১৯৮৩-তে ক্রিকেট মাঠে জয়ের পর যে উল্লাস ছিল, সেই আবেগ আবার ফেরাল মেয়েরা, ২০২৫-এ। দারিদ্র, সমস্যা, প্রতিকূলতা পেরিয়ে যখন সাফল্য আসে, তখন তার স্বাদ আলাদা। আর এইখানেই এই বিশ্বজয়ের বাড়তি তাৎপর্য। এই জয়টা শুধু ক্রিকেটের নয়, এই ভিকট্রি ল্যাপ জীবনপথের দৌড়। পথের বাঁকে সিজন টু কুণাল ঘোষ।
মহিলা ক্রিকেটের ফাইনালের শেষ মুহূর্ত। ভারতের মহিলা টিম বিশ্বজয়ী। ক্যাচটি ধরে এক ভারতকন্যার বাঁধভাঙা আবেগের দৌড়। ওই দৌড় শুধু তাঁর একার নয়, শুধু ভারতের মহিলা টিমের নয়, শুধু ক্রিকেটেরও নয়। ওই মুহূর্তেই ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম, আর অর্ধেক আকাশ নয়, পুরো আকাশ জুড়ে।
সোনার মেয়েগুলো সময়ের চালচিত্রে বিদ্রোহের ছবি এঁকে দিল, আত্মবিশ্বাসের পতাকা ওড়াল, আর অনেক কূপমণ্ডূকতার প্রশ্নের জবাব দিল। আসলে, শেষ ক্যাচ ধরে নীলকন্যার দৌড়টা ছিল কোনিদের দৌড়। সব ‘কোনি’, যারা দেশের নানা প্রান্তে, নানা শাখায়, নানা কাজে, পাহাড় ভাঙার গান গায়, অনেকে পরিস্থিতির চাপে হেরে যায়, অনেকে হারিয়ে যায়, তারা অনেক দূর থেকে দেখে রূপকথার মঞ্চে পৌঁছে যাওয়া অন্য কোনও ‘কোনি’-কে। কিংবা কল্পকথার সিন্ডারেলাকে। তখন ওই কোনির দৌড় দেখে হয়তো একবার বুকভরা শ্বাস নেয়, চোখের কোণের জল মোছে।
শাহরুখ খানের ‘চক দে ইন্ডিয়া’-র বিষয় হয়তো হকি; কিন্তু ক্রিকেটেও গল্পটা একই। বিশ্বজয়ী টিমের এক-একটি কন্যের কাহিনি সামনে আসছে, অধিকাংশই একই চিত্রনাট্য। দারিদ্র, সমস্যা, প্রতিকূলতা। তার চেয়েও বড় কথা, পরিবারের জ্ঞাতিগুষ্টি থেকে গ্রামবাসী, পাড়াপড়শির বিষনজর– মেয়ে খেলবে কেন? মেয়ে পড়বে, নাচবে, গাইবে, রান্না শিখবে, ঘরের কাজ শিখবে। কিন্তু ছেলেদের মতো, বা ছেলেদের সঙ্গে, খেলবে কেন? আমি নিশ্চিত, আজ বিশ্বজয়ী ১১ জনকে হয়তো দেখছি। কিন্তু এই চঁাদের পাহাড়ে ওঠার পথে হয়তো হারিয়ে গিয়েছে, থেমে গিয়েছে ১১ হাজার। সাফল্য এসে গেলে মাতামাতি, জয়ধ্বনি; কিন্তু তার আগের রাস্তাটা বড় কঠিন, বিশেষভাবে ভারতীয় সমাজে মেয়েদের জন্য। ভারতের অধিনায়ক হরমনপ্রীত কৌরের বাবা হরমন্দর সিং ভুল্লারের সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। বলছিলেন, ‘গ্রামের কথাও পাত্তা দিইনি। কিন্তু পরিবার? পরিবারের অনেক সদস্য বলত– আমরা নাকি মেয়েটাকে ঠিকমতো মানুষ করতে পারছি না। এখন রান্না না-শেখালে ওর বিয়ে হবে না। আজ দেখুন,
একটা সময় যারা ওর খেলা বন্ধ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল, তারা-ই এখন ফোন করে বোঝাতে চাইছে আমার মেয়ের জন্য ওরা কত গর্বিত!’
এই একই গল্প কার্যত সব বিশ্বজয়ীর পরিবারে। কপাল ভাল, এঁরা কিছু অন্যরকম বাবা-মা’কে পেয়েছেন। পেয়েছেন আঞ্চলিক স্তরে কিছু কোচ বা ক্রিকেটকর্তাকে, যঁারা পরম যত্নে এই চারাগাছগুলিকে বাড়তে দিয়েছেন। একজন তারকার পরিবার আর্থিক প্রতিকূলতায় জীর্ণ, ক্রিকেটীয় জুতো কেনারও ক্ষমতা নেই, এক খেলাপাগল কোচ কিট্স কিনে দিয়েছেন। অন্ধকারে এই আলোকবিন্দুর মতো মুখগুলো এসেছে, থেকেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে, কুস্তির ফোগট পরিবার থেকে শিলিগুড়ির ঘোষ পরিবার, খেলার মানুষ বাবা তাঁর স্বপ্নটা মেয়ের মধ্যে সঞ্চারিত করে তা পূরণে সর্বশক্তিতে সাহায্য করেছেন।
আবার এখানেই রয়েছে ‘কোনি’-র ক্ষিদ্দা বা ‘চক দে ইন্ডিয়া’-র কবীর খান বা এখনকার বিশ্বজয়ী কোচ অমল মজুমদারের মাহাত্ম্য। এঁরা শুধু কোচ নন, অভিভাবক। অমল এক সময় দেশের সেরা প্রতিশ্রুতিবানদের তালিকার উপর দিকে ছিলেন। রমাকান্ত আচরেকরের আর-এক শিষ্য। শচীনদের সঙ্গে উচ্চারিত হত নাম। কিন্তু শচীন, সৌরভ, রাহুলদের দুরন্ত যুগ তখন। অমল আর ভারতের প্রথম ১১-য় আসতে পারেননি। ঠিক যেমন বেদি, চন্দ্র, প্রসন্ন, ভেঙ্কটের জন্য টেস্ট ক্যাপ পাননি রাজিন্দর গোয়েল বা পদ্মাকর শিভলকর। অমলের জীবনে যন্ত্রণা ছিল না? ছিল। অমলের বুকে আগুন জ্বলেনি? জ্বলেছে। দীর্ঘ অপেক্ষায় অবসাদ গ্রাস করেনি? হয়তো তাও করেছে। কিন্তু সেই উপাদানগুলো মিশে তৈরি তাগিদেই আজ নিজের আগুন সংক্রমিত করেছেন এই মেয়েদের মধ্যে, টিমটা গড়েছেন দেবীমূর্তি নির্মাণের আন্তরিক ভক্তি নিয়ে।
বিভিন্ন পেশায় মহিলাদের দক্ষতা, সাফল্য প্রশ্নাতীত। দেশের মহিলা রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী আমরা পেয়েছি। ভারতীয় বংশোদ্ভূত মহিলা মহাকাশচারী পেয়েছি। বিমানচালক, যুদ্ধবিমানচালক, বিচারপতি, চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়র, সেনা, পুলিশ, মন্ত্রী, আমলা, শিক্ষক, বিজ্ঞানী, গবেষক, সাংবাদিক, ব্যাঙ্ককর্ত্রী, অভিনয়শিল্পী, গায়িকা, পরিচালক, সাহিত্যিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজসংস্কারক, শিল্পপতি, ক্রীড়াপ্রশাসক, আইটি কর্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক, পুরমাতা, পঞ্চায়েতপ্রধান থেকে শুরু করে বিভিন্ন চাকরি, সংগঠন, ব্যবসায় মহিলারা আছেন, বহু জায়গায় তঁারা নেতৃত্ব দেন। অনেকে নিজেই তারকা, ‘ব্র্যান্ড’ হয়ে ওঠেন। এমনকী, জঙ্গিবাহিনীতেও। খেলার জগতের নানা শাখায় আমরা বহু প্রতিষ্ঠিত নারীতারকা পেয়েছি। এই সামাজিক কাঠামোয় মহিলাদের অনেক সমস্যা নিয়ে দৌড় শুরু করতে হয়, কারণ পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো। ফলে তঁাদের লড়াই এবং সাফল্যের তাৎপর্য বাড়তি। তঁাদের লড়তে হয় পারিবারিক ব্যবস্থা, স্থানীয় পরিবেশ, দারিদ্র এবং সবচেয়ে বড় কথা এক রক্ষণশীল মনোভাবের ছায়ার সঙ্গে। যে-সমাজ এককালে সতীদাহ প্রথা সগর্বে উদ্যাপন করত, সেই সমাজ শরীর-মন থেকে সবটুকু কালি ধুয়ে ফেলতে পারেনি। সামাজিক বা পারিবারিক সম্পর্ক বা দায়িত্বের গণ্ডির বাইরে একটি মেয়ে যে নিজের মতো কাজের জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবে, সেই পথ মসৃণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নয়। অনেকে চেষ্টা করে পারেন না। অনেকে আবার চেষ্টা করার সাহস, সুযোগটাই পান না। ‘খেলা হবে’ স্লোগানটা দেবেন কী করে, খেলার মাঠ পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই তো পায়ে হাজার শৃঙ্খল। এই যে যুগযুগান্ত ধরে চাপ, হাজার বাধা– এসব অতিক্রম করে যখন সাফল্য আসে, তখন তার স্বাদ আলাদা। আর এইখানেই এই বিশ্বজয়ের বাড়তি তাৎপর্য। এই জয়টা শুধু ক্রিকেটের নয়, এই ভিকট্রি ল্যাপ জীবনপথের দৌড়। যে ১১ জন দৌড়চ্ছে, তাদের কঁাধে চেপে আনন্দে আত্মহারা অদৃশ্য কয়েক কোটি।
দুর্ভাগ্য, যে-ভারত মহিলা ক্রিকেটে বিশ্বজয় করে, সেই ভারতের বহু প্রান্তে এখনও ধর্ষণ, ধর্ষণ করে খুন, বধূহত্যা, নারীসংক্রান্ত অপরাধ ঘটে চলেছে। এবং সেই পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক। কিছু মহিলাও যে অপরাধ বা অনৈতিক কাজে যুক্ত, না হলে বধূহত্যায় শাশুড়ি-ননদ দোষী হয় কী করে, সেই অপ্রিয় প্রসঙ্গ এখনকার লেখায় আনছি না। বহু ক্ষেত্রে মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু, সবসময় ‘মেয়ে বনাম ছেলে’ ধরা ঠিক নয়; তবু, ভারতের নানা প্রান্তে সামাজিক কাঠামোর যা ছবি– এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে জাতীয় দলের খেলোয়াড় হিসাবে উঠে এসে বিশ্বজয় করা সত্যিই স্বপ্নের যাত্রা।
নারী সৃষ্টির ধারক, বহু ক্ষেত্রে নারীর হাতেই ধ্বংসের বা পরিবর্তনের কারণের লাগাম। বনলতা সেনরা যদি থেকে যান চিরকালীন সাহিত্যের শিরাধমনীতে; সীতা কিংবা দ্রৌপদী হয়ে থাকেন মহাকাব্যের ভরকেন্দ্র মহানায়িকা। পুরাণ থেকে এসে মা দুর্গা, মা কালীরা যেমন পরম আরাধ্যা; বিদেশ থেকে এসে তেমনই পরম শ্রদ্ধেয়া সিস্টার নিবেদিতা, মাদার টেরিজা। আবার ঘরের মেয়েদের সাফল্য, পরিচিতি, প্রতিষ্ঠার তালিকাও দীর্ঘ। পুরুষ অসম্পূর্ণ নারী ছাড়া। সম্পর্ক, উৎসাহ, অনুপ্রেরণায়। তবু, এই সমাজে একজন বালকের থেকে পিছিয়ে থেকে দৌড় শুরু করতে হয় একজন বালিকাকে। জন্মমুহূর্ত থেকে যে বৈষম্যের শুরু, দুর্ভাগ্য, সেটা এখনও অব্যাহত। এ এক জটিল ঘূর্ণাবর্ত। সচেতনতা বেড়েছে, সরকারি উদ্যোগ বেড়েছে, তবু সমাজের অলিতেগলিতে স্বতঃস্ফূর্ত সমানুপাত এল কই?
সে কারণেই মেয়েদের পাহাড় ভাঙার গানের আনন্দ খেলার মাঠের বাউন্ডারি লাইন অতিক্রম করে জীবনের মঞ্চে পৌঁছে যায়। আমাদের এই মেয়েগুলো কাপ জিতে যে উল্লাস করছে, ওরা কি বিপক্ষ টিমগুলোকে জবাব দিচ্ছে? না, লিখে রাখুন, ওদের ওই চিৎকার, আবেগাশ্রু জবাব দিচ্ছে ওদের সেসব আত্মীয়, পাড়াপড়শি, পরিচিতকে, যারা ওদের খেলার প্রতিভাকে অপমান করেছে, নষ্ট করতে চেয়েছে, দাবিয়ে রেখেছে। ওই প্রতিটা মুখ আর মুহূর্ত ওদের মনে আছে। জবাবটা ওরা তাদেরই দিল।
১৯৮৩, ১৬ জুন। লর্ডসে লড়ছিল টিম ইন্ডিয়া। সামনে লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ওই ভয়ংকর পেস ব্যাটারি আর ব্যাটিং লাইন আপ। বিঘ্নিত টিভি সম্প্রচারে সাদা-কালো ছবি। সম্প্রচার বিঘ্নিত হলেই মহম্মদ রফির গান। তখন রেডিও ভরসা। তার মধ্যেও সেদিন যেভাবে গোটা দেশ, গোটা বিশ্বের ভারতীয়দের মন ছিল ক্রিকেট মাঠে, জয়ের পর যে উল্লাস;
সেই আবেগ আবার ফেরাল মেয়েরা, ২০২৫-এ, আবার সেই বাঁধভাঙা আনন্দের উদ্যাপন। ১৯৮৩-তে ছিল শুধু ক্রিকেটের জয়। আর এবার, এক বৃহত্তর জীবনের মাঠে জবাবি জয়ও। আসলে নাম, যশ, অর্থ, নেশা, শখ, আগ্রহজনিত জেদ আর অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, কোণঠাসা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই; এগুলো আলাদা, অথচ কখনও কখনও একে-অপরের পরিপূরক।
একটা জায়গায় শুধু বিভ্রান্তি থেকে গেল। এই মহিলাদের বিশ্বজয়ে টিভি চ্যানেলে আধুনিক প্রযুক্তির সম্প্রচার, মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড়। অভিজাত ক্লাবে উল্লাস। চায়ের দোকানে হইচই। মধ্যবিত্ত পরিবারের কিশোরী-মনে তুফান। বালিকা বিদ্যালয় বা মহিলা কলেজে চর্চা। এটা স্বাভাবিক এবং ভাল (যদিও এই জয়জনিত ইভেন্টের আগে-পরে মহিলারাও ক’জন মহিলা ক্রিকেটের খোঁজ রাখবেন, গ্যারান্টি নেই। যেমন– জঙ্গল মহলের রক্তাক্ত ইতিহাসকে অতীত করে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে নতুন জঙ্গল মহলে আদিবাসী কন্যারা ‘কন্যাশ্রী’ কাপে উচ্ছ্বাসের ঝড় তুললেও তা শহুরে মধ্যবিত্ত মহিলা বা উচ্চবিত্ত লেডিজ ক্লাবে এখনও আলোচ্য হয়ে উঠতে পারল না)। তবু, এবারের বিশ্বজয়জনিত যা প্রচার, কভারেজ, সেটার মধ্যেও ইতিবাচকতা খুঁজে নেওয়াই ভাল। মহিলা টিমের আমরা সেভাবে খোঁজখবর রাখিনি, উপেক্ষায় বেড়ে উঠেছেন ওঁরা, সেটা আলাদা কথা। কিন্তু সাফল্যের শীর্ষে ওঠার অনুরণন তো সমাজের শাখাপ্রশাখায় পৌঁছচ্ছে।
কিন্তু নির্মীয়মাণ বহুতলের কাজে ওপাশে এক অবোধ শিশুর হাতে রুটির টুকরো ধরিয়ে যে-অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটি মাথায় ছ’টা ইট নিয়ে হঁাটছে; কিংবা খনির পাহাড়ে দূষণক্লান্ত যে-মেয়েটি পাথর ভাঙছে দিনমজুরির জন্য; কিংবা জঙ্গলমহলে পেট চালানোর জন্য পাতাকুড়োতে ঢুকে মহাজনের কুগ্রাসে হারিয়ে যাচ্ছে যে-তরুণী কিংবা দু’-মুঠো খাবারের জন্য ভিনরাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজে গিয়ে আচমকা লকডাউনে দিশাহারা অবস্থায় মাইলের-পর-মাইল হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে অসুস্থতা, খিদে, ক্লান্তিতে রাস্তায় মারা যায় যে জামলো মাকদমরা কিংবা সুন্দরবনের গভীরে জঙ্গলময় খালে চিংড়ি বা কঁাকড়া ধরে গিয়ে স্বামীকে বাঘে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরেও বাচ্চাদের মুখ চেয়ে যে-মহিলাকে একই কাজে আবার ওই বাঘের জঙ্গলের খাঁড়িতে যেতে হচ্ছে– এরা কি জানে ভারত মহিলা ক্রিকেটে বিশ্বজয়ী হয়েছে?
