল্লাস ভোটের প্যাটার্ন ‘বুঝে’ না কি ‘না বুঝে’, না কি কৌশল, সেটা বলবে সময়। বিজেপি নেতৃত্ব কিন্তু একদমই স্বস্তিতে নেই। যে উদ্দেশ্যে বিজেপি এসআইআর করতে চেয়েছে তা সফল হল কি না তা জানতেই এখন অাগ্রহ।
বেশি ভোট পড়া মানেই পরিবতর্নের ইঙ্গিত– এমনই ব্যাখ্যা করে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। মানে, বেশি করে বেরিয়ে এসে মানুষ ভোট দিয়েছে বতর্মান ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে। বাংলার ভোটের ক্ষেত্রে এমন যুক্তি টেকে না। পশ্চিমবঙ্গে গত প্রায় ৫০ বছরে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে। ৩৪ বছর বামফ্রন্ট ছিল। এখন ১৫ বছর হতে চলেছে তৃণমূল শাসন। বামফ্রন্ট সাতটি বিধানসভা ভোট পরপর নিরঙ্কুশ প্রাধান্য নিয়ে জিতেছে। মমতা বন্দে্যাপাধ্যায়ও জিতেছেন তিনটি বিধানসভা নির্বাচন। প্রতিটি ভোটে দুই-তৃতীয়াংশ ছাপিয়ে তঁার শক্তি বেড়েছে। এই দুই জামানায় প্রতিটি বিধানসভা ভোটেই রেকর্ড মানুষ ভোট দিয়েছে, কিন্তু তা কখনও পরিবতর্নের পক্ষে যায়নি। বেশি ‘টার্নঅাউট’ স্থিতিশীলতাকে মজবুত করেছে। ফলে বিহারে বেশি মানুষ ভোট দিচ্ছে বলেই নীতীশ কুমারের সরকারের পতন ঘটে যাবে এমন মনে করার কারণ নেই। বরং এসঅাইঅারে কার লাভ কার ক্ষতি তার বিচার হয়ে যাবে।
বিহারে নীতীশের পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক যুক্তি রয়েছে। লালু জমানার চুরি-দুর্নীতি থেকে বিহারকে অনেকটা বের করতে পেরেছিলেন নীতীশ। অাইনশৃঙ্খলার প্রভূত উন্নতি হয়। যদিও নীতীশ এখন অসুস্থ। দৃশ্যতই তঁার অাচরণ অসংলগ্ন। তঁার দলের জনপ্রিয়তাও কমেছে। তিনি বিজেপির বোঝা। কিন্তু নীতীশকে উপেক্ষা করা বিজেপির পক্ষে সম্ভব নয়। অনেক কম অাসন পেলেও তঁাকে মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছাড়তে হয় অমিত শাহদের। এবারও তঁাকেই প্রোজেক্ট করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রিত্ব না দিলে সরকার ফেলে দিয়ে পালাবেন, সবাই নিশ্চিত।
‘এসঅাইঅার’ অভিঘাতে বিহারের পর বড় নজর বাংলায়। যদি দেখা যায়, বিহারে বিজেপির মুখ থুবড়ে পড়েছে, তাহলে বাংলার কি এসআইআরের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে? খুব জরুরি প্রশ্ন। বিজেপি কিন্তু বাংলায় ‘এসঅাইঅার’ করেছে ছক কষেই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘এসআইআর’ স্থগিত করার দাবি তুলেছেন। এখনও পর্যন্ত ১৭ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কেউ আত্মহত্যা করেছে, কারও হৃদ্রোগে মৃত্যু। চাপ সহ্য করতে না-পেরে একজন বিএলও ব্রেনস্ট্রোকে মারা গিয়েছেন। মমতার দাবি, দু’-বছরের কাজ দু’-মাসে করার জন্যই মৃত্যুমিছিল।
লক্ষণীয়, বাংলাদেশের লাগোয়া অসমেও একই সময়ে বিধানসভা নির্বাচন। সেখানে কিন্তু এসআইআর হচ্ছে না। হচ্ছে না ডাব্ল ইঞ্জিনের ত্রিপুরাতেও। বিশেষ কারণে বেছে নেওয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গকে। বিজেপির রাজ্য নেতারা দিল্লির নেতাদের বুঝিয়েছেন, এসআইআর করলে এক কোটি মুসলিমের নাম তালিকা থেকে বাদ যাবে। যে-ভোট বিজেপি পায় না। ৯০ শতাংশ পায় তৃণমূল। ফলে নাম বাদ দিতে পারলে কেল্লা ফতে। ৫০-৬০ লক্ষ ভোট কমে ব্যবধান ঘুচলেই বিজেপি ক্ষমতায় এসে যাবে।
রাজনৈতিক মহল অবাক এই উদ্ভট মূল্যায়নে। যে ৩৮ শতাংশ ভোট বিজেপি গত কয়েকটি নির্বাচনে পেয়ে চলেছে সেই ভোটার কারা একবারও কি মূল্যায়ন করেছেন অমিত শাহরা! তঁারা যদি মনে করেন, এরা সবাই বিজেপি হয়ে গিয়েছে তাহলে মহাভুল হবে। বিজেপি এখন হিন্দুদেরই ভোট পায় এটা ঠিক। কিন্তু সবটাই ‘হিন্দুত্ব’-র ভোট নয়। বরং প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ভোটই বেশি।
বহু সিপিএম-কংগ্রেস সমর্থক বিজেপি প্রার্থীকে ভোট দেয় তৃণমূল বিরোধিতার জায়গা থেকে। তারা চায় না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী থাকুন। তাদের সাফকথা, ‘আপাতত আমরা তৃণমূলকে হারাতে পারব না, বিজেপি যদি পারে তাকেই দিতে হবে। আগে তৃণমূল হারুক।’ রাতারাতি বামেদের ভোট উড়ে গেল এজন্যই। দিল্লিতে ক্ষমতায় থাকার সুবিধা পেয়ে গেল বিজেপি। বিজেপির বাক্সে ৩৮ শতাংশের মধ্যে ফ্লোটিং ভোটের সংখ্যা ২০ শতাংশ হতে পারে। ‘বিকল্প’ কাউকে পেলে যে কোনও দিন এই ভোট চলে যাবে। তাছাড়া বিজেপি উত্তরবঙ্গে যত শতাংশ ভোট পায়, দক্ষিণবঙ্গে তার কম পায়। দুটো মিলে ৩৮ শতাংশ। দক্ষিণবঙ্গে প্রায় ২৩৬টি আসনের ৮০ শতাংশে রয়েছে তৃণমূলের আধিপত্য।
বিজেপি নেতাদের মনে রাখা উচিত, বাম জমানায় কংগ্রেস ৪২ শতাংশ ভোট পেত প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে। গ্রামে তারা পেরে না উঠলেও শহরে দাপট দেখাত। কলকাতার বুকে একাধিক আসন কংগ্রেস জিতত। অনেক পুরসভা হাতে ছিল। তবু ৪২-কে তারা ৪৫-এ নিয়ে যেতে পারেনি। এসঅাইঅারে বিজেপির লাভ হবে?
খুব জরুরি প্রশ্ন। বাংলায় এই মুহূর্তে এসআইআর নিয়ে ব্যাপক বিভ্রান্তি চলছে। সব কাজ ফেলে নিজের নাম-ঠিকানা, পরিচয়-বাড়ির দলিল ইত্যাদি খুঁজতে সবাই ব্যস্ত। ২০০২ সালের তালিকায় নাম থাকলে কী হবে, আর নাম না-থাকলে কী হবে, এটাই জানে না লক্ষ-লক্ষ সাধারণ মানুষ। ভরদুপুরে দরজায় টোকা দিচ্ছেন বিএলও। হয়তো তখন সবাই ধান রুইতে জমিতে ব্যস্ত। কেউ অফিসে, কেউ অন্য শহরে, কেউ হকারি করতে ট্রেনে। এরপর কীভাবে মাত্র দু’-মাসে দশ লক্ষ মানুষের নির্ভুল তালিকা প্রস্তুত হবে কেউ জানে না।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, খসড়া তালিকা যেদিন প্রকাশ হবে সেদিন বড় অশান্তি না হয়। যার বা যাদের নাম তালিকায় থাকবে না তারা ‘বিদ্রোহী’ হয়ে উঠবে। বিজেপির অঙ্ক ছিল এবং তারা বলছিলও ‘এসআইআর’ হলে এক কোটি মুসলিম অনুপ্রবেশকারী ও রোহিঙ্গার নাম বাদ যাবে। বাস্তব, এখনও পর্যন্ত যে ১৭ জন মারা গিয়েছেন, তঁাদের মধ্যে দশজন হিন্দু। কোনও রোহিঙ্গা এখনও ধরা পড়েনি। বরং এসআইআরে সবচেয়ে সমস্যায় পড়েছে মতুয়া এবং উদ্বাস্তু হিন্দুরা। অনেকের কাছেই কাগজপত্র নেই। তারা সবাই ভোট তো দূরের কথা, ‘নাগরিকত্ব’ হারানোর ভয় পাচ্ছে। বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক। স্বাভাবিকভাবেই ঘোর এক অনিশ্চয়তা। এসআইআর তাদের পক্ষ আম না অঁাটি, বলবে সময়।
