ইতিহাসের পাতায় নাম বাংলার মেয়ে অনসূয়া সেনগুপ্তর। প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী হিসেবে কান চলচ্চিত্র উৎসবে জিতে নিলেন সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার। কীভাবে শুরু হয়েছিল তাঁর এই সফর? বুলগেরিয়া থেকে একান্ত সাক্ষাৎকারে সেই গল্প সুপর্ণা মজুমদারকে শোনালেন 'দ্য শেমলেস' সিনেমার পরিচালক কনস্ট্যানটিন বোঁজ্যনভ (Konstantin Bojanov)।
প্রথমেই জানাব অভিনন্দন। আপনার সিনেমার নায়িকা, আমাদের কলকাতার মেয়ে অনসূয়া কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেত্রী। কী বলবেন?
ধন্যবাদ, আমি অত্যন্ত খুশি। আমার এই সফর খুবই লম্বা ছিল। ১২ বছরের ভাবনা ও চেষ্টায় তৈরি এই ছবি। কিন্তু আমরা করতে পেরেছি। Cannes-এ প্রিমিয়ার, অফিশিয়াল সিলেকশন, সারা বিশ্বের কাছে পৌঁছানোর জন্য এর থেকে ভালো প্ল্যাটফর্ম আর কী হতে পারে! আর অনসূয়া সেনগুপ্তর মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রথম পুরস্কারও পেয়ে গেলাম। ও কলকাতারই মেয়ে।
ছবি: ফেসবুক
'দ্য শেমলেস' সিনেমার নাম। রেণুকার চরিত্রে অনসূয়ার সফর কীভাবে শুরু হল?
আমি সিনেমায় কাউকে কাস্ট করতে প্রচুর সময় নিয়ে থাকি। এই সিনেমার জন্য মুম্বইয়ের কাস্টিং এজেন্সির সঙ্গে কাজ করেছি। একজন আছেন পরাগ মেহতা। আট মাসেরও বেশি সময় ধরে এই কাজ হয়েছে। আমি পরাগের মাধ্যমে অসামান্য সব অভিনেত্রীদের কাজ দেখেছি, তবে অনসূয়ার সঙ্গে আমার কানেকশনটা অদ্ভূত ছিল। একটা সময় তো মনে হচ্ছিল সিনেমাটা ভারতে তৈরিই করতে পারব না। আমি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য অ্যানিমেটেড ছবি তৈরির কথাও ভাবতে শুরু করেছিলাম। সেই সময় আমার বাঙালি পরিচালক তথা প্রযোজক বন্ধু কিউ আমাকে এক মেয়ের কথা বলে যার আঁকা আমার অ্যানিমেটেড সিনেমার কাজে লাগতে পারে। এই আইডিয়া কাজ করে যায়। অনসূয়ার সঙ্গে ফেসবুকে বন্ধুত্ব হয়। আর দুবছর পরেও আমি যখন ওর ছবি দেখতাম, কিছু একটা ছিল ওর ভাবনায়, মেজাজে। একটা ক্যারিশমা... যাতে আমি এই চরিত্রটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি ফেসবুকে মেসেজ করে জানতে চাইলাম ও লিড হিসেবে অভিনয়ের চেষ্টা করবে কি না। খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল। ওর কয়েকটা দিন লেগেছিল আমার মেসেজের জবাব দিতে। এক মাস লেগেছিল নিজের ভিডিও পাঠাতে। আমি যখন ওকে প্রথমবার স্ক্রিনে দেখলাম মনে হল, আমি আমার অন্যতম মুখ্য একটা চরিত্র পেয়ে গেছি। তাই অল্প কথায় বলতে গেলে The connection was through Facebook.
তাহলে ফেসবুকই আসল কাজটি করল?
সবটা তা নয়, আমার আর অনসূয়ার বন্ধুত্ব ওর আঁকার জন্য। আমি ওর ছবিগুলো যত দেখেছি, নিজের সিনেমার চরিত্রকে চোখের সামনে দেখতে পেয়েছি। এর মধ্যে কিন্তু বেশ কয়েকজন প্রতিভাবান ও জনপ্রিয় অভিনেত্রী এই চরিত্র করতে আগ্রহী ছিলেন। নাম বলব না। তবে অনসূয়ার মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল যাতে আমার বিশ্বাস ছিল যে এই চরিত্রে ওই সবেচেয়ে বেশি উপযুক্ত।
ছবি: ফেসবুক
[আরও পড়ুন: ‘বাঙালিরা তো খুব কম পায়…’, অনসূয়ার কান সম্মানে আপ্লুত অপরাজিতা ]
দ্য শেমলেস। এই সিনেমার ভাবনা কীভাবে?
একটা বই থেকে এই আইডিয়া আসে। প্রথমে তথ্যচিত্র করব ভেবেছিলাম। ২০১৪ সালে তথ্যচিত্রের প্রথম ভাগ শুটও করেছিলাম। উত্তর কর্ণাটকের দেবদাসী, যৌনকর্মীকে নিয়ে। তা করতে গিয়েই মনে হয় যদি একটা ফিকশনাল কিছু করি। ব্যস! তথ্যচিত্রর কাজ বন্ধ করে ফিকশনের চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করি। টাকা জোগাড় করতে অনেক সময় লেগেছে। তবে অনুপ্রেরণা উইলিয়াম ডালরিম্পলের 'নাইন লাইভস'। এর চারটে চরিত্র আমায় খুব আকর্ষণ করেছিল। আমার সিনেমা আলাদা। তবে অনুপ্রেরণা এই বই।
কলকাতায় এসেছেন?
আমি অনেকবার কলকাতায় এসেছি। আরও কোনও কারণ বশত এখানকার ফিল্মমেকার, লেখকদের সঙ্গে আমি কানেকশন ফিল করি। এই শহরের জন্য আমার মনে আলাদা জায়গা রয়েছে।
কোন বাংলা সিনেমা পছন্দ?
আমি সত্যজিৎ রায়ের দারুণ ফ্যান। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের একজন কিংবদন্তি পরিচালক তিনি। অনেকেই তাঁর ধারেকাছে আসতে পারবে না। তাই আমি সত্যজিৎ রায়ের বিশাল বড় একজন অনুরাগী।
সত্যজিৎ রায়ের কোন সিনেমা আপনার সবচেয়ে পছন্দের?
অপু ট্রিলজি। লন্ডনে এক ছাত্রের কাছ থেকে খোঁজ পেয়েছিলাম। দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি। সম্প্রতি ওনার বায়োগ্রাফিও পড়েছি। রেয়ার ম্যান! জিনিয়াস।
কলকাতার কোন খাবার পছন্দ?
আসলে কলকাতার সেরা খাবার আমি খেয়েছি সেখানকার মানুষের বাড়িতে। ঘরোয়া খাবার। ওখানকার স্ট্রিট ফুডও খুব পছন্দ।
অনসূয়া কোনও বাঙালি খাবার খাইয়েছে?
এখনও না। আসলে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল কাঠমণ্ডুতে। আমার দিক থেকে বলতে পারি, ও খুবই কাছের বন্ধু হয়ে গিয়েছে। আমি ওর জন্য খুব খুশি। আমার মনে হয়েছিল, কেউ যদি পুরস্কার পেতে পারে সেটা ওই। ও দারুণ। সিনেমা যখন দেখবেন তখন বুঝতে পারবেন।
পুরস্কার জেতার পর কী কথা হল?
ও দারুণ খুশি। আর ও এবার থেকে ক্যামেরার সামনে থাকতে একদম তৈরি। গত ১৫ বছর ধরে ক্যামেরার পিছনে কাজ করছিল। আর আমিও ওর জন্য দারুণ খুশি। কাল রাত থেকে ফোনে অনেক ঠাট্টা হয়েছে। ও আমার মনের খুব কাছের।
ছবি: ফেসবুক