যে-মতুয়া সম্প্রদায়ের দাবিতে এই নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা উঠল, সেই মতুয়াদের মধ্যেই নানা সংশয়। প্রশ্ন– নাগরিকত্ব অর্জনের জন্য যদি এই আইনের প্রয়োজন হয়, ভারতের আধার কার্ড যদি নাগরিকত্বের পরিচায়ক না হয়, তাহলে মতুয়া গোষ্ঠীর বিজেপি নেতা শান্তনু ঠাকুর– তিনি কেন্দ্রের মন্ত্রী হয়ে আছেন কী করে? লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।
‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯’। নরেন্দ্র মোদি সরকারের সদ্য গৃহীত এই ক্যাবিনেট সিদ্ধান্ত ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের মুখে ভারতের নানা রাজ্যে তুলকালাম কাণ্ড ঘটাতে শুরু করেছে। অসন্তোষের আগুন বইছে পশ্চিমবঙ্গ, অসম-সহ দক্ষিণ ভারতেরও বেশ কিছু এলাকায়। আইন করে হিন্দু ভোটের এমন মেরুকরণ, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু ভোটের শ্রীবৃদ্ধি ঘটানোর উদ্দেশ্যটি কাউন্টার প্রোডাক্টিভ না হয়ে যায়!
ভোট আসলে বড় বালাই। উগ্র-হিন্দুত্ববাদী সমর্থন আদায় করার জন্য মোদি সরকার এমন একটা কাণ্ড করে বসল যা আদতে শাঁখের করাত। বিজেপি সূত্রে জানতে পারছি, দলের মধ্যেই একটা বড় অংশ এখন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে জর্জরিত। যে-মতুয়া সম্প্রদায়ের দাবিতে এই নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা উঠল, সেই মতুয়াদের মধ্যেই নানা সংশয়। প্রশ্ন, নাগরিকত্ব অর্জনের জন্য যদি এই আইনের প্রয়োজন হয়, ভারতের আধার কার্ড যদি নাগরিকত্বের পরিচায়ক না হয়, তাহলে মতুয়া গোষ্ঠীর বিজেপি নেতা শান্তনু ঠাকুর– তিনি এতদিন ধরে কেন্দ্রের মন্ত্রী হয়ে আছেন কী করে? তিনি নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বাংলাদেশে পর্যন্ত গিয়েছিলেন মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতার জন্মভিটে প্রদর্শনে। সেই শান্তনু ঠাকুর কি তাহলে অ-নাগরিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী? তিনি কি তাহলে এখন নাগরিকত্ব অর্জন করবেন এই আইনের পর? আর সেটা যদি ওঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হয়, তাহলে অন্য মতুয়াদের এই নাগরিকত্ব আইন এখন হঠাৎ করে ২০২৪ সালে প্রয়োজন হল কেন?
[আরও পড়ুন: ‘ছাপরির বউ ছাপরি’, হার্দিকের ‘দুর্দিনে’ নেটিজেনদের কটাক্ষের শিকার স্ত্রী নাতাশা]
‘সিএএ’ প্রণয়ন বিষয়ে কয়েক বছর আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন, ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন’ (সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট) হওয়ার পর আসবে ‘জাতীয় নাগরিকপঞ্জি’ (ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স ওরফে এনআরসি)। তাতে নথিভুক্তকরণই হবে আদতে নাগরিকত্বের জাতীয় নথিভুক্তিকরণ। আর সেটা যখন হবে, তখন যারা হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, খ্রিস্টান শরণার্থী, তারা ভারতে থাকার অনুমতি পাবে; কিন্তু বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান থেকে আসা মুসলমানদের নিজের দেশে ফিরে যেতে হবে। ২০১৯ সালে ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখাও শুরু হয়ে গিয়েছিল অসমে। বাংলাদেশে তখন বিরোধী ও শাসক দল উভয় পক্ষ থেকেই মোদি সরকারের কাছে অভিযোগ আনা হয়। আওয়ামি লিগ যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করে। বিরোধিতা নয়, ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেও তুমুল রাজনৈতিক দর কষাকষিতে নামে তারা। সেই সময়, মোদি সরকার অসমের রাজনীতির প্রেক্ষিতে, সেখানকার বিধানসভা নির্বাচনের আগে এবং পরে
যা-ই বলুক না কেন, নাগরিকত্ব আইন থেকে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়।
তখন কার্ড বিলিয়ে মতুয়াদের নাগরিকত্বের আশ্বাস দেয় বিজেপি। ২০১৯ সালের শেষ দিকে বিজেপি সাংসদ কার্ড বিলি করেন। ২০২১-এ, বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিভিন্ন সভায়, সেই কার্ডকেই তুরুপের তাস হিসাবে বিজেপি ব্যবহার করে। কার্ডের নিচে সাংসদের সইও ছিল। পরিবারের অভিভাবকদের নামে কার্ডটি ইস্যু করা হয়। পরিবারে কতজন সদস্য রয়েছে, সেই সংখ্যা উঠে আসে তাতে। সেই সময় পূর্ব বর্ধমান, নদিয়া, হুগলি, উত্তর ২৪ পরগনা-সহ বিভিন্ন জেলার বহু মতুয়া পরিবারের কাছে সংশ্লিষ্ট কার্ড পৌঁছে দেওয়া হয়। বলা হয়, সেটি থাকলে নাগরিকত্ব পেতে অসুবিধা হবে না। অথচ, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য যে-সমস্ত নথি জমা করতে বলা হয়েছে, তাতে সেই কার্ডের উল্লেখ পর্যন্ত নেই! বিষয়টি প্রকাশে্য আসার পর থেকেই বিজেপির বিরুদ্ধে মতুয়ারা ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে।
[আরও পড়ুন: ভোটের আগে খাস কলকাতা থেকে উদ্ধার ৮২ লাখ টাকার সোনা, গ্রেপ্তার ৫]
কয়েক দিন আগে জামালপুরে তৃণমূলপন্থী মতুয়া নেত্রী মমতাবালা ঠাকুর প্রতিবাদ সভা করে কেন্দ্রীয় সরকারকে তোপ দাগেন। তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাতেও মতুয়াদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। ‘সিএএ’-র বিরুদ্ধে তাদের বক্তব্য– যেভাবে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তু হিন্দুদের বাবা-মা, ঠাকুরদা-ঠাকুমার বার্থ সার্টিফিকেট চাওয়া হচ্ছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। আমরা যদি বার্থ সার্টিফিকেট নিয়েই আসতাম, তাহলে আমরা আর ‘উদ্বাস্তু’ হলাম কেন? উদ্বাস্তু হয়ে আসা মানেই তো প্রবল নিরাপত্তার অভাবে সব ছেড়ে দিয়ে চলে আসা! সেই সময় পাকিস্তানি শাসক দলের অত্যাচারে ওপার ছেড়ে এপারে আসতে বাধ্য হওয়া শরণার্থী সমাজকে আশ্রয় দিয়ে ভারত আন্তর্জাতিক স্তরে প্রভূত সম্মান লাভ করে।
বর্তমানে নরেন্দ্র মোদির এই সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, তেমনই দেশের ভিতরেও নানা প্রশ্ন উঠছে। তবে সব রাজ্যে এই আইন কার্যকর হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে হবে, অসমে হবে। কিন্তু গুজরাতের মুসলমানদের কেন এখনই পাকিস্তানে চলে যেতে বলা হচ্ছে না? কচ্ছের সীমান্তে
থাকা মুসলমান সমাজের জন্য তো কই লোকসভা নির্বাচনের আগে নাগরিকত্ব আইন লাগু হচ্ছে না? তবে কেন শুধু বাঙালিদের ক্ষেত্রে এই কোপ?
সুতরাং, এই নাগরিকত্ব আইনের সঙ্গে কিন্তু বাঙালি-অবাঙালি প্রশ্নটাও ভারতের রাজনীতিতে জড়িয়ে গিয়েছে। আবার কলকাতায় বসবাসকারী মাড়ওয়ারি, গুজরাতি, সিন্ধিরা বলছে– আধার কার্ড যদি নাগরিকত্বের পরিচায়ক না হয়, আমাদেরও তো তাহলে নাগরিক কার্ড দরকার। আমরা বাঙালি নই, কিন্তু কলকাতায় বহু বছর ধরে আছি। আমরা যে মাড়ওয়ারি-ই, ‘অনুপ্রবেশকারী’ নই তা প্রমাণ করব কী করে, যদি আধার কার্ড আমাকে নাগরিকত্ব আইনের অধিকার না দেয়?
[আরও পড়ুন: লোকসভা ভোটে অভিষেকের বিরুদ্ধে পদ্মপ্রার্থী রুদ্রনীল? জল্পনা তুঙ্গে]
এই প্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তঁার বক্তব্য, অনুপ্রবেশ রোধ করার দায়িত্ব তো বিএসএফ-এর। তারা সীমান্তরক্ষী। বিএসএফের নিয়ন্ত্রণ রাজ্যের মধ্যে বেশ কয়েক কিলোমিটার বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা এই অনুপ্রবেশ রোধ করতে পারে। সেখানে কঁাটাতারের বেড়া লাগানো, অনুপ্রবেশ রোধ করার কথা বলা হচ্ছে। তার দায়িত্বে আছেন খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তাহলে তিনি ‘অনুপ্রবেশ’ রোধ করতে পারছেন না, এদিকে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের তাড়িয়ে দিচ্ছেন– এমনটা কেন?
এরকম অসংখ্য সংশয় নিয়ে যখন দেশ উত্তাল, তখন প্রশ্ন উঠছে, এত তাড়াহুড়ো করে ভোটের আগে এই আইন প্রণয়ন না করে, সব দলের নেতাদের সঙ্গে বসে এটা নিয়ে আরও আলাপ-আলোচনার পরিসর রেখে বিভিন্নভাবে একটা ফুলপ্রুফ ম্যানেজমেন্ট করা যেতে পারত না কি? ইতিমধে্যই সুপ্রিম কোর্টে অসংখ্য মামলা দায়ের হয়েছে এই আইনের বিরুদ্ধে। সুপ্রিম কোর্ট স্থগিতাদেশ দেয়নি। তাতে ভোটের আগে হয়তো আরও নৈরাজ্য সৃষ্টি হত। শুনানি হবে এবং তা নিয়ে বিচার-বিবেচনার আশ্বাস সুপ্রিম কোর্ট দিয়েছে। সুতরাং এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কী হবে, তা বোঝা যাবে একমাত্র লোকসভা নির্বাচনের পরই।
ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, মোদি সরকার আবার ক্ষমতায় এলেও এই আইন নিয়ে ‘গো স্লো’ নীতি গ্রহণ করবে। ভোটের পর কিন্তু ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক মোদি সরকারের কাছে অনুপ্রবেশ রোধের থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে– বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বে মদনলাল খুরানা দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি একবার অনুপ্রবেশ রোধে নাটকীয় কাণ্ড করেছিলেন। সেই সময় উত্তরপ্রদেশের সীমান্তে বসবাসকারীদের কেউ বাংলায় কথা বললেই তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে নাপিত দিয়ে চুল কামিয়ে দেওয়া হত ‘বাংলাদেশি’ অনুপ্রবেশকারী হিসাবে চিহ্নিত করে।
দেখা গেল, পশ্চিমবঙ্গের উত্তর প্রান্ত থেকে আসা বাঙালিদেরও ‘বাংলাদেশি’ বলে চিহ্নিত করে ফেরত পাঠানো হচ্ছে, যেমনটা একসময় মহারাষ্ট্রে বাল ঠাকরে করেন। হাওড়া স্টেশনে পাঠিয়ে দিতেন সমস্ত বাংলায় কথা বলা লোকেদের ‘বাংলাদেশি’ দাগিয়ে।
[আরও পড়ুন: আসানসোলে এখনও প্রার্থী দেয়নি বিজেপি, ‘গড়’ রক্ষায় ‘একা কুম্ভ’ জিতেন্দ্র তেওয়ারি]
নরেন্দ্র মোদি ‘প্রতিবেশী প্রথম’– এই বিদেশনীতি নিয়ে এগলেও সিএএ তঁার নীতিকে ধাক্কা দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি থেকে এই নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদ হয়েছে। আমেরিকার প্রতিবাদ সম্পর্কে ভারতের বিদেশমন্ত্রী বলেছেন, ওরা দেশভাগের অর্থ জানে না। কাকে বলে ‘দেশভাগ’, কাকে বলে ‘অনুপ্রবেশ’, আমরা তো জানি। সেই কারণে আমরা এই আইন আনতে বাধ্য হয়েছি। দেশভাগ সম্পর্কে বাঙালি বিস্তর অভিজ্ঞ। বাঙালিকে দু’-দুটো দেশভাগ সামলাতে হয়েছে। ১৯০৫ এবং ১৯৪৭। এখন সেখানে বাঙালিদের সঙ্গে এই ফেডারেল স্ট্রাকচারে আলাপ-আলোচনার পথে না-গিয়ে উপর থেকে একটা স্টিম রোলার দিয়ে নাগরিকত্ব বিল চাপিয়ে দিলে এটাতে লাভের থেকে লোকসান বেশি হয়ে যেতে পারে। যেখানে বাংলাদেশ এই মুহূর্তে ভারতের সবথেকে বড় বন্ধু-প্রতিবেশী রাষ্ট্র।
বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য বিসর্জন করার জন্য যে-আন্দোলন বাংলাদেশে শুরু হয়েছে, সেটা কি ভারতের জন্য খুব সুখকর? কেন্দ্রীয় সরকারের এমন কিছু করা উচিত নয়, যাতে বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে আঘাত না লাগে আবার জামাতের মতো মৌলবাদী শক্তির, যার কড়া সমর্থক বিএনপি, হাত শক্ত হয়ে না যায়। তাহলেই প্রত্যেকের মঙ্গল সাধিত হবে।