নির্মল ধর: পৃথিবীর সব বড় শহরের হৃদয়ে এক জাদু মায়া থাকে। শুধু কলকাতা নয়। লন্ডন, প্যারিস, মেক্সিকো, টোকিও সব শহরেরই। তবে আমরা কলকাতাবাসী, তাই কলকাতা শহরের মায়াটা আত্মীকরণ করতে পারি, হয়তো অন্য শহরের ব্যাপারটা তেমন পারি না। পরিচালক আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্ত গত কয়েক বছর কলকাতা ছেড়ে এখন মুম্বইকার। সুতরাং তিনি এই শহরের জাদু মায়াটা কী, কেমন সেটা হৃদয়ে উপলব্ধি করেন এবং করেছেন বলেই 'মায়ানগর' নামের ছবিটির চিত্রনাট্য লিখতে পেরেছেন। এই শহরের দারিদ্র্য, অলিগলির আনাচ-কানাচ যেমন তিনি চেনেন, তেমনই উপলব্ধি করেন এখানকার মানুষের অসহায় অবস্থা। এই শহরে একজন নারীর একা বেঁচে থাকার ঝক্কি ঝামেলা কিংবা নাটক পাগল এক বয়স্ক মানুষের উন্মাদনার পাশাপাশি একজন, দুজন মানুষের অতিরিক্ত লোভের কারণে আরও কিছু মানুষের সর্বনাশ ঘটানোর আর্থিক স্ক্যাম, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন, দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি- এই সব ছেঁড়া-ছেঁড়া গল্পের একটি কোলাজ বিক্রমের তিন নম্বর ছবি 'মায়ানগর' এর মূল বিন্দু বা নিউক্লিয়াস বলতে পারি।

একমাত্র কিশোরী সন্তানহারা মা এলা,তাঁর স্বামী শিশির, থিয়েটার হলের বয়স্ক ও মানসিক ভারসাম্যহীন মালিক বুবু, প্রতিবেশী তরুণ রাজা, সেই হলের পুরোনো প্রবীণ কর্মচারী রাজার বাবা, কল্পতরু নামের চিট ফান্ড ও লোকাল চ্যানেলের মালিক অনির্বাণ চক্রবর্তী এলার পুরোনো প্রেমিক ইঞ্জিনিয়ার কাম দুনম্বরি কন্ট্রাক্টর ভাস্কর - এই কটি চরিত্র নিয়েই আদিত্য বিক্রম সাজিয়েছেন তাঁর 'মায়ানগর'- এর চিত্রনাট্য। জিগস পাজেলের মতো টুকরো টুকরো অংশ দিয়ে বছর দশ পনেরো আগের কলকাতা শহরের এক সুন্দর কলকাতার ছবি উপহার দিয়েছেন তিনি। সেই সৌন্দর্যের মধ্যে মায়ানগরীর আলো-আঁধারিও উপস্থিত। স্বামী শিশিরের সঙ্গে বরফ শীতল সম্পর্ক ছেড়ে নিজের মতো বাঁচার জন্য মধ্যবয়সী এলাকে পারিবারিক সম্পর্কের বাইরে গিয়ে কোন জটিল গহ্বরে পড়তে হয়, বা বয়স্ক বুবু তাঁর থিয়েটার হল চালানোর পুরোনো স্মৃতি নিয়ে এতোদিন পরেও আবার ভেঙে পরা হলটিকে (সারকারিনা) খোলার ব্যর্থ স্বপ্ন দেখেন। গরিব মানুষদের দ্রুত অধিক লাভের স্বপ্ন দেখিয়ে চিটফান্ড খুলে তাঁদের পথে বসিয়ে দেওয়ার ব্যাপার কিংবা পুরোনো ভাস্কর অনেকদিন পর পুরোনো প্রেমিকা এলাকে কাছে পেয়ে এক রাতের জন্য ঘনিষ্ঠ হয়ে আবার মরীচিকার মতো সরে যায়। এই সব ঘটনা এই মায়ানগর কলকাতাতেই ঘটে। এতোসব ঘটন-অঘটনের মধ্যেও কলকাতা বাঁচে। বাঁচিয়ে রাখে এই শহরবাসীর স্বপ্ন, আহ্লাদ, দুঃখ, বিষাদ-আনন্দ। আবার কিছু মায়া রেখেও যায়, যার টানে বার বার ফিরে আসতে হয় এই কলকাতার মাটিতে। যেমন আসেন পরিচালক আদিত্য।
দীর্ঘসময় মুম্বইয়ে থেকেও বিক্রম দত্ত সিনেমা তৈরির জন্য রসদ নেন এই মায়াভরা নগর থেকেই। তাঁর আগের দুটি ছবির তুলনায় এই ছবির বুনট অনেকটাই সরল ন্যারেটিভ সাজানো। সেই সাজানোটাকেও আদিত্য দর্শকের জন্য একটু বুদ্ধি খেলানোর জায়গা রেখেই করেছেন। আর এখানেই 'মায়ানগর' হয়ে ওঠে নান্দনিক ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ। হয়তো কিছু দর্শকের কাছে ধীর গতি বা কিঞ্চিৎ জটিল ধাঁধার মতো লাগতে পারে, কিন্তু তিনি তাঁর সিনেমা ভাবনায় কোনো আপোস করেননি। এখানেই ছবির গায়ে লেগে থাকে শিল্পগুণ। তবে ছবির দ্বিতীয় পর্বে চিত্রনাট্য আরও একটু সুগ্রথিত হলে ভাল হত। আদিত্যের সাহিত্যগুণ সমৃদ্ধ সিনেমা ভাবনাকে জীবন্ত করে তুলতে সাহায্য করেছেন একগুচ্ছ শিল্পী। যার প্রথমজন হলেন শ্রীলেখা মিত্র। এলা চরিত্রে শ্রীলেখা আরও একবার বাংলা সিনেমার লোকজনদের জানিয়ে দিলেন তিনি কোন শ্রেণীর অভিনেত্রী। তবে লুপ হোলস রয়েছে কিছু। এলা চরিত্রে শ্রীলেখা মিত্র ছবির শুরুতেই প্রায় প্রথম দৃশ্যে পানীয়ের গ্লাস মুখে নিয়ে সদ্য মেয়ে হারানোর দুঃখ ও বেদনা যেভাবে মূর্ত করলেন, আশা ছিল পুরো ছবিতেই তাঁকে অন্য মূর্তিতে পাব। সেটা হয়নি। কারণ যদি চিত্রনাট্যের খামতি হয়, একজন সিজনড অভিনেত্রী তো সেই খামতি পূরণ করবেন তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে। দুঃখের বিষয় সেটা পেলাম না।
ব্রাত্য বসু হয়েছেন স্মৃতিভারাক্রান্ত হলমালিক বুবু। মাত্র তিন চারটি দৃশ্যেই তিনি বুঝিয়ে দেন তাঁর আস্তিনে এখনও লুকোনো রয়েছে কতগুলো অচেনা তীর। ব্রাত্য প্রমাণ করে দিলেন নির্দেশকের নির্দ্দেশ মেনেও অভিনীত চরিত্রে অভিনেতা কীভাবে বাড়তি ডাইমেনশন জুড়ে দিতে পারেন। এলার স্বামী শিশিরের চরিত্রে খুব শান্ত ও নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে চরিত্রটির নিরাসক্ত ভাবটি সুন্দর প্রকাশ করেছেন। তবে শিশিরের সঙ্গে এলার সম্পর্ক অমন শীতল কেন, তার কোনও যুক্তি পাওয়া গেল না ছবিতে। ভাস্করের চরিত্রে প্রবাসী নতুন মুখ অরিন্দম ঘোষ এক ধরনের শান্ত ভণ্ডামির প্রকাশ দেখিয়েছেন। অনির্বাণ চক্রবর্তী সত্যিই দিনকে দিন ছবি থেকে ছবিতে নিজেকে নানাভাবে মেলে ধরছেন! রাজার চরিত্রের তরুণ শিল্পীও এত অভিজ্ঞ অভিনেতাদের পাশে দাঁড়িয়ে বেশ সপ্রতিভ ও সাবলীল। আলোচনার শেষে কথা একটাই, কলকাতা যেমন সংবেদনশীল কলকাতাবাসীর কাছে এক মায়ানগর, তেমনই পৃথিবীর সব শহরই সেই শহরবাসীর কাছে সংবেদনশীল। সব শহরই এক মায়ানগর। কলকাতার এই যাপনচিত্র অবশ্য একান্তই ব্যক্তিগত কলকাতার। অন্য কোনও শহরের সঙ্গে তুলনা করার মতো নয়।