shono
Advertisement

মাটিবাহিত রোগ ব্যাপক ক্ষতি করে ফসলের, জেনে নিন সমাধানের উপায়

জেনে নিন বিশেষজ্ঞদের মত।
Posted: 10:05 PM Sep 25, 2021Updated: 10:06 PM Sep 25, 2021

মৃত্তিকাবাহিত রোগগুলির কারণে বিভিন্ন ফসলে প্রায় ৫০% পর্যন্ত ক্ষতি হয়ে থাকে। মোট উৎপাদন ঘাটতির ১০-২০ শতাংশ শুধুমাত্র মৃত্তিকাবাহিত রোগগুলির কারণে হয়। লিখেছেন বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালেয়র উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সুব্রত দত্ত ও ড. পার্থপ্রতিম ঘোষ।

Advertisement

যেসব রোগের জীবাণু মাটিতে বা মাটিতে থেকে যাওয়া ফসলের অবশিষ্টের মধ্যে বেঁচে থাকতে পারে সেইসব জীবাণুঘটিত রোগগুলিকে মৃত্তিকাবাহিত রোগ বলা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরা মাটির নিচেই সংক্রমণ শুরু করে, ফলে রোগের প্রাথমিক লক্ষণ ফসলের বৃদ্ধিদশার বেশ অনেকটা সময় অবধি দৃষ্টিগোচর হয় না। মাটির উপরের অংশে যখন রোগলক্ষণ প্রকাশ পায়, তখন প্রায়শই কোনও সুরক্ষা ব‌্যবস্থা গ্রহণ করেও খুব একটা লাভ হয় না। ফলে ফসলের বাণিজ্যিক অংশগুলির (বীজ, কন্দ, আনুভূমিক স্ফীত কাণ্ড) এবং অন‌্যান‌্য সহায়ক অংশগুলির (মূল ও কাণ্ডের সংযোগস্থল এবং সংবহন কলা কোষ) যে অপূরণীয় ক্ষতিসাধন হয় তাতে ফসলের সমগ্র ক্ষতির পরিমাণ অন‌্যান‌্য রোগের চেয়ে বহুগুণ বেশি হয়।

মৃত্তিকা বাহিত রোগ সম্পর্কে জানা বা সচেতন হওয়া জরুরি কেন?

মৃত্তিকাবাহিত রোগগুলি ফসলে খুব কম হলেও প্রায় ৫০% অবধি ক্ষতি হয়ে থাকে। পরিসংখ‌্যান অনুযায়ী মোট উৎপাদন ঘাটতির ১০-২০ শতাংশ শুধুমাত্র মৃত্তিকাবাহিত রোগগুলির কারণে সংগঠিত হয়। সাম্প্রতিককালে ফসলের মৃত্তিকা বাহিত রোগজীবাণুগুলি চাষের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সব ধরনের মানুষের কাছে বিশেষ চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা, একই ফসলের বারবার চাষ, কৃষিকাজে ক্রমবর্ধমান রাসায়নিক নির্ভরশীলতা ও কৃষির নিবিড়ায়ন মৃত্তিকাবাহিত রোগগুলির বাড়বাড়ন্তের অন‌্যতম কারণ। এখনই এই সব রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ভবিষ‌্যতে আরও শোচনীয় অবস্থা প্রত‌্যক্ষ করতে হতে পারে। উপরন্তু বিভিন্ন জলবায়ুতে এদের বিস্ময়কর অভিযোজন ক্ষমতার জন‌্য এই জাতীয় রোগ সমস‌্যার প্রবন্ধণ জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে।

মৃত্তিকাবাহিত রোগ সহজে প্রতিকার করা যায় না কেন?

১. মৃত্তিকাবাহিত রোগজীবাণুর প্রবন্ধণের জটিলতার কারণ হিসাবে বলা যায়, ফসলের জাতগুলির সহজাত প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব, রোগ জীবাণুগুলির উচ্চমাত্রার জিনগত অনবস্থতা, তাদের একাধিক উদ্ভিদ প্রজাতিকে আক্রমণ করার ক্ষমতা এবং এইসব রোগজীবাণুর মাটিতে সুদীর্ঘ উত্তরজীবিতা (Survival)।
২. মৃত্তিকা বাহিত রোগজীবাণুগুলি সাধারণত গুপ্তঘাতক। ফলে এদের উপস্থিতির লক্ষণ প্রকাশ পেতে প্রায়শই দেরি হয় এবং তখন প্রতিকার ব‌্যবস্থা স্বভাবতই বাণিজ্যিকভাবে সফল হয় না।
৩. মৃত্তিকাবাহিত রোগজীবাণুদের মধ্যে অতিরিক্ত মাত্রায় জীনগত বৈচিত্রের কারণে এইসব রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে সংবেদনশীল ফসলের প্রতিরোধী জাত উৎপাদন বেশ কঠিন হয়। উপরন্তু মৃত্তিকাবাহিত বিভিন্ন জীবাণু। যেমন, রাইজোক্টোনিয়া সোলানি, র‌্যালস্টোনিয়া সোলানেসেরিরাম, সক্লেরোসিয়াম রলফসি ও সক্লেরোটিনিয়া সক্লেরাসিওরাম উদ্ভিদ জগতের প্রায় ২৫টির বেশি পরিবারভুক্ত বিভিন্ন প্রজাতিতে (একবীজপত্রী ও দ্বিবীজপত্রী নিরপেক্ষভাবে) সংক্রমণ করতে পারে এবং মাটিতে সুপ্তদশায় বহুদিন বেঁচে থাকতে পারে। অনেক সময় পরজীবী মৃত্তিকা কৃমি মাটিতে বসবাসকারী রোগ জীবাণু যেমন ব‌্যাকটিরিয়া(র‌্যালস্টোনিয়া সোলানেসেরিয়াম) ও ছত্রাক (ফিউসেরিয়াম ইত‌্যাদি)-এর আক্রমণ বৃদ্ধি করে ফসলের ব‌্যাপক ক্ষতি করে।
৪. কৃষিতে ক্রমবর্ধমান রাসায়নিক নির্ভরতা ও মাটির জৈবকার্বনের ঘাটতির ফলে মাটিতে বসবাসকারী উপকারী জীবাণুর সংখ‌্যা ক্রমশই কমে যাচ্ছে। ফলস্বরূপ মৃত্তিকাবাহিত রোগজীবাণুর সংখ‌্যা কৃষিজমিতে ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৫. ফসল বৈচিত্রে‌র অভাব ও একই জমিতে বারবার সমগোত্রীয় ফসলের চাষ মৃত্তিকাবাহিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
৬. কৃষকবন্ধুদের মধ্যে জৈব ছত্রাকনাশক ও তার ব‌্যবহারবিধির সম্বন্ধে সম্যক ধারণার অভাব।
৭. বায়ুবাহিত রোগজীবাণুর গৌণ বিস্তার প্রতিরোধ করার চেয়ে মৃত্তিকা বাহিত রোগজীবাণুর গৌণ বিস্তার প্রতিরোধ করা অনেক বেশি কষ্টসাধ‌্য। কারণ, উদ্ভিদের পত্রসমষ্টিকে আরোগ‌্য-সহায়ক রাসায়নিক দিয়ে যত ভালভাবে ভেজানো যায় মাটিতে রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে আরোগ‌্য-সহায়ক রাসায়নিক প্রয়োগ ততটা সহজসাধ‌্য নয়। এই জন‌্যই আরোগ‌্য-সহায়ক-প্রতিকার ব‌্যবস্থা মৃত্তিকাবাহিত রোগজীবাণুর ক্ষেত্রে বাণিজ্যিকভাবে সফল হয় না।
৮. অনেক রোগজীবাণু পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে যখন একই সঙ্গে সংক্রমণ ঘটায় তখন একটি যৌগিক রোগ জটিলতা সৃষ্টি হয়, যার শনাক্তকরণ, রোগনির্ণয় এবং নিয়ন্ত্রণ বেশ জটিল হয়ে ওঠে। যেমন, আদার রাইজোম পচা, পাটের ঢলে পড়া (Hooghly wilt) ইত‌্যাদি।
মাটিবাহিত জীবাণুর কিছু মাটিতে স্থায়ীভাবে, কিছু স্বল্পকাল বাস করে। আরও কিছু মাটির সহায়তায় হামলা আক্রমণ ঘটায়। সরষে বা বাঁধাকপির ‘শিকড় ফোলা’ রোগ জীবাণু প্লাসমোজিওফোরা, নানা সবজি ও ফুলের ‘চারাধসা’ ঘটানো পাইথিয়াম ও ফাইটফথোরা, নানা ফসলের ‘শিকড়, গোড়া ও কন্দে পচন’ ধরানো সক্লেরোটিনিয়া, সক্লেরোসিয়াম ও ম‌্যাক্রোফোমিনা ছত্রাকগুলি অথবা বহু ফসলের ‘ঢলে পড়া’ সৃষ্টিকারী ছত্রাক ফিউসেরিয়াম, ভাটিসিলিয়াম ও ব‌্যাক্টিরিয়া র‌্যালস্টোনিয়া জীবাণুগুলি ‘মাটিবাহিত’। এছাড়া আলুর ‘খোসরোগে’র কারণ স্ট্রেপটোমাইসেস এবং বহু সবজির ‘শিকড় ফোলা’ রোগসৃষ্টিকারী কৃমি জীবাণু-মেলয়ডোগাইনি, গ্লোবডেরা ও হেটারোডেরাও মাটিবাহিত।

মাটিতে এই রোগজীবাণুগুলি নানাভাবে বেঁচে থাকে। মাটিতে স্থায়ী বসবাস করা জীবাণুগুলি ‘ক্লামাইডোম্পোর’, ‘উওস্পোর’, ‘সক্লেরোসিয়া, ‘বাইজোমরফ’ প্রভৃতি ‘জিরেনঅঙ্গ’ তৈরি করে টিকে থাকে। অনুকূল পরিস্থিতিতে অঙ্কুরোদগম করে নতুন সংক্রমণ ঘটায়। মাটিতে অথবা ফসলের ‘মরা অঙ্গে’ মৃতজীবী হয়েও কয়েকদিন থেকে কয়েকমাস টিকে থাকে। মাটিতে থাকে না কিন্তু এসে ‘হামলা’ করে যারা, তারা ফসল অঙ্গে ছত্রাক সূত্র হয়ে মৃতজীবী বা সুপ্ত থাকে এবং অনুকূল আবহাওয়ায় বৃদ্ধি পেয়ে নতুন ফসলে আক্রমণ ঘটায়।

শিকড় পচা রোগে মাটির ম‌্যাক্রোফোমিনা, রাইজকটনিয়া প্রভৃতি জীবাণুর সংক্রমণে কাণ্ডে বাদামি ক্ষত দাগ হয় এবং গাছ ঝলসে যায়। তবে পাটের কাণ্ডে লম্বাটে পচনের কালো দাগটি ‘তারজালে’র মতো দেখায় এবং গাছ শুকিয়ে যায়। সক্লেরোসিয়া জনিত গোড়া পচাতে আক্রান্ত চারার গোড়া ঘিরে সাদা রেশমি সুতোর মতো ছত্রাক দেখা যায়। ঢলে পড়া গাছের গোড়া (বেগুন, টম্যাটো, লঙ্কা, আলু) কেটে পরিষ্কার জলে ডোবালে আধ ঘণ্টায় জল ঘোলাটে সাদা হয়। ওই ব‌্যাক্টিরিয়ার অসংখ‌্য ‘কোষ’ বেরিয়ে জল ঘোলা করে। এসব রোগজীবাণু কাছে বা দূরে ছড়ায় এবং আক্রান্ত ফসলে এরা প্রচুর পরিমাণে সংখ‌্যা বৃদ্ধি করে। তারপর জমিতে নিড়ান বা লাঙল দেওয়া বা পরিচর্যার সময় মাটি স্থানান্তরে, নিড়ানির গায়ে ও চাষির হাতে পোশাকে লেগে অন‌্য ফসলে যায়। সেচের জলে (পাইথিয়াম গোষ্ঠী) বা বাতাসেও জীবাণু ছড়ায়।

ঝড়বৃষ্টি এবং বন‌্যায় কোনও কোনও জীবাণু ছড়ায়। এছাড়া একই জমিতে একই ফসল পরপর চাষ করলে এসব জীবাণুর টিকে থাকা ও ছড়ানোর প্রবণতা বাড়ে। মাটির উর্বরতা এবং জৈব ও অজৈব অংশগুলির প্রভাবও এই রোগজীবাণুর উপর পড়ে। জমি বেশি নাইট্রোজেনে পুষ্ট হলে, নধর ফসলের দেহে জীবাণুর সংখ‌্যা বৃদ্ধি হয় বেশি। অ‌্যামোনিয়াম সালফেট, নাইট্রোফস প্রভৃতি সার মাটিতে অম্লতা বাড়ায়। এসব মাটিতে ‘ঢলে পড়া’ ও ‘গোড়া পচা’ রোগ বাড়ে। এভাবে শিকড় ফোলাও বাড়ে। আবার পটাশিয়াম, ম‌্যাগনেশিয়াম ও অনুখাদ‌্য বেশি থাকলে এসব রোগ কম হয়। মাটির জৈব পদার্থ ও তাপমাত্রা বেশি-কম হলেও প্রভাব পড়ে এই রোগগুলির উপর। তবে বেশি বাড়ে মাটির আর্দ্রতা বাড়লে এবং দুর্বল নিকাশি হলে।

[আরও পড়ুন: বিশেষ প্রযুক্তিতে কাঁকড়া চাষের জনপ্রিয়তা বাড়ছে জেলায়, অল্প ব্যায়ে লাভের মুখ দেখছেন কৃষকরা]

মাটিবাহিত এই রোগজীবাণু নিয়ন্ত্রণ বেশ শক্ত। এই জীবাণুগুলি জিনগতভাবে পরিবর্তনক্ষম, বহু ফসলকে আক্রমণ করে। মাটিতে এরা স্বল্প থেকে বহুদিন টিকে থাকে প্রায় অদৃশ‌্য হয়ে। এদের অনেকের আক্রমণ টের পাওয়া যায় অনেক পরে। তাই নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ করতে দেরি হয়ে যায়। এই রোগগুলির প্রতিরোধী বা সহনশীল জাতও বেশ কম। রাসায়নিক বা অন‌্য নিয়ন্ত্রক এদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করাও বেশ কঠিন মাটিতে মিশে থাকার জন‌্য। আবার আদা ও ভুট্টার নরম পচা, পাটের হুগলি-ঢলে পড়া, পেয়ারার গাছ শুকানো প্রভৃতি ক্ষেত্রে একাধিক মাটিবাহিত জীবাণু রোগ সৃষ্টি করে, তাই নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। নিবিড় শস‌্যচাষে সারা বছরে জীবাণুগুলি একটা না একটা ‘পোষক ফসল’ পেয়েই যায়। তাই এ ধরনের জীবাণুকে উৎখাত করা অতি কঠিন।

সব শেষে ফসলের ক্ষেত্রে এই রোগগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে সময় বাছা হয়, যখন জীবাণুগুলি সবচেয়ে দুর্বল বা অরক্ষিত থাকে। প্রথমে বর্জ‌্য বেছে সরিয়ে ধ্বংস করতে হয়। ওই মাঠে ব‌্যবহৃত যন্ত্রপাতি বা চাষির হাত-পা পোশাক ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। ওই জীবাণুর পোষক আগাছা হলেও ধ্বংস করতে হবে। গভীর লাঙল করা, চুন দিয়ে মাটির অম্লতা সংশোধন করে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। রোগমুক্ত কন্দ ও বীজ নির্বাচন করে, রাসায়নিক বা জীবাণু নিয়ন্ত্রক দিয়ে শোধন করা দরকার। মাটি চষে একটু ভিজিয়ে স্বচ্ছ পলিথিন শিটে ঢেকে সূর্যালোকে ক’দিন মাটির উষ্ণতা বাড়ালে ‘রৌদ্রায়ন’ হবে। চারা ধসার মাঠে জল নিকাশ ব‌্যবস্থা থাকতেই হবে। পলিথিন ট্রেতে চারা তৈরি করে চারাধসার আক্রমণ অনেকটা রোধ করা যায়। আক্রান্ত মাঠে নির্বাচিত রাসায়নিক নিয়ন্ত্রকে গাছের গোড়া ভেজানো বা গুঁড়ো রাসায়নিক ছড়ানো অথবা জীবাণুভিত্তিক নিয়ন্ত্রক যেমন ট্রাইকোডার্মা, সিউডোমোনাস, প‌্যাসিলোমাইসেস গাছের গোড়ায় ও মাটিতে প্রয়োগ করতে হবে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement