ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ-এর নির্দেশ অনুযায়ী, একজন মানুষের বছরে গড়ে ১০.৫ কেজি পোলট্রি মাংস এবং ১৮০টি ডিম খাওয়া প্রয়োজন। অথচ বর্তমানে ভারতের মানুষ বাৎসরিক মাথাপিছু গড়ে ৩.৫ কেজি মাংস ও ৯১টি ডিম গ্রহণ করছে। তাই মাথাপিছু পোলট্রির মাংস ও ডিমের উৎপাদন বাড়ানো প্রয়োজন। এই সমস্যা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে ধানের খেতে হাঁসের প্রতিপালন। লিখেছেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি আবহাওয়া ও পদার্থবিদ্যা বিভাগের গবেষক দোলগোবিন্দ পাল ও অধ্যাপক শাওন বন্দ্যোপাধ্যায়।
আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য হল ধান। কৃষি ও কৃষক, দেশ ও জাতির খাদ্য নিরাপত্তা ও জীবন-জীবিকা দাঁড়িয়ে আছে ধান উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে। শুধু তাই নয়, এখানকার মাটি ও জলবায়ু ধান চাষের অনুকূল। বৃষ্টি নির্ভর এলাকায় বর্ষাকাল তথা খারিফ মরশুমে ধানই একমাত্র ফসল। যেখানে সেচের সুবিধা আছে সেখানে বোরো মরশুমেও ধান চাষ হয়ে থাকে। ধান উৎপাদনে ভারতের স্থান দ্বিতীয়। ভারতে প্রায় সব রাজ্যের ধান চাষ হয়। তবে দেশের মোট উৎপাদনের অর্ধাংশ পাওয়া যায় অন্ধ্রপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাব রাজ্য থেকে।
ভারতে প্রায় ৪৩.১৬ মিলিয়ন হেক্টর জমি থেকে ১১.৮৮ মিলিয়ন টন ধান উৎপন্ন হয়। এই পরিসংখ্যান থেকে বলা যেতে পারে ভারত ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে । কিন্তু ভারতের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার তুলনায় পোলট্রি-মাংস ও ডিম উৎপাদন অনেকটাই কম। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ (ICMR)-এর নির্দেশ অনুযায়ী, একজন মানুষের বছরে গড়ে ১০.৫ কিলো পোলট্রি-মাংস এবং ১৮০ টি ডিম খাওয়া প্রয়োজন। অথচ বর্তমানে ভারতের মানুষ বাৎসরিক মাথাপিছু ৩.৫ কিলো মাংস ও ৯১ টি ডিম গ্রহণ করছে। তাই মাথাপিছু পোলট্রি-মাংস ও ডিমের উৎপাদন বাড়ানো অতীব প্রয়োজন। আর এই সমস্যা দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে ধানের ক্ষেতে হাঁসের প্রতিপালন।
হাঁস পালন আমাদের দেশে একটি আদি এবং প্রচলিত পদ্ধতি। গ্রামের মানুষেরা শুধু ডিম ও মাংসের চাহিদা পূরণ ও পারিবারিক আয়ের জন্য সীমিত আকারে হাঁস পালন করে থাকে। এ দেশে বাণিজ্যিক মুরগির খামারের ন্যায় হাঁসের খামার তেমন গড়ে ওঠেনি। এমনকি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ধানের জমিতে হাঁস পালনও তেমনভাবে দৃষ্টিগোচর হয় না। তাই ভারতবর্ষের এই বিপুল পরিমাণ ধান চাষ যোগ্য জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে ধানের পাশাপাশি একই সঙ্গে হাঁস পালন করতে পারলে মাংস ও ডিমের উৎপাদন অনেক গুণ বাড়ানো সম্ভব।
[আরও পড়ুন: আখ চাষে প্রধান বাধা পোকা, রোগ ঠেকালেই বিপুল আয়ের সম্ভাবনা]
ধান চাষ করার সময় ধানের চারা অবশ্যই ২৫ × ২০ সেমি দূরত্বে লাইনে রোপণ করতে হবে। জমি তৈরির জন্য শেষ চাষের সময় ৫ টন প্রতি হেক্টর হারে জৈব সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন। চারা রোপণের ৭ থেকে ১৫ দিন পর প্রতি হেক্টর ধানের জমিতে ৩০ দিন বয়সের ৩০০ থেকে ৪০০ টি হাঁসের বাচ্চা ছেড়ে দিতে হবে। ধানের স্বাভাবিক চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে এবং ধানক্ষেতে সবসময় পাঁচ থেকে সাত সেন্টিমিটার জল ধরে রাখতে হবে। যাতে হাঁসগুলি অবাধে এবং সহজে ধানের জমিতে চলাফেরা করতে পারে। উপযোগী হাঁসের জাতগুলোর মধ্যে খাঁকি ক্যাম্বেল, নাগেশ্বরী, ইন্ডিয়ান রানার, হোয়াইট পিকিং, জিং ডিং, চেরিভেলি উল্লেখযোগ্য।
ধানখেতে হাঁস ছাড়ার আগে কিছুদিন বাড়ির আশেপাশে চরিয়ে অভ্যাস করতে হবে। হঠাৎ করে ধানক্ষেতে হাঁস ছাড়া যাবে না। প্রথম প্রথম ৫-৭ দিন বাড়িতে পালন করা হাঁসগুলোকে ধানের জমিতে সকালে ও বিকালে ২ ঘণ্টা করে ৪ ঘণ্টা রাখতে হবে। এরপর থেকে ধানের জমিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাখা যেতে পারে। হাঁস জমিতে চরার সময় কাঁকড়া, ব্যাঙ সহ জলজ প্রাণী ও আগাছা খাবে। এগুলো হাঁসের পুষ্টিকর খাবার। ধানক্ষেতে হাঁসের খাদ্য কমে গেলে বাড়িতে হাঁসকে চাল বা গমের গুঁড়ো, ভুসি, খোল, ঝিনুক চূর্ণ ইত্যাদি খাওয়াতে হবে। তবে ধানে ফুল আসার শুরুতেই জমি থেকে হাঁস সরিয়ে নিতে হবে।
এরপর ক্ষেতে হাঁস চরালে, ধান খেয়ে ফেলতে পারে। ধানের জমি থেকে হাঁস সরিয়ে নেওয়ার পর পুকুর এবং প্রাকৃতিক জলাভূমিতে সেগুলি পালন করা যেতে পারে। ডিম পাড়া হাঁসের বয়স দুই থেকে আড়াই বছর হলে বিক্রি করে নতুন হাঁসের বাচ্চা পালন করতে হবে।এই পদ্ধতিতে ধানক্ষেতে হাঁস চলাফেরার সময় কচি আগাছা (Duck-weed) খায় এবং ঠোঁট ও পা দিয়ে আগাছা নষ্ট করে। ফলে ধানের জমিতে কোন ভাবেই আগাছা জন্মাতে পারে না। আগাছা দমনের জন্য আলাদাভাবে শ্রমিক ও আগাছানাশক কোনটারই প্রয়োজন হয় না; খরচ কিছুটা হলেও বেঁচে যায়। ধানের রোগ পোকা দমনের জন্য কীটনাশক এর প্রয়োজন হয় না।
হাঁস পোকা খেয়ে ধানক্ষেত রক্ষা করে। ফলে কীটনাশক এর জন্য প্রয়োজনীয় খরচ সাশ্রয় হয়। এছাড়াও ধানের জমিতে হাঁসের চলাফেরার কারণে প্রাকৃতিক ভাবে জমির জলে বাতাস চলাচলের হার বেড়ে যায়। এর ফলে যেমন-মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড এর মতো গ্রীনহাউস গ্যাস কম নির্গত হয়, তেমনই জমিতে প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক উপাদান যেমন- নাইট্রোজেন, ফসফরাস ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়। ফলস্বরূপ ধান গাছের শিকড় ও পাশ কাঠির সংখ্যা বেশি হয় এবং সর্বোপরি ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এই সমন্বয় পদ্ধতিতে হাঁস দিনের বেলায় ধানের জমির আগাছা ও কীটপতঙ্গ খেয়ে বড় হয়। এজন্য হাঁসের খাবারের খরচ কম লাগে। আবার হাঁসের বিষ্ঠা জমিতে পড়ে জমিও উর্বর হয়। অন্যদিকে একটি হাঁস বছরে গড়ে প্রায় ৯ মাস ডিম দিয়ে থাকে। প্রজননের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুরুষ হাঁস রেখে বাকি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হাঁসগুলোকে মাংসের জন্য বিক্রি করা যেতে পারে। অর্থাৎ একই জমি থেকে ধান, মাংস ও ডিম পাওয়া যায়।
বাজারে হাঁসের ডিম ও মাংসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্যান্য কারণবশত ধান নষ্ট বা ফলন কম হলেও হাঁস থেকে ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেওয়ারও সুযোগ থাকে। তাই বলা যেতে পারে ধানের সঙ্গে হাঁসের চাষ বা ধানক্ষেতে হাঁস চাষ নিঃসন্দেহে লাভজনক এবং বাড়তি আয়ের একটি সহজ উপায়। তাছাড়া ওড়িশার কটকে অবস্থিত ন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (NRRI) ধানকেন্দ্রিক হাঁস, মাছ, অ্যাজোলা ইত্যাদি সমন্বিত চাষের মাধ্যমে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত নিরাপত্তার কথাও বলেছেন। এশিয়া মহাদেশীয় বিভিন্ন দেশগুলিতে যেমন- জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, চিন ও ইন্দোনেশিয়ায় ধানের জমিতে হাঁস, মাছ, অ্যাজোলা চাষের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই আমাদের দেশেও চাষিভাইদের ধান কেন্দ্রিক সমন্বয়কৃষি অনুশীলনে উৎসাহিত করতে কৃষি ও কৃষক কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।