বিশ্বদীপ দে: ‘উইথ গ্রেট পাওয়ার কামস গ্রেট রেসপন্সিবিলিটি।’ শঙ্খ ঘোষের বিখ্যাত পঙক্তি ধার করে বলা যায় ‘একথা খুব সহজ, কিন্তু কে না জানে সহজ কথা ঠিক ততটা সহজ নয়।’ গত শতকের ছয়ের দশকে মার্কিন ‘ম্যান’ সংস্কৃতির নব্য প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভাবেই ঝড় তুলে দিয়েছিল স্পাইডারম্যান। কমিক্স থেকে অ্যানিমেশন হয়ে চলচ্চিত্র— পরবর্তী কয়েক দশকে নানা মাধ্যমে তার বারবার বক্স অফিসে ছক্কা হাঁকানো প্রমাণ করে দেয় মাকড়সা-মানুষের প্রতি ভালবাসা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে দিব্যি বয়ে চলেছে।
এর পিছনে কেবলই তার অতিমানবীয় উড়ান, জাল বোনা কিংবা দুর্ধর্ষ সব ভিলেনদের সঙ্গে সংঘাতই একমাত্র ফ্যাক্টর নয়। রয়েছে ক্ষমতার সঙ্গে কর্তব্যের এক দ্বিঘাত সমীকরণও। যে জননায়ক, তার দায়িত্ব হল বিশ্বকে রক্ষা করা। সেটাই তার মূল ফোকাস। আর তা করতে গিয়ে আপনজনের মৃত্যু হলেও থমকে গেলে চলবে না। ‘স্পাইডার-ম্যান: অ্যাক্রস দ্য স্পাইডার-ভার্স’ (Spider-Man: Across the Spider-Verse) ছবিতে সংলাপটা নেই। কিন্তু এই সংকটটা আছে। এ ছবিতে ‘হাজার হাজার’ স্পাইডারম্যানের ভিড়ে মাইলস মোরালেসই প্রোটাগনিস্ট। সে এমন এক স্পাইডারম্যান, যার অতিমানব হওয়াটাই সন্দেহজনক মনে হয় স্পাইডারম্যানদের (Spider-Man) পান্ডা মিগুয়েল ও’হারার (যার আরেক নাম স্পাইডারম্যান ২০৯৯)! কারণ সে স্পাইডারম্যানদের ‘প্যাটার্ন’কেই বুঝি ভেঙে দিতে চায়। কেমন প্যাটার্ন, কী চায় মাইলস সেটা জানালে স্পয়লার হয়ে যাবে। তাই সেটা উহ্যই থাক। এটুকু বলা যায়, ছবির প্রধান ভিলেন ‘স্পট’ নয়, এখানে স্পাইডারম্যানের আসল লড়াই স্পাইডারম্যানের বিরুদ্ধেই!
‘স্পাইডার-ম্যান: ইনটু দ্য স্পাইডার-ভার্স’ ছবিটিতে দর্শকের সঙ্গে প্রথম পরিচয় মাইলসের। বছর পাঁচেক পরে নতুন ছবিতে এসে ছবির গল্প আরও বহু দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। তবে তা সত্ত্বেও গল্পের সুতোটা কখনও আলগা হয় না। দুর্ধর্ষ আবহসংগীত, চোখধাঁধানো দৃশ্যাবলি নিঃসন্দেহে এই ছবির অন্যতম আকর্ষণ। কিন্তু আসল নায়ক শেষ পর্যন্ত গল্প। আমাদের জীবন যে এক অনন্ত সম্ভাবনার খেলা, নানা ডায়ামেনশনের বৈচিত্রে সেটাই বারবার ফুটে ওঠে। ছবির একেবারে শেষের চমকও সেখান থেকেই উঠে আসে। মার্ভেল (Marvel Cinematic Universe) ভক্তদের তো বটেই, এই ছবি সকলকেই ভাবনার রশদ জোগায়। গল্পের বিটুইন দ্য লাইনসে যা আছে তা বিনোদনের ছাঁকনি পেরিয়েও মনে থেকে যায়।
[আরও পড়ুন: ফিরল জ্যোতির্ময় দে খুনের স্মৃতি, ‘স্কুপ’ সিরিজে নজর কাড়লেন করিশ্মা-প্রসেনজিৎ]
এই ছবির প্রধান চরিত্র মাইলস হলেও খুবই কাছাকাছি থাকে গোয়েন স্টেসিও। আগের ছবিতেও ছিল সে। খুব ভাল লাগে তাকে। আমাদের চেনা পৃথিবী নয়, অন্য এক ব্রহ্মাণ্ডে ‘আর্থ-৬৫’ নামের এক গ্রহে সে থাকে। তার বাবাও মাইলসের বাবার মতো পুলিশ অফিসার। তিনি জানেন না তাঁর কন্যাই স্পাইডার উওম্যান। নিতান্তই দুর্ঘটনাবশত গোয়েন তার প্রিয় বন্ধু পিটার পার্কারকে মেরে ফেলেছিল। সেই থেকে তার পুলিশ বাবা স্পাইডার উওম্যানকে গ্রেপ্তার করতে মরিয়া। কালক্রমে এক খলনায়ক ভালচারের সঙ্গে লড়তে গিয়ে গোয়েনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় জেসিকা ড্রিউ ও মিগুয়েল ও’হারার। তারা ভিন্ন ভিন্ন ব্রহ্মাণ্ডের মাকড়সা-মানব বা মানবী। এরপর গল্পে প্রবেশ মাইলসের। আর তারপর গল্প এগোয় তাকে কেন্দ্রে রেখে। ক্রমেই ঘটনার ঘনঘটা দর্শককে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে ফেলতে থাকে। যা বজায় থাকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত। দেখা মেলে কত যে স্পাইডারম্যানের! শিশু-স্পাইডি থেকে মায় টি রেক্স স্পাইডি পর্যন্ত! এবং পবিত্র প্রভাকর। এই ছোকরা ভারতীয় স্পাইডারম্যান। সে থাকে মুম্বাটন (মুম্বই ও ম্যানহাটনের মিশেল) নামের এক শহরে। প্রভাকর পর্দায় যতক্ষণ থাকে, মাতিয়ে রাখে। ২০০৪ সালে বইয়ের পাতায় তার দেখা মিললেও পর্দায় আবির্ভাব এবারই। ছবির হিন্দি সংস্করণে তার কণ্ঠস্বর আসলে ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন তারকা শুভমান গিলের (Shubman Gill)। যা বাড়তি আকর্ষণ হয়ে উঠেছে। প্রভাকরকে নিয়ে একটা ‘স্পিন অফ’ ভবিষ্যতে হতেই পারে। মার্ভেল কি ভারতে তাদের বিপুল ফ্যানবেসের কথা ভাববে না?
[আরও পড়ুন: ‘অর্ধাঙ্গিনী’ শুধুই প্রাক্তন এবং বর্তমানের দ্বৈরথ নয়]
সবশেষে একটাই কথা বলার থাকে। ছবির প্রথমার্ধের একটা অংশ কিছুটা ঢিমে তালের। সেইটুকুও অভিযোগ করার মতো নয়। বরং ছবির ক্লাইম্যাক্সে এসে আচমকাই যেভাবে গল্পটাকে ‘পজ’ করে দেওয়া হয়, তাতে মনখারাপ হয়ে যায়। তবে সেই সঙ্গেই শুরু হয় প্রতীক্ষা। কবে মুক্তি পাবে পরের পর্ব? জানা যাচ্ছে, আগামী বছরের মার্চে আসবে তৃতীয় পর্ব। ততদিন যে অনুরাগীরা মনে মনে গল্পটার পরের পর্ব নিয়ে নানা সম্ভাবনার জল্পনায় মশগুল থাকবে তা হলফ করে বলাই যায়। সেটাই যে আসল মজা মাল্টিভার্সের। থুড়ি স্পাইডার ভার্সের।