নির্মল ধর: প্রতিটি মানুষের কিছু না কিছু নিজস্বতা থাকেই। সেই বিশেষত্ব নিয়ে যে সুখী হয় তাঁর জীবনে কোনও সমস্যা নেই। হয়ও না। কিন্তু যে হীনমন্যতায় ভোগে তাঁর হয় সমস্যা। প্রত্যেকে নিজস্বতায় সম্পূর্ণ। অন্যের দেখাদেখি কিছু নকল করতে গেলেই বাধে গোল। জীবনের চলতি ধারা বিপর্যস্ত হয়। যেমনটি ঘটেছে অর্জুন দত্তর নতুন ছবি ‘শ্রীমতী’র (Shrimati) নায়িকা রন্ধনপটিয়সী শ্রীমতীর (স্বস্তিকা) ক্ষেত্রে।
জনৈক রেবাদির দেওয়া রেসিপি নিয়ে বাড়িতে নিত্যনতুন খাবারের পদ বানিয়ে স্বামী অনিন্দ্য, ননদ বৃষ্টি, শাশুড়িদের মজিয়ে রাখে শ্রীমতী। তার ডান হাত কাজের মেয়ে কাজলও পরিবারের একজন। আর শ্রীমতির ছায়াসঙ্গী। হঠাৎই স্বামীর অফিসের বস এবং তাঁর অত্যাধুনিক তরুণী স্ত্রী মল্লিকার উপস্থিতি সুখের সংসারের তাল কাটে। বৃষ্টি চায় বউদিকেও মল্লিকার মতো সাজে পোশাকে, শরীরী চেহারায় ‘আধুনিক’ করে তুলতে। অনিচ্ছা সত্বেও শ্রীমতী জিমের ক্লাসে ভরতি হয়, শিখতে শুরু করে নাচ। গাবলু গুবলু চেহারার শ্রীমতীকে ‘৩৬-২৪-৩৬ ফিগারে’ আনতেই হবে, এটা বৃষ্টির জেদ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হয়? তা সিনেমা হলে গিয়ে দেখাই বাঞ্ছনীয়।
প্রত্যেকে নিজের মতো করে সুন্দর ও স্বাভাবিক। আরোপিত সৌন্দর্য কোনও কাজের নয়। অন্তত মধ্যবিত্তের সংসার জীবনে। এই সারসত্যটি নিয়েই অর্জুন ছবিকে সাজিয়েছেন কিছুটা কমেডির মোড়ক দিয়ে। এবারের এই নতুন ছবিতে অর্জুন জীবনের কোনও জটিল সমস্যার দিকে নজর দেননি। রোজকার জীবনের মধ্যে থেকেই খুঁজে নিয়েছেন ছোট ছোট আনন্দ, বিষাদ ও মন ভাঙার ঘটনাকে। সেই ঘটনাপ্রবাহকে কোলাজের আকারে সাজিয়েই সিনেমার রূপ দিয়েছেন পরিচালক।
[আরও পড়ুন: মণিরত্নমের ছবির নতুন পোস্টারে ‘হাম দিল দে চুকে সনম’ সিনেমার স্মৃতি ফেরালেন ঐশ্বর্য]
‘শ্রীমতী’ কোনও স্বপ্ন ভাঙার গল্প নয়, পুরো সংসারের এক সাময়িক সার্বিক বিপর্যয় ও তা থেকে উত্তরণের কাহিনিও বটে! পৃথুলা চেহারার গৃহিণী হয়েই শ্রীমতীর সুখ। বিষয় হিসেবে অর্জুনের আগের দু’টো ছবির তুলনায় ‘শ্রীমতী’ অনেক বেশি লঘু, হালকা মেজাজের। তাই ছবির তৈরিতেও শুরু থেকেই স্ল্যাপস্টিক কমেডির ধারা বজায় রাখা হয়েছে। অফিসের বসের পার্টিতে গিয়ে পয়েন্টেড হিলের জুতো পরেই শ্রীমতী হোঁচট খেয়ে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড বাধিয়েছিল। আর সেখান থেকেই পরিবর্তনের শুরু। ওরকম একটা নাটকীয় দৃশ্যে স্বামী হিসেবে সোহমের উপস্থিতির প্রয়োজন ছিল। সেটা পরিচালক রাখেননি।
অবশ্য চিত্রনাট্যের বাঁধুনি গল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই সমান তালে হাসি আর মজার নানা ঘটনায় সাজানো। বিশেষ করে ভাল লাগে তরুণ জিম মাস্টার শ্রীমতীর সঙ্গে একান্তে দেখা করে অত্যন্ত ‘জরুরি’ কিছু কথা বলার বাহনা। ফুরফুরে মেজাজেই ছবির গতি, আর সমস্যার সমাধানও। ছবির দু’টি গান গল্পের গতিকে বাড়িয়েছে। অর্জুনের পরিচালনার কাজ পরিচ্ছন্ন। তবে বুদ্ধি বা চেতনার ধার নেই। নজরকাড়া হালকা ফ্রিক বানিয়েই খুশি সে।
প্রশ্ন একটাই, ‘অব্যক্ত’ দেখা দর্শক খুশি হবেন তো অর্জুনের এই দৃষ্টিবদল দেখে? আদ্যন্ত এই ছবি অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের (Swastika Mukherjee)। তিনি জমিয়ে অভিনয়ও করেছেন। চিত্রনাট্যের ছোটখাটো খামতি ঢাকা পড়েছে তাঁর স্বচ্ছন্দ অভিনয়ে। কাজলের চরিত্রে খেয়া চট্টোপাধ্যায়ের (Kheya Chattopadhyay) অভিনয় বেশ হিউমার মাখানো। খেয়ার পরিবেশনও স্বাভাবিক ও সুন্দর। স্বামীর চরিত্র সোহম (Soham Chakraborty) স্বস্তিকার পাশে একটু যেন ঢাকা পড়ে গেলেন। তবুও চেষ্টায় ত্রুটি ছিল না তাঁর। তৃণা সাহা ও বারখা বিস্ত মন্দ সঙ্গত করেননি। একটাই আক্ষেপ – আমাদের পরিচালকরা কি জীবনের কষ্ট, দুঃখ, বিপর্যয়, অসাম্য, সমস্যা থেকে সত্যিই মুখ ফিরিয়ে থাকবেন। হাসির মোড়কে আর কতদিন কঠিন ও জ্বলন্ত বাস্তব থেকে মুখ লুকিয়ে থাকা হবে? বালির মধ্যে মুখ গুঁজে রাখলেই প্রলয় বন্ধ থাকে না, এটা বোঝা প্রয়োজন।
ছবি- শ্রীমতী
অভিনয় – স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, সোহম চক্রবর্তী, খেয়া চট্টোপাধ্যায়, তৃণা সাহা, বরখা বিস্ত
পরিচালনায় – অর্জুন দত্ত