১০ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পাবে ‘মিথ্যে প্রেমের গান’। ছবি মুক্তির আগে একান্ত সাক্ষাৎকারে অনির্বাণ ভট্টাচার্য। শুনলেন বিদিশা চট্টোপাধ্যায়।
‘মিথ্যে প্রেমের গান’-এ একেবারে নতুন অনির্বাণকে পাওয়া যাচ্ছে। নিজেই বলেছেন, অভিনেতা হিসাবে নতুন জন্ম হয়েছে। ‘অভীক’-এর চরিত্রটা আপনার ইমেজ কতটা বদলে দেবে বলে মনে হয়?
অনির্বাণ: আমার কেরিয়ারের ক্ষেত্রে অন্যরকমের একটা ছবি। এগারোটা গান রয়েছে। ছবির প্রোমোশনে মিউজিক কনসার্টে ভাল সাড়া পাচ্ছি। আমার ইমেজ কতটা বদলে যাবে সেটা নির্ভর করবে ছবির মেরিটের ওপর। ছবির মেজাজের সঙ্গে আমার অভিনয় কতটা মেশাতে পেরেছি, বা কতটা ট্রুথ তৈরি করতে পেরেছি, তার ওপর। এখনও পর্যন্ত আমি হোপফুল। ১০ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পাবে, দেখা যাক কী হয়।
ট্রেলার থেকে মনে হয়, ছবির মেজাজ এবং বাহ্যিক রূপের মধ্যে একটা হোমোজেনাস ব্যাপার আছে। যে কোনও আর্বান কনটেক্সটে এই চরিত্রদের ফেলে দেওয়া যায়। এমন চরিত্র করার চ্যালেঞ্জটা কীরকম?
অনির্বাণ: আমার চ্যালেঞ্জ যেটা ছিল, সেটা হল – আমরা খানিকটা বাস্তবঘেঁষা ছবির অভিনেতা। সমাজ থেকে একজন মানুষকে তুলে এনে তারই একটা পোর্ট্রেয়াল করা হয়ে থাকে – এই ছবি সেখান থেকে খানিকটা সরে আছে। বলিউড বা টলিউড ঘরানার এইভাবে দেখতে চাই না। ইন্সপিরেশন হয়তো থাকতে পারে। আসলে কী হয়েছে, এখন আমরা রেফারেন্স ছাড়া আর কিছু দেখতে পাই না। এত বাল্ক অফ কনটেন্ট তৈরি হয়েছে এবং এত কিছু দেখে ফেলেছি যে খুব নতুন কিছু দেখা বোধহয় আর সম্ভব নয়। ‘মিথ্যে প্রেমের গান’ রিয়্যালিটি থেকে এক পর্দা বা দু’পর্দা সরে আছে। ক্লাসিকাল রোম্যান্টিসিজমের ব্যবহার আছে এই ছবিতে।
আপনি পূর্বে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, মেনস্ট্রিম ছবিতে অভিনয় করার মতো ট্রেনিং আপনার নেই, যেখানে চেহারা একটা মাস অ্যাপিল তৈরি করে। এই স্টেটমেন্ট থেকে অনির্বাণ ভট্টাচার্য এখন কতটা দূরে? কখনও সিক্সপ্যাকে দেখতে পাব?
অনির্বাণ: আমি যে ধরনের কমার্শিয়াল ছবির কথা ভেবে কমেন্টটা করেছিলাম, ‘মিথ্যে প্রেমের গান’কে সেই কমার্শিয়াল ছবির আওতায় ফেলা যাবে না। এই ছবিতে কোনও নাচ নেই আমার। আমি যে ট্রেনিং, গ্রুমিং বা টোনিং-এর কথা বলতে চেয়েছিলাম সেটা হচ্ছে প্রচণ্ড নাচ-গানে ভরা অ্যাকশন ফিল্মের ক্ষেত্রে। ফলত, আমার যে ট্রেনিং এরিয়া এই ছবি তার মধ্যেই পড়ে। ভবিষ্যতে সিক্স প্যাক করব কি না এক্ষুনি বলতে পারব না। ভবিষ্যতে আমি কেরিয়ারের কোন অবস্থায় আছি, আমার ভিতরে কী ইচ্ছে করছে, কীভাবে দেখছি অভিনয় শিল্পকে– তার উপর নির্ভর করবে। তবে ব্যক্তিগতভাবে এই বয়সের সঙ্গে বদলাতে থাকা যে চেহারা, সেটা আমার খুব প্রিয়। আমার ভাল লাগে দর্শকের সামনে সেই চেহারাটা তুলে ধরতে। ২০১৫ সাল থেকে বিভিন্ন সিনেমা কিংবা থিয়েটারের স্থিরচিত্রে নিজের বদলে যাওয়া চেহারা, বদলাতে থাকা অভিনয় দেখি। আমি নিজে এই পরিবর্তনশীল জার্নিটা খুব এনজয় করি।
[আরও পড়ুন: শেষমেশ অভিনেতা সুহত্রকেই কি মন দিলেন? প্রকাশ্যে এল দিতিপ্রিয়ার প্রেমপত্র ]
আপনি নিজের কাজ দ্যাখেন? অনেক অভিনেতাই আছেন যাঁরা নিজের কাজ দ্যাখেন না।
অনির্বাণ: অবশ্যই দেখি। থিয়েটারে সুযোগ পাই না, কিন্তু সিনেমা দেখে যদি মনে হয়, ত্রুটি শোধরানো যাবে, সেই চেষ্টা করি। আর ক্রিটিকালি দেখি, নার্সিস্টিকালি দেখি।
আপনি নার্সিসিস্ট?
অনির্বাণ: অভিনেতাদের নার্সিসিস্ট হতেই হবে। নিজেকে যদি আমার ভাল না লাগে, তাহলে দর্শককে ভাল লাগাব কী করে!
পরমা নেওটিয়া ডেবিউ পরিচালক হিসাবে কেমন?
অনির্বাণ: ছবি করার আগে পরমা প্রচুর কথা বলেছে আমাদের সঙ্গে। ওর স্ক্রিপ্ট রাইটার অরিত্র সঙ্গে থাকত। মিউজিক প্রায় দু’বছর ধরে রেডি। ও আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল যে ‘অভীক’-এর মধ্যে দিয়ে কী বলতে চায়। আমাদের ছবিতে প্রেমের একটা ইন্টারেস্টিং জোন আছে। ভালবাসার সঙ্গে ইনসিকিওরিটি এবং ভয়। যেটা এমনিতে খুবই নর্মাল। কিন্তু সেটা নিয়ে ছবি করাটা সবসময় সহজ হয় না। আই এনজয়েড এ লট, ওয়ার্কিং উইথ পরমা। শি ওয়াজ ফুললি প্রিপেয়ার্ড উইথ দ্য স্ক্রিপ্ট, মিউজিক অ্যান্ড দ্য আইডিয়া অফ দ্য ফিল্ম।
প্রেমে ভয়, নিরাপত্তাহীনতার কথা বললেন। অনির্বাণ ভট্টাচার্য কখনও নিজের জীবনে প্রেমে প্যানিক করেছেন? না কি বাকি সব কিছু যেমন দারুণ পারেন প্রেমেও লেটার মার্কস!
অনির্বাণ: না না… আমি সব কিছু দারুণ পারি না। প্রেমে আমি বহুবার হোঁচট খেয়েছি, ভয় পেয়েছি, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছি। জীবনের সব কিছুর মধ্যে দিয়ে নিজেকে ভালনারেবল রেখেছি। আমি কোনওদিন আজ পর্যন্ত জীবনের কোনও কিছু নিয়ে নিজেকে কোনও একটা স্ট্যাগন্যান্ট পজিশনে নিয়ে যাইনি। এই ধরনের যাপনে একটা রিস্ক আছে। তুমি যদি নিজেকে ভালনারেবল করে রাখো তার কিছু কনসিকোয়েন্স আছে। সেটাকে ফেস করতে করতে যেতে হয়। আমাকেও যেতে হয়েছে।
আপনাকে দেখে বা আপনার কথা শুনে কিন্তু ভালনারেবল মনে হয় না।
অনির্বাণ: গুছিয়ে কথা বলাটা বলতে-বলতে শিখে গিয়েছি। সাহিত্যপাঠ থেকে একটা শব্দভাণ্ডার হয়তো আছে, আর তাছাড়া অভিনেতাদের কমিউনিকেট করার ডিজায়ার থাকে। যেটা ভাবছি ঠিক সেটাই যেন আমি কমিউনিকেট করতে পারি। আর দ্বিতীয়ত বাংলা ভাষাটাকে আমি প্রচণ্ড ভালবাসি। বলতে, পড়তে বা শুনতে। তাই যখন আমি কথা বলি, আই শুড সেলিব্রেট দিস ল্যাঙ্গোয়েজ। তবে দেখে কী করে বোঝা যাবে সেটা জানি না। আমাকে যাঁরা ভালনারেবল পজিশনে দেখেছেন, তাঁরা জানেন যে আমি ভালনারেবল। আর অভিনেতা হওয়ার জন্য একটা পর্যায় পর্যন্ত ভালনারেবল হওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।
‘মন্দার’, ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ প্রশংসিত। পরিচালক হিসাবে আপনাকে আবারও দেখতে পাব। আপনি নিজেই একবার বলেছিলেন, সময় নিয়ে ছবি করতে গেলে রিয়্যাল ত্যাগ করা প্রয়োজন, লাইফস্টাইলে বিলাসিতা বর্জন করতে হবে। আপনাকে সেই ত্যাগের মুখোমুখি হতে হয়েছে কখনও?
অনির্বাণ: আমাকে ত্যাগ করতে হয়েছে, কিন্তু সেটাকে আমি ত্যাগ হিসাবে দেখিনি। এবং এক্ষেত্রে পেশার অ্যাম্বিশনটা বিচার্য। তুমি কোথায় পৌঁছতে চাও, তোমার লাইফস্টাইল কোথায় নিয়ে যেতে চাইছ! সেই প্যারামিটারে দেখতে গেলে আমার কোনও কিছুকে ত্যাগ মনে হয়নি। আমার যা আছে, সেটা নিয়ে আমি আমার গোটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারি। একটা বাড়ি আছে, থালায় গরম খাবার আছে, আমার একটা গাড়ি আছে, আমি খুশি। কী কী নেই ভাবতে বসলে যদি দেখি তিন বছরে কতবার ইউরোপ টুর করতে পেরেছি তখন না পাওয়ার খতিয়ান এক্সপোজড হবে। কিন্তু আমি সেভাবে ভাবি না।
১০ ফেব্রুয়ারি ‘মিথ্যে প্রেমের গান’ মুক্তি পাবে। ‘পাঠান’ অলরেডি অনেক শো নিয়ে বসে আছে। ক্ল্যাশ তো হবেই!
অনির্বাণ: সমস্যা হলে হবে। এই সমস্যা তো অভিনেতা, পরিচালকরা কিছু করতে পারবে না। ইটস অ্যাবাউট গভর্নমেন্ট পলিসি, ডিসট্রিবিউটরস, প্রোডাকশন হাউস পলিসি। এগুলো নিয়ে ফেসবুকে চারটে কথা লেখা যায়। তাতে সমাধান হবে না। এটা নিয়ে হুজুগে খেউড় না করে একটা কনস্ট্রাকটিভ আলোচনা করতে হবে। স্ট্যাটিসটিক্স নিয়ে ভাবতে হবে। ঘটনার শুরু কোথায় হল, পশ্চিমবঙ্গে ক’টা হল ছিল, ক’টা হল বন্ধ হল, কেন বন্ধ হল, সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির অর্থনৈতিক অবস্থা– সবটা তলিয়ে দেখতে হবে। সেটা না করে সোশ্যাল মিডিয়াতে চর্বিতচর্বণ চলে। এ একটা কথা বলল, সেটাকে অপোজ করে অন্যজন উল্টো কথা বলল। আগেও বলেছি এই বিরোধাভাষ এখন আমাদের কাছে নতুন বিনোদন। এই বক্সিং রিং এখন িবনোদনের নতুন ক্ষেত্র।
তবে ‘পাঠান’-এর সাফল্য এটা প্রমাণ করে দিল, কোনও এক্সট্রিমিস্ট রাজনৈতিক দল ধর্মের নামে ফতোয়া জারি করে ছবি বয়কট করতে চাইলেই এক্ষেত্রে অন্তত সফল হল না। কিছু বলবেন?
অনির্বাণ: এটা তো একটা নতুন ফেনোমেনা ভারতে। কোনও রকম ছুঁৎমার্গ না রেখেই বলা যায়, এই যে নব্য ইসলামোফোবিয়া এবং সব কিছুর সঙ্গেই একটা কিছু সেন্টিমেন্টকে জুড়ে দেওয়া, এটা তো একেবারেই রাজনৈতিক একটা মুভ। এখন যারা বড় হচ্ছে তারা হয়তো গোড়া থেকেই এটা দেখছে যে ভারত এমন
একটা দেশ যেখানে এটা চলতে থাকে। কিন্তু আমি তো সম্পূর্ণ অন্য একটা দেশের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। তবে যখন ‘পাঠান’ চলে বা অন্য ধরনের একটা কিছু হয়, তখন আমি বুঝতে পারি যে অত সহজেও এই দেশটাকে কবজা করা যায় না। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে নানা রাজনৈতিক চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছে আমাদের দেশ। এই যে ধর্মের চেহারা দিয়ে সবটা দেখার একটা রেওয়াজ চালু করা হয়েছে, ইতিহাসকে একরকম করে বলা,–এটা এখন চলবে যতক্ষণ না স্যাচুরেশন পয়েন্টে পৌঁছয়। এটা তখনই টিকতে পারে যদি ফান্ডামেন্টালি, নিপীড়িত, পিছিয়ে পড়া গরিব মানুষের ভাল হয়, কিন্তু সেটা না হয়ে এটার উদ্দেশ্য যদি অন্য কিছু হয়ে থাকে, ধর্ম রিলেটেড হয়ে থাকে– আমার মনে হয় না, এটা খুব বেশিদিন পর্যন্ত চালানো যাবে।