বিদিশা চট্টোপাধ্যায়: সম্পর্ক বিষয়টা অত সহজ কিংবা সাদা-কালো নয়। স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা, ভাই-বোন, শাশুড়ি-বউমা, দেওর-বউদি, দুই বন্ধু হোক বা কলিগ- প্রতিটা সম্পর্কের সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়া মানেই ফুরিয়ে যাওয়া নয়। কারণ সম্পর্কের সংজ্ঞা যাই হোক না কেন, সেটা পেরিয়েও কোথাও কোথাও বন্ধুত্ব, মায়া, স্নেহের রেশ থেকেই যায়। আবার সম্পর্কে পাশাপাশি থাকা মানেই একসঙ্গে থাকা নয়। কারণ সেখানে বন্ধুত্ব, শ্রদ্ধা নেই। তাই কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত ‘অর্ধাঙ্গিনী’-র প্রেক্ষাপট কিন্তু কেবলই প্রাক্তন এবং বর্তমানের মুখোমুখি বসার আয়োজন বলে মনে হয়নি। চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়, জয়া আহসান, কৌশিক সেন, লিলি চক্রবর্তী, অম্বরীশ ভট্টাচার্য অভিনীত এই ছবিতে আমরা দেখি, প্রফেসর সুমন চট্টোপাধ্যায় (কৌশিক) অসুস্থ হলে তাঁর বর্তমান স্ত্রী মেঘনা মুস্তাফি (জয়া), প্রাক্তন স্ত্রী শুভ্রার (চূর্ণী) দ্বারস্থ হতে বাধ্য হন। ফলে একের পর এক অস্বস্তিদায়ক মুহূর্তের চেন রিঅ্যাকশন, পরমাণু বিস্ফোরণের মতো হয়ে চলে। সিনেমায় চরিত্রদের মতো দর্শকও কখনওই স্বস্তি পায় না এক মুহূর্তের জন্যও। আগু-পিছু করে নানা মুহূর্ত, নানা তথ্য আমরা জানতে পারি। সুমন আর শুভ্রার দাম্পত্যের ভাঙনের কারণ, সুমন আর মেঘনার কাছাকাছি আসার প্রেক্ষাপট। বাংলাদেশ থেকে আসা মেঘনার নিরুপায় হয়ে শুভ্রার কাছে আত্মসমর্পণ করা, মেঘনাকে দেখে শুভ্রার পুরনো আঘাতে নতুন করে রক্তক্ষরণ হওয়া- এই সব কিছুই গোটা ছবি জুড়ে ক্রমাগত এক দম বন্ধ করা পরিবেশ তৈরি করে।
কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অর্ধাঙ্গিনী’ খুব ব্যক্তিগত ছবি বলে আমার মনে হয়। ব্যক্তিগত সম্পর্ককে একেবারে আতসকাচের মধ্যে দিয়ে দেখা। ছবির সংলাপ এবং অভিনয়ও তেমনই। শুভ্রা এবং মেঘনার কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই ছবি। তাদের মধ্যেকার বাক্যবাণ, তাদের মধ্যে যা কিছু ভাগ করে নেওয়ার, তা সে স্পেস হোক বা ইমোশন সেটাই এই ছবির ভরকেন্দ্র। তবে দর্শক হিসাবে আমার কাছে এই ছবি সবচেয়ে প্রভাব ফেলে সেই সব নীরব মুহূর্তে যেখানে আর কথা বলাও যায় না। যেমন ছবির শুরুতেই দেখি কান্না শুকিয়ে যাওয়া, ফোলা চোখে একটাও কথা না বলে প্রচণ্ড তৎপর হয়ে শুভ্রার ব্যাগ গোছানো, চলে যাওয়ার আগে শাশুড়ি মায়ের কাছে এসে একদণ্ড দাঁড়ানো, চেয়েও মেঘনার কৃতজ্ঞতা না জানাতে পারা। সেদিন সন্ধেবেলা যাওয়ার আগে মেঘনা হয়তো জড়িয়েই ধরত শুভ্রাকে, কিন্তু শুভ্রা হাত গুটিয়ে ডিফেন্সিভ হয়ে যায় এবং দু’জনের মধ্যে তৈরি হয় নীরব দূরত্ব। কিংবা শেষ দৃশ্যে মেঘনার ঘুরে তাকিয়ে তারপর মুখ ফিরিয়ে নেওয়াতে অস্বস্তি, স্বার্থপরতা না তাচ্ছিল্য- ঠিক কী ছিল বোঝা যায় না। এই যে বোঝা ঝায় না সেটাই এই দৃশ্যকে সিনেমা নয় সত্যি করে তোলে।
[আরও পড়ুন: ‘রাজনীতি’র রঙ্গমঞ্চে কৌশিকের কেরামতি, দুর্ধর্ষ দিতিপ্রিয়া]
সম্পর্কের শিকড় আসলে অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। তাই বোধহয় শুভ্রা ‘তুমি’, থেকে ‘তুই’ বলে ফেলে মেঘনাকে। সুমনের টক্সিক দিকটা তুলে ধরে মেঘনার কাছে। শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আসার পরও শাশুড়ি সম্পর্কে বলে, এমন শক্তিশালী মহিলা কম আছেন! দেওর আর মেজ বউদির সম্পর্ক ভাঙে না কখনওই। আবার দেওর আর নতুন বউদির সম্পর্কে, দেওরকে অনায়াসেই ‘ভাইয়া’ বলে ডাকতে পারে মেঘনা। ‘অর্ধাঙ্গিনী’ দেখতে দেখতে বারবার এটাই মনে হয় সম্পর্ক আসলে টিকে থাকে বন্ধুত্ব আর পারস্পরিক শ্রদ্ধায়। বন্ধুত্ব না থাকলে সব সম্পর্কই কম্প্রোমাইজ, বোঝাপড়া, ট্রানজ্যাকশন। যেমন স্বামীর টক্সিসিটি শুভ্রা মেনে নেয়নি। ক্রমাগত অপমান সইতে সইতে পারস্পরিক শ্রদ্ধাও চলে যায় তাদের মধ্যে। কিন্তু এই সম্পর্ক ঘিরে বাকি মানুষগুলোর প্রতি যে স্নেহ, টান সেইসব থেকেই যায়। অপরিচিত মেঘনাকেও একেবারে ফেলে দিতে পারে না শুভ্রা। ছবির নাম ‘অর্ধাঙ্গিনী’ ঠিকই, কিন্তু আমার কাছে ছবিতে ওই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে অন্যান্য বাকি সম্পর্কগুলো। বলে রাখা ভাল, পরিচালক খুব সূক্ষ্মভাবে বৈবাহিক সম্পর্কে টক্সিক হাজব্যান্ডদের চারিত্রিক গঠন নিয়ে সূক্ষ্ম কমেন্টারি রেখেছেন।
চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায় বোধহয় তাঁর জীবনের সেরা অভিনয়টা করেছেন। আসলে তাঁকে যেভাবে এমনি কথা বলতে দেখেছি, পর্দাতেও সেটাই দেখলাম। চূর্ণী শুধু বিহেভ করেছেন। এবং সেটা এতটাই পাওয়ারফুল যে দম বন্ধ লাগে। এই ছবির অনেকটাই তাঁর দিকে ঝুঁকে। জয়া আহসানের কাজটা আরও অনেক কঠিন ছিল। হাততালি দেওয়া সংলাপ তাঁর জন্য বরাদ্দ নেই সংগত কারণেই। নাহলে আপাত দৃষ্টিতে নরম এবং ভালনারেবল স্বভাবের মেঘনার বিপরীতে দৃঢ় এবং সংযত শুভ্রার চারিত্রিক কনট্রাস্ট তৈরি করা যেত না। অচেনা শহরে নিরুপায়, অসহায়, মেঘনা যাকে দাঁতে দাঁত চেপে সবটা সহ্য করে যেতে হবে- মুখের মধ্যে সারল্য ফুটিয়ে সেই অভিনয়ে জয়া দুর্দান্ত। কৌশিক সেনকে দারুণ মানিয়েছে বাঙালি টক্সিক প্রফেসারের চরিত্রে। ভাল লাগে অম্বরীশ ভট্টাচার্য, লিলি চক্রবর্তী এবং গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্সে দামিনী বেণী বসুকে। অনুপম রায়ের সুরে গানই বোধহয় একটু রিলিফের ছোঁয়া দেয়। নিঃসন্দেহে এই ছবি আমার কাছে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত প্রিয় ছবির একটি হয়ে থাকবে। কারণ অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে সম্পর্কের নানান জটিলতা, অনুভুতির রামধনু তিনি এই ছবিতে ফুটিয়ে তুলেছেন।
[আরও পড়ুন: অভিনয়ে ভিকিকে টেক্কা সারার, মন ভাল করা ছবি ‘জরা হাটকে জরা বাঁচকে’, পড়ুন রিভিউ]
সিনেমা: অর্ধাঙ্গিনী
পরিচালনা : কৌশিক গঙ্গোপাধ্যয়
অভিনয়: চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়, জয়া আহসান, কৌশিক সেন, অম্বরীশ ভট্টাচার্য, লিলি চক্রবর্তী, দামিনী বেণী বসু