চারুবাক: বছর সাত আগে “বাবার নাম গান্ধীজি” নিয়ে পাভেল নামের যে তরুণ সম্ভাবনার আলো দেখিয়েছিল, মাঝের কটা বছর ‘অসুর’ ছবি এবং ‘রসগোল্লা’ ছবিতে কিছুটা খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন পাভেল। তবে পাভেল বুঝি ফের নিজের ছেড়ে আসা জায়গায় ফিরতে চাইলেন নতুন ছবি “কলকাতা চলন্তিকা” (Kolkata Chalantika ) দিয়ে। তাঁর এই ছবির ফ্রেম থেকে ফ্রেমে, বিভিন্ন চরিত্রের গঠন ও বিন্যাসে, পরিবেশ গঠনের মুনিসিয়ানা দিয়ে পাভেল বুঝিয়ে দিয়েছে – খুব গম্ভীর না হয়েও চলমান জীবনের টুকরো টুকরো কোলাজে জীবনকে আঁকা যায়। যে অঙ্কন থেকে স্পষ্ট হয় একজন শিল্পীর দায় ও দার্শনিক মন।
শহরের বিভিন্ন প্রান্তে, অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা নানা শ্রেণীর মানুষ মানুষের জীবন-যাপনের এক সুন্দর দলিল পাভেল সুব্রত মল্লিকের ক্যামেরা নিয়ে তুলে এনেছে। যে দলিলে পার্টি ও সরকারের সমালোচনা আছে, বস্তি জীবনের সৌন্দর্য রয়েছে, আবার ধনী বাড়ির ফাঁপা চেহারাটাও বেরিয়ে পড়ে। গল্পের তেমন কোনও চলতি ন্যারেটিভ নেই, কিছু কিছু ঘটনার চিত্রণ মাত্র এই ছবি। সেই ঘটনার মধ্যে বসতিবাসী সৌরভ দাস, ঈশা সাহা রয়েছে, তেমনি রয়েছে শতাব্দী চক্রবর্তীর মত এথিক্স বিক্রি করে বড়লোক হওয়া পরিবার, আবার অনামিকা সাহার মতো সোনাগাছিতে শরীর বিক্রি করা এক বয়স্কা মহিলা, বংকা (খরাজ) নামের এক পার্টিকর্মী, এক দুর্ঘটনায় সব হারানো একা অধ্যাপক শিবাজী (অনির্বাণ), আই টি কর্মী দিতিপ্রিয়ার সঙ্গে মোটর সাইক্লিস্ট কবি পাভেলদের নিয়ে ছবির প্রথমার্ধে বেশ হালকা মেজাজে ছেঁড়া ছেঁড়া গল্প সাজিয়েছেন পাভেল। উত্তর কলকাতার গণেশ টকিজের কাছে পোস্তা ফ্লাইওভার ভেঙে পড়ার দুর্ঘটনার পর দ্বিতীয়ার্ধে ছবি হালকা মেজাজ একটু গম্ভীর হয়ে যায়।
[আরও পড়ুন: কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের মাস্টারস্ট্রোক, ‘লক্ষ্মী ছেলে’র মতো ছবি গত ৫ বছরে তৈরি হয়নি ]
ছবির এই পর্যায় থেকেই শুরু হয় একজন মানবিক মানুষের এবং পরিচালকের কাজ। পাভেল বেশ সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলেন বিভিন্ন চরিত্রের সমস্যা। সেই সমাধানের মধ্যেও থাকে জীবনবোধের এক বার্তা। পার্টি সমর্থককেও একসময় বলতে হয়েছে ” আমি একজন মানুষ হিসেবে সম্মান ফিরে পেতে চাই, পার্টির লেজুড় হব না আর।” দিতিপ্রিয়া ফিরে পায় তার হারানো প্রেমিককে, রিমি (শতাব্দী) আর দুনম্বরি কাজ করবে না জানিয়ে চড় মারে বসকে, সৌরভ-ঈশা খুঁজে পায় মাথার ছাদ নিমতলার বসতিতে। হ্যাঁ, এই ঘটনাগুলো সবই হয়তো ইচ্ছাপূরণের মতো লাগবে, কিন্তু একজন মানবিক শিল্পীর কাজটাই তো তাই। পাভেল যা করেছে, দেখিয়েছে সেটা সিনেম্যাটিক লাইসেন্স নেওয়ার মতো লাগতে পারে, কিন্তু সেটাই একজন সংবেদনশীল শিল্পীর কর্তব্য।
ছবির পরিচালনা শৈলীর সঙ্গে সুন্দর সঙ্গত করেছে বেশ কয়েকটি গান (লেখা: পাভেল, সুর: রনজয় ভট্টাচার্য)। থিম সং হিসেবে “গীতবিতানের দিব্যি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি”, ছাড়াও “তুমি ভাদুয়া গাইলে, আমি একতারা হব” বা “তোর ঘুমপাড়ানি গান”গুলো ছবির চলন, চরিত্রের সঙ্গে একেবারে মিলে মিশে যায়।
অভিনয়ও প্রত্যেক শিল্পী নিজের সেরাটা দিয়েছেন। বিশেষ করে হাবাগোবা দাদার ভূমিকায় রজতাভ দত্ত, পুলিশবোনের চরিত্রে অপরাজিতা আঢ্য নজর কেড়ে নেন। তাছাড়া সৌরভ, ঈশা, দিতিপ্রিয়া, খরাজ, অনির্বাণ চক্রবর্তী এবং নতুন মুখ শতাব্দী চক্রবর্তীও বেশ দাপিয়ে কাজ করেছেন।