shono
Advertisement
Mahalaya

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ছেড়ে মহালয়ায় চণ্ডীপাঠে উত্তমকুমার! তীব্র আপত্তি জানিয়েছিল বাঙালি

বাঙালির মনের পঞ্জিকায় 'মহিষাসুরমর্দিনী' মানেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
Published By: Suparna MajumderPosted: 09:07 AM Oct 02, 2024Updated: 09:07 AM Oct 02, 2024

সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: তিনি বাঙালির ম্যাটিনি আইডল। তাঁর তাকানো, হাসি, বেশভূষা, তাঁর সংলাপ বলার ধরন, বডি ল্যাঙ্গোয়েজ বাঙালিকে দিয়েছে নিজস্ব স্টাইল স্টেটমেট। অভিজাত উত্তরীয়ের মতোই বাঙালি তাঁকে আপন করে জড়িয়ে নিয়েছে তাঁর সাংস্কৃতিক সত্তায়। সেই এক এবং অদ্বিতীয় উত্তমকুমারকেও (Uttam Kumar) অন্তত একবার পড়তে হয়েছিল বাঙালির তীব্র প্রত্যাখ্যানের মুখে। বলা যায়, বাঙালির 'মহানায়ক' হেরে গিয়েছিলেন মাত্র একজনের কাছে। তিনি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। যাঁর চণ্ডীপাঠেই বাঙালির সেরা পার্বণের বোধন। তাঁর পরিবর্তে এমনকী মহানায়কের কণ্ঠও মেনে নিতে নারাজ ছিল বাঙালি শ্রোতা।

Advertisement

'মহিষাসুরমর্দিনী'। এ কেবল একটি রেডিও অনুষ্ঠান নেই আজ আর, বরং বাঙালি সংস্কৃতির অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয়। একটি অনুষ্ঠান কোন মেধাগত উচ্চতায় পৌঁছলে, সামগ্রিকভাবে একটি জাতির পার্বণের সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে যায়, তা সহজেই অনুমেয়। আকাশবাণীর (Akashbani) প্রযোজনায় এই অনুষ্ঠান বহু রদবদলের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। বর্তমানে আমরা যে রেকর্ডিংটি শুনতে পাই, সেটির রূপদান করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র (Birendra Krishna Bhadra), বাণীকুমার, পঙ্কজ কুমার মল্লিকের মতো ব্যক্তিত্ব। প্রত্যাশিতভাবেই বাঙালির কাছে এই অনুষ্ঠান একটি অন্য তাৎপর্য বহন করে আনে। মহালয়ার দিন অনুষ্ঠানটির সম্প্রচার হয়। সেদিন পিতৃপক্ষের অবসান। পিতৃপুরুষের উদ্দেশে এদিন জলদান অর্থাৎ তর্পণের রীতি আছে। আর ঠিক তাঁর পরদিন থেকেই শুরু হচ্ছে দেবীপক্ষ।

এই মহালয়া (Mahalaya) যেন সেই দুই মুহূর্তের সন্ধিলগ্ন। কেউ কেউ বলেন, পিতৃলোক ও মনুষ্যলোক ব্রহ্মার নির্দেশে এই সময় কাছাকাছি চলে আসে বলেই বৃহৎ ও মহান আলয় তৈরি হয়। আবার কেউ কেউ বলেন, ঠিক এর পর থেকেই দেবীপক্ষ শুরু হচ্ছে, অর্থাৎ মা দুর্গাই এখানে সেই আলয় বা আশ্রয়। শাস্ত্রগত ব্যাখ্যায় এই তিথির গুরুত্বের সঙ্গেই কালক্রমে মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে ভোরের অনুষ্ঠানের ওই চণ্ডীপাঠ। যে নিষ্ঠা, শৃঙ্খলা মেনে অনুষ্ঠানটি তৈরি করা হত, তার গল্প পরে বাঙালি যত শুনেছে তত অবাক হয়েছে। একটি অনুষ্ঠানকে মানুষের মনের মণিকোঠায় পৌঁছে দিতে গেলে যে কী মাত্রায় অনুশীলন, পরিশ্রম প্রয়োজন তা জানিয়েছে সেই নেপথ্য গল্পগুলি। একবার সেই অনুষ্ঠানে সম্প্রচারের অভ্যাসে বদল আনা হল, আর তাতেই যত বিপত্তি।

১৯৭৬ সাল। মহানয়ক তখন খ্যাতির শীর্ষে। সেই সময় ঠিক করা হয়েছিল, তাঁকে দিয়ে এই অনুষ্ঠানটিকে নতুন করে রূপ দেওয়ার। শোনা যায়, স্বয়ং উত্তমকুমার নাকি এ ব্যাপারে দ্বিধান্বিত ছিলেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠ না শুনলে যে বাঙালির পুজো শুরু হয় না, তা তিনি বেশ জানতেন। তবে শেষমেশ রাজি হয়েছিলেন। অনুষ্ঠানটির মান যে খারাপ হয়েছিল তা-ও নয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় দায়িত্ব নিয়েছিলেন সঙ্গীত নির্মাণের। সেবছর ২৩ সেপ্টেম্বর, যথারীতি মহালয়ার ভোরে বাঙালি রেডিও চালায় পরিচিত মহিষাসুরমর্দিনী শোনার জন্য। বদলে সেবার সম্প্রচারিত হয়েছিল, 'দেবীং দুর্গতিহারিণীম'। তীব্র আপত্তি জানায় বাঙালি।

সেই সময় যোগাযোগ ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। শোনা যায়, তা সত্ত্বেও একের পর এক ফোন যায় স্বয়ং বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কাছে। কেন তিনি অন্য কাউকে চণ্ডীপাঠের অনুমতি দিলেন? এই ছিল প্রশ্ন। বারংবার উত্তর দিয়ে একসময় ফোন নামিয়ে রাখা হয়। এদিকে আকাশবাণীর সামনে সেই সময় জমা হয়েছিল কাতারে কাতারে বিক্ষুব্ধ মানুষ। সকলের একটাই দাবি, কেন মহিষাসুরমর্দিনী সম্প্রচার করা হচ্ছে না? স্বয়ং বীরেন্দ্রকৃষ্ণের অবশ্য নতুনকে জায়গা ছেড়ে দিতে আপত্তি ছিল না। কিন্তু বাঙালি এই পরিবর্তন মানতে পারেনি। একটি অনুষ্ঠানকে ঘিরে যে মানুষের আবেগ এমনভাবে জড়িয়ে থাকতে পারে, তা হয়তো আঁচ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। মহানায়কের জনপ্রিয়তা আর একটি ভালো মানের অনুষ্ঠান- এই যুগলবন্দিতে তাঁরা ছেয়েছিলেন নতুনত্বের স্বাদ দিতে।

কিন্তু বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ততদিনে বাঙালির মনের পঞ্জিকায় জায়গা করে নিয়েছেন। তাঁকে সরিয়ে অন্য কাউকে ওই ভোরটুকু ছেড়ে দেওয়া আর যে সম্ভব নয়, সেদিনের মানুষের ক্ষোভ, বিরক্তি, রাগ, অভিমান সে কথাই জানিয়ে দিয়েছিল স্পষ্ট করে। বিক্ষোভের আঁচ এতটাই তীব্র ছিল যে, সে বছরই পুনরায় 'মহিষাসুরমর্দিনী'র সম্প্রচার করতে হয়।

একটি অনুষ্ঠানের বদল ঘিরে এমন ঘটনা সম্ভবত ভূ-ভারতে নেই। অনেকে বলে থাকেন, এ ঘটনা আসলে জানান দেয় বাঙালি নতুনকে গ্রহণে নারাজ। আবার একই সঙ্গে এও তো সত্যি, যা তার সাংস্কৃতিক চিহ্নস্বরূপ, তাকে যে বাঙালি পরম যত্নে আগলে রাখে, এ ঘটনা তারও তো প্রমাণ। এখনও মহালয়ার ভোর মানেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠ। আশ্বিনের শারদপ্রাতে তাঁর চণ্ডীপাঠই বাঙালি আবাহনমন্ত্র। এই একটা ভোরের জন্য আর কেউ নয়, তিনিই বাঙালির মহানায়ক।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • এখনও মহালয়ার ভোর মানেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠ।
  • আশ্বিনের শারদপ্রাতে তাঁর চণ্ডীপাঠই বাঙালি আবাহনমন্ত্র।
Advertisement