shono
Advertisement

আমারে কাগজ দিবা...

'সেনসেশন' তৈরি করতে গিয়ে আতঙ্ক বাড়িয়েছে মিডিয়ার একাংশ।
Published By: Biswadip DeyPosted: 04:31 PM Nov 07, 2025Updated: 06:20 PM Nov 07, 2025

এসআইআর হচ্ছে। কিন্তু এত তাড়াহুড়োর কি প্রয়োজন ছিল? অনেকেই আছেন, যাঁরা ডিজিটাল জগৎ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। ওয়েবসাইট, পোর্টাল, ওটিপি, এনুমারেশন ফর্ম খায় না মাথায় দেয়, জানেন না। শুধু জানেন সরকার কিছু একটা করছে। কাগজ না দিলে বিদেশি বলে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দেবে। সোনালি বিবির খবর সেই আগুনে ঘি ঢেলেছে। 'সেনসেশন' তৈরি করতে গিয়ে এই প্রবীণদের আতঙ্ক আরও বাড়িয়েছে মিডিয়ার একাংশ। লিখছেন মণিশংকর চৌধুরী

Advertisement

 

শ্চিমবঙ্গে এসআইআর হচ্ছে। স্পেশাল ইন্টেনসিভ রিভিউ। বাংলায় তর্জমা করলে দাঁড়ায়, বিশেষ নিবিড় সমীক্ষা। কীসের সমীক্ষা? ভোটার তালিকার। কেন সমীক্ষা? অনুপ্রবেশকারী খুঁজতে! রাজ্যময়-দেশময় নাকি গিজগিজ করছে বাংলাদেশিরা। কেজি দরে মিলছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী! তা বেশ, হোক কলরব! ঢুন্ডকে লাও ভোটার তালিকায় ঘাপটি মেরে বসে থাকা বিদেশিদের! তবে, লাও তো বটে, কিন্তু আনে কে? কেন নির্বাচন কমিশন। দিল্লি দরবারে আদেশে বাংলায় ছুটে বেড়াচ্ছে তাদের পেয়াদারা। আর তাই দেখে শঙ্কিত, আমার 'বয়স্ক বন্ধু' (কলমের শুচিতায় প্রবীণ বন্ধুবর) রিভুদা বলল, "আমারে কাগজ দিবা।"

দিন সাতেক আগের কথা। সন্ধ্যা ওই ৮টা নাগাদ হবে। অফিসের কাজ প্রায় শেষের দিকে। সেদিনকার মতো 'তলব' প্রায় তুলে দিয়েছি। মনে মনে ভাবছি, বাড়ি গিয়ে মানকচু বাটা করব। একটু সাদা সরষে, নারকেল কুচি, দু'কোয়া রসুন, একটা কাঁচালঙ্কা, সামান্য পেঁয়াজ কুচি আর সরষের তেল। উফফ!!! গরম ভাতে একেবারে মারকাটারি ব্যাপার। তাছাড়া, আগের দিন রান্না করা পাঁঠার ঝোলও রয়েছে। বেশ বড় বগি থালায় সরু চালের সাদা ভাতের স্তূপ। হড়হড় করে পাঁঠার ঝোলের ঝরনা। সঙ্গে এক টুকরো গন্ধরাজ লেবু-পেঁয়াজ-লঙ্কা। হামিন অস্ত, হামিন অস্ত, হামিন অস্ত!!!

ঠিক সেই সময় ফোনের আওয়াজে চটকা ভাঙল। মন ধরাধামে ফিরল। ওপারে রিভুদা। অন্যদিন বেশ দাপট থাকে গলায়। আজ খানিকটা উদ্বেগ। বললে, "আমারে কাগজ দিবা?" কীসের কাগজ? জিজ্ঞেস করতে বলল, "আরে ওই ২০০২ সনের ভোটার লিস্ট আছে যে, ওইটা বাইর কইরা দিবা। আমার নাম, বউয়ের নাম দুইটাই দিবা। মেয়ের নামও দিবা।" অবাক হয়ে ভাবলাম, 'বাঙাল বলে কী!' অবাক হওয়ার কারণও আছে। রিভুদার মেয়েকে চিনি। বয়স ২৬-২৭ হবে। কোন অঙ্কে তার নাম দুইয়ের তালিকায় থাকবে! যাই হোক, বছর ষাটের বন্ধুবরকে আর বোঝাতে গেলাম না। হুঁ হুঁ বাবা, বাঙালের গোঁ। ততক্ষণে, পাশের বাড়ির চিনুদাকে ধরে হোয়াটসঅ্যাপে আমাকে বাড়ির সবার ভোটার কার্ড পাঠিয়ে দিয়েছে। রিভুদা স্মার্টফোন চালাতে পারে না। তাই এই ব্যবস্থা। সে তো হল। গোল বাঁধল অন্য জায়গায়।

যতবার জিজ্ঞেস করছি, ''২০০২ সালে কোথায় ভোট দিয়েছিলে?'' বলে, "তুমি তো চেনো, ওই যে তোমার বাড়ির পাশে কিশোরভারতী স্কুলে। ওইখানেই তো ভোট দেই।" এদিকে, নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে ওই নামের কোনও ভোটগ্রহণ কেন্দ্র নেই। মহা মুশকিল! একথা বলায় ইস্টবেঙ্গল অন্ত প্রাণ রিভুদা গেল খেপে। বলল, "আমাগো ইস্টবেঙ্গল হইলেও দাদু-বাবা সবার জন্ম এপারে। কলকাতার আর তোমরা কী দেখলা। সাংবাদিক হইয়া একটা নাম বাইর করতে পার না।" আজব সমস্যা। বোঝাই কী করে! অবশেষে স্থির হল, রাতেই স্কুলের নাম দেখে আসা হবে। তা গেল চিনুদা। ফিরে এসে বলল, ''নাম তো কিশোরভারতীই আছে।'' আমি আর কী করব। ''পরে দেখছি'' বলে ফোন রেখে দিলাম।

মিনিট কুড়ি বাদে ফের ফোন। ওপারে রিভুদা। সুর নরম করে বলল, "কাজলদা কইল, স্কুলটার নাম আগে ছিল ইস্টবাগান প্রাইমারি স্কুল। একবার দেখো তু খুঁইজা।" এবারে, কমিশনের তালিকায় নাম পাওয়া গেল। লিস্ট ডাউনলোড করে রিভুদার মেয়ের মোবাইলে পাঠিয়ে দিলাম। জানাতেই কী খুশি! বলল, "তোমারে সুদর্শনের মোগলাই খাওয়ামু। আসলে তোমার বউদি চিন্তা করতাছিল। তুমি চিনুরটাও বাইর কইরা দাও।" এরপর, একে একে ফরমাশ মোতাবেক আমার প্রায় এক ডজন বয়স্ক বন্ধুদের লিস্ট বের করে দিলাম।

রাতে শুয়ে এসবই ভাবছিলাম। ভোটার লিস্টে বিস্তর বিদেশি রয়েছে, একথা সত্যি। পশ্চিমবঙ্গের জন্য বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ সঙ্গত কারণেই উদ্বেগের কারণ। জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও তাই। শেখ হাসিনার পতনের পর পড়শি দেশে নৈরাজ্য চলছে। জেএমবি, নব্য জেএমবি, আনসারুল্লা বাংলা, ইসলামিক স্টেটের মতো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলো ওঁত পেতে রয়েছে। মুর্শিদাবাদ, মালদা, দিনাজপুর, কোচবিহারের মতো সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে গোয়েন্দাদের নজর রয়েছে। অদূর অতীতে পশ্চিমবঙ্গে অসম পুলিশের 'অপারেশন প্রঘাত'-এ মুর্শিদাবাদ থেকে দুই জঙ্গির গ্রেপ্তারি অশনি সংকেত তো বটেই। সব মিলিয়ে, মনে হয় ঠিকই হচ্ছে। এসআইআর হোক। আবার, রিভুদাদের কথা ভাবলে মনে হয় এত তাড়াহুড়োর কি প্রয়োজন ছিল? ডিজিটাল জগৎ সম্পর্কে এরা কিছুই জানে না। ওয়েবসাইট, পোর্টাল, ওটিপি, এনুমারেশন ফর্ম খায় না মাথায় দেয়, এরা জানে না। এরা শুধু জানে, সরকার কিছু একটা করছে। কাগজ না দিলে বিদেশি বলে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দেবে। সোনালি বিবির খবর সেই আগুনে ঘি ঢেলেছে। 'সেনসেশন' তৈরি করতে গিয়ে এই প্রবীণদের আতঙ্ক আরও বাড়িয়েছে মিডিয়ার একাংশ।

মনে পড়ে, ১৮-১৯ সালে অসমে জাতীয় নাগরিকপঞ্জির (এনআরসি) খসড়া প্রকাশের সময় অফিস পাঠিয়েছিল অ্যাসাইনমেন্টে। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলি আহমেদের পরিবারের নাম বাদ যাওয়ার খবর ব্রেক করলাম। ফ্রন্টপেজ লিড স্টোরি। বস খুব বাহবা দিলেন। সতর্কও করলেন, "সাবধানে কাজ করিস। বেশি ঝুঁকি নিতে হবে না। হাওয়া গরম আছে, মবড হয়ে যাবি।" তা সেই সম্ভাবনাও ছিল। অসম তখন ফুঁসছে। এনআরসির পক্ষে জনসমর্থন প্রবল। আর আমি দেখছি মানুষের জ্বালা-যন্ত্রণা। ভাষা-উন্মাদনায় গণহত্যার দাগ দেখেছি নেলিতে। শিলচরের সেন্ট্রাল জেলে ডিটেনশন সেন্টারে অথর্ব শিবেন পালের (নাম পরিবর্তিত) নিঃস্ব চোখ দেখেছি। বিদেশি ট্রাইবুনালে গোলাঘাটের পরান দাসের গরু, বাসন বেচে লড়াই করার গল্প শুনেছি। কুষ্ঠের মতো বিভু দেবরায়ের (নাম পরিবর্তিত) ডি-ভোটার তকমার জ্বালা দেখেছি। আর একদলের উল্লাস দেখেছি, এবার বাংলাদেশিরা পালাবে। অনুপ্রবেশ মুক্ত হবে ভারত!

আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা অসমে। ছাত্রজীবন কেটেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। কর্মসূত্রে এখন কলকাতায়। বছর পনেরো ধরে এটাই বাড়ি। শক, হুণ, কুষাণ, ইঙ্গ-বঙ্গ সবার মতো এই শহর আমাকেও আপন করে নিয়েছে। বন্ধু দিয়েছে। ধূসর কংক্রিটের জঙ্গলে একটুকরো মাথা গোঁজার ঠাঁই দিয়েছে। অন্নচিন্তা দূর করেছে। রঙিন স্মৃতি দিয়েছে। তাই কষ্ট হয়। একেই বোধ হয় বলে নিয়তির পরিহাস। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জির (এনআরসি) বলে আমি বলীয়ান। আমি ভারতীয়, সেটা বুক বাজিয়ে বলতেই পারি। অথচ যে রিভুদার বাবা-কাকাদের শরীরের ছাই লেগে রয়েছে এশহরের বার্নিং ঘাটে, সে বলছে, "আমারে কাগজ দিবা?..."

(মতামত ব্যক্তিগত, বক্তাদের নাম পরিবর্তিত)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • রিভুদাদের কথা ভাবলে মনে হয় এত তাড়াহুড়োর কি প্রয়োজন ছিল? ডিজিটাল জগৎ সম্পর্কে এরা কিছুই জানে না।
  • ওয়েবসাইট, পোর্টাল, ওটিপি, এনুমারেশন ফর্ম খায় না মাথায় দেয়, এরা জানে না।
  • সোনালি বিবির খবর সেই আগুনে ঘি ঢেলেছে। 'সেনসেশন' তৈরি করতে গিয়ে এই প্রবীণদের আতঙ্ক আরও বাড়িয়েছে মিডিয়ার একাংশ।
Advertisement