shono
Advertisement
Lady Justice

আইনের দেবীর চক্ষুদান!

‘আইনের চোখে সবাই সমান’ বোঝাতে দেবীর দু’টি চোখ বন্ধ করে দেওয়া?
Published By: Kishore GhoshPosted: 09:12 PM Oct 19, 2024Updated: 09:12 PM Oct 19, 2024

আইনের দেবী অন্যায়ের প্রতি নির্বিকার, তা বোঝাতে ইউরোপ নিছক ব্যঙ্গ করেই চোখে ঠুলি
পরিয়ে ‘অন্ধ’ সাজিয়েছিল তাঁকে। পরে, সেটাকেই ‘নিরপেক্ষতা’-র প্রতীক ভাবা হয়। কিন্তু ‘আইনের চোখে সবাই সমান’ বোঝাতে দেবীর দু’টি চোখ বন্ধ করে দেওয়া– দ্বার বন্ধ করে ভ্রমের প্রবেশ রুখতে গিয়ে– সত্যের ঢোকার পথ বন্ধ করে দেওয়ার সমতুল। লিখছেন প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

Advertisement

আইন অন্ধ হতেই পারে না। তাই ভারতের উচ্চতম ন্যায়ালয়ে স্থাপিত মূর্তিতে আইনের দেবী বা ‘লেডি জাস্টিস’-এর চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়েছে। এই দেবীর পরনে গ্রিক বা রোমান পোশাক নয়, নিখাদ ভারতীয় নারীর মতো শাড়ি। মাথায়, কানে, কণ্ঠে, মণিবন্ধে চিরাচরিত ভারতীয় আভরণ। মুখে ভারতীয় ভাবের প্রাবল্য। কিন্তু তাঁর চোখ বাঁধা নেই! আর, এই নিয়েই যত চর্চা, খানিক বিতর্কও।
কিন্তু ‘আইনের দেবী’ কি বরাবর চোখে কাপড় বেঁধে গান্ধারীর মতো অন্ধ সেজেই থেকেছেন? এই
প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পৌঁছতে হবে খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ বা ষোড়শ শতকের ইউরোপে।

অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেসমন্ড ম্যান্ডারসন “ম্যাকগিল ল’ জার্নাল”-এর ২০২০-র একটি সংখ্যায় জানিয়েছেন, ইউরোপে যখন রোমান আইন গ্রহণ করার পদ্ধতি চলছে– তখন, ১৪৯৪ সালে– সেবাস্টিয়ান ব্র্যান্ট নামক এক আইনজীবীর লেখা ব্যঙ্গাত্মক পদ্যের সংকলনে প্রকাশিত অ্যালব্রেখ্‌ট ড্যুরারের আঁকা কাঠখোদাই ছবিতে দেখা যায়– চোখে কাপড়ের পট্টি বাঁধা আইনের দেবীকে। ম্যান্ডারসন সাহেব ওই দীর্ঘ নিবন্ধে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ছবিতে মূর্তির চোখে বাঁধা কাপড়ের ফালি সম্পূর্ণ ব্যঙ্গার্থে আঁকা হয়েছিল। এর কিছু দিন পর পিটর ব্রুহল দ্য এল্ডার নামের বিখ‌্যাত ডাচ শিল্পী লেডি জাস্টিসের চোখে কাপড় বাঁধা ছবি আঁকলেন এবং এই ছবিতেও ব্যঙ্গার্থে ঢাকা হয়েছিল আইনের দেবীর চোখ। এভাবে আরও কিছু ছবি অঙ্কিত হওয়ার পর সপ্তদশ শতকের গোড়ায় দেখা গেল– ন্যায়ের দেবীর উপর আরোপিত অন্ধত্ব ব্যঙ্গাত্মক ভাবমূর্তি হারিয়ে পরিণত হয়েছে পার্থিব ন্যায় বা ‘ওয়ার্ল্ডলি জাস্টিস’-এ।

এ তো গেল অ্যালব্রেখ্‌ট ড্যুরার বা পিটর ব্রুহল দ্য এল্ডার কর্তৃক দেবীর চোখে কাপড় বাঁধার পরবর্তী পর্যায়ের ঘটনা। কিন্তু ন্যায়ের দেবীর চেহারার উৎস খুঁজতে গেলে প্রথমেই যেখানে পৌঁছতে হয়, সেই গ্রিক পুরাণের দেবী ‘থিমিস’ কিন্তু কখনও অন্ধ বা চোখ ঢাকা অবস্থায় কোনও ছবি বা মূর্তিতে প্রকট হননি।
আবার, রোমান পুরাণের দেবী ‘জাস্টিসিয়া’-র প্রাচীনতর মূর্তিতে তাঁকে কখনও চোখ বঁাধা অবস্থায় দেখা যায় না। ইতিহাসবিদরা বলেন, জাস্টিসিয়ার উদ্ভব প্রথম খ্রিস্ট পূর্বাব্দে, অগাস্টাস সিজারের রাজত্বে। সেই হিসাবে তঁারা জাস্টিসিয়াকে যথেষ্ট প্রাচীনও মনে করেন না। চোখ বেঁধে রাখতে হয়নি প্রাচীন মিশরীয় ধর্মবিশ্বাসে সত্য, সাম্য, ন্যায়-নৈতিকতা, ঐক্য প্রভৃতির দেবী ‘মাৎ’ বা “মু’য়াত”-কেও। সেকালের মিশরের বিচারপতিদের বলা হতো মু’য়াত-এর পুরোহিত। অভিব্যক্তিটির সঙ্গে ‘ধর্মাবতার’-এর একটা মিল পাওয়া যায়।

ভারতীয় মহাকাব্যে দেখা যায়, কুরু বংশের ধৃতরাষ্ট্র জ্যেষ্ঠপুত্র হওয়া সত্ত্বেও রাজা হতে পারেননি দৃষ্টিহীন হওয়ার জন্য। সুলতানি বা মুঘল যুগেও দেখা গিয়েছে কারও মসনদে উত্তরণ আটকাতে অন্ধ করে দেওয়ার প্রবণতা– যার শিকার হতে হয়েছে আলাউদ্দিন খলজির কিছু উত্তরসূরি বা জাহাঙ্গিরের বড় ছেলে খসরৌ-কে। সেই সময়ে বিচার যেমনই হোক, তার সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল রাজা, সুলতান বা বাদশাহের দরবার। ফলে বিচারকের বা বিচার ব্যবস্থার চোখ বন্ধ রাখার ব্যাপারটা গর্হিত গণ্য হত।

ইউরোপে আইনের দেবীর চোখের সামনে ঘটা অন্যায়ের প্রতি তিনি ‘অন্ধ’ হয়ে আছেন বোঝাতে কবি, লেখক, চিত্রকররা দেবীর চোখে ঠুলি পরিয়ে তঁাকে অন্ধ সাজিয়েছিলেন নিছক ব্যঙ্গ করে। পরবর্তী যুগে ইউরোপেই সেই ব্যঙ্গাত্মক বিষয়কে একশ্রেণির মানুষ ‘নিরপেক্ষতা’-র প্রতীক ঠাউরে নেন। তঁারা বুঝতে পারেননি, ‘আইনের চোখে সবাই সমান’ বোঝাতে গিয়ে আইনের দু’টি চোখ বন্ধ করে দেওয়া, দ্বার বন্ধ করে ভ্রমের প্রবেশ রুখতে গিয়ে সত্যের ঢোকার পথ বন্ধ করে দেওয়ার সমতুল।

তাই ভারতের আইনের দেবী পুনরায় চক্ষুষ্মতী হয়ে নতুন যুগের সূচনা করবেন, এমন স্বপ্ন এই আকালেও দেখতে আপত্তি তো থাকার কথা নয়।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক আইনজীবী
prasenjit2012@gmail.com

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • অ্যালব্রেখ্‌ট ড্যুরার বা পিটর ব্রুহল দ্য এল্ডার কর্তৃক দেবীর চোখে কাপড় বাঁধার পরবর্তী পর্যায়ের ঘটনা।
  • ভারতীয় মহাকাব্যে দেখা যায়, কুরু বংশের ধৃতরাষ্ট্র জ্যেষ্ঠপুত্র হওয়া সত্ত্বেও রাজা হতে পারেননি দৃষ্টিহীন হওয়ার জন্য।
Advertisement