শিক্ষিত ভারতীয় পুরুষদের একাংশ মনে করে– যেখানে মেয়েরা যতটুকু এগতে পারছে, তার জন্য তাদের পরোক্ষ সাহায্যই দায়ী। আশ্চর্য!
তিলকে তাল করে, বাড়িয়ে ও রং চড়িয়ে প্রতিবেদন লেখা সাংবাদিকদের কাজ। এমনই মনে করে সেই নব্য যুবক। সে সুপ্রতিষ্ঠিত। তার স্ত্রী অত্যন্ত সুন্দরী। উপর-উপর বেশ সুখী। কিন্তু যে ইনফরমাল সমাবেশে এ-কথাটি হচ্ছিল, সেখানে উপস্থিত থাকা সাংবাদিকটি সহজে ছেড়ে দিল না। সে তর্কে এগল। জানতে চাইল– রং চড়িয়ে লেখার মানে কী? যুবকটি বলে– তোমাদের লেখা পড়লে মনে হয়, ভারতে ভাল কিছু হচ্ছে না। যা হচ্ছে সব খারাপ।
এই যেমন, মেয়েদের বেলায় তোমরা যা সব খবর করো, সব নেগেটিভ। ভারতের মেয়েরা কি এতখানি খারাপ রয়েছে? সাংবাদিক শান্ত গলায়, অল্প হেসে উত্তর দেয়– সেরা, সেরা সার্ভে তো তাই বলছে। যুবকটি বলে– কিন্তু বদলও কি হচ্ছে না? আস্তে আস্তে বসন্তের রং তো ধরছে মেয়েদের একপেশে, বিবর্ণ জীবনে। এই যেমন, আমার পরিবার। অত্যন্ত রক্ষণশীল। আমার বাবার সময় পর্যন্ত আমাদের বাড়ির মেয়েরা চাকরি করেনি। কিন্তু আমি তো ‘অ্যালাউ’ করেছি, আমার বউকে। চাকরি করে সে।
সাংবাদিক প্রশ্ন করে– কিন্তু তোমার বউয়ের কেন চাকরি করার জন্য তোমার পারমিশনের দরকার? যুবকটি একটু থতমত খেয়ে বলে– তুমি বুঝতেই পারছ আসলে আমি কী বলতে চাইছি! সাংবাদিক এবার কণ্ঠে আনে বজ্রের কাঠিন্য– বুঝতে পারছি না। আসলে, তুমি কাউকে ‘অ্যালাউ’ করছ মানে তুমি নিজেকে কর্তৃত্ব ফলানোর জায়গায় নিয়ে গিয়ে বসাচ্ছ। তুমি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছ। আর, যে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, সে কখনও সমানাধিকারের কথা বলতে চায় না, পারেও না। কিন্তু তোমাকে ধন্যবাদ। ভারতীয় পুরুষদের যে-রক্ষণশীল মানসিকতার কথা আমরা বলতে চাই, তা তুমি মুহূর্তে স্পষ্ট করে দিলে!
২০১৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল জোয়া আখতারের ‘দিল ধড়কনে দো’। সমাজের উচ্চস্তরে যাদের অবস্থান, তাদের মধ্যে যেন আরও প্রবলপ্রতাপে বিরাজ করে পুরুষতন্ত্রের জিন-ভূত। ব্যবসার দায় ছেলেকে দিয়ে যেতে চায় বাবা। মা-ও মনে করে, ব্যবসার উত্তরাধিকার পাওয়া
উচিত ছেলেরই। অথচ ছেলে ব্যবসায় আগ্রহী নয়। সে, উড়তে চায় আকাশে। পাইলট হতে চায়। ব্যবসা বোঝে বরং তার দিদি। বিয়ের পরে, স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠা করে, নিজেকে অন্য উচ্চতায় স্থাপন করেছে। কিন্তু তার বাবা বুঝতে চায় না, বা বুঝলেও মানে না যে, মেয়েকে দিয়েই ব্যবসা হবে, মেয়ের হাতেই সুরক্ষিত থাকবে পূর্বপুরুষের থেকে পাওয়া এই ব্যবসার সাম্রাজ্য!
আমাদের দেশের মেয়েরা বিশ্বকাপ জেতায় তথাকথিত শিক্ষিত ও ডিগ্রিধারী পুরুষদের একাংশের মানসিক সমস্যা যে আরও বাড়ল সন্দেহ নেই। মুখে বলতে হচ্ছে– এই জয়ে তারা খুশি। অথচ, বাড়ির মেয়েদের প্রতিটি সাফল্যে নিজের অংশদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে তারা গলা ফেঁড়ে তর্ক করতে ছাড়ে না। যেন যেখানে যেটুকু এগতে পারছে মেয়েরা, তা কেবল পুরষদের বিচক্ষণ ও পরোক্ষ সহায়তার জন্যই! মেয়েদের ভাল-মন্দ মেয়েদের হাতে ছেড়ে দিতে এত কুণ্ঠা ও পিছুটান কেন? ভগবান-সম হতে চাওয়ার এত বাসনাই বা কেন? তিল বরং তিল হয়েই থাক না!
