শাহজাদ হোসেন, জঙ্গিপুর: কেউ আঁকল রঙিন ফুল, কেউ সবুজ মনের প্রতিচ্ছবি পাতা, কেউ আবার মাথা বাঁচাতে বর্ষার ছাতা। রং-তুলিতে ফুটে উঠল ‘আ মরি বাংলা’ও। কিন্তু তার মনের ক্যানভাসের গভীর ক্ষত তুলে আনল একটি বার্তা। ‘নো রেপ’। মাইকে তখন সাগরদিঘি থানার এক কর্তার ঘোষণা, ‘‘এই সময়ের ঢেউ আছড়ে পড়েছে যার ক্যানভাসে, অঙ্কন প্রতিযোগিতায় প্রথম ক্লাস নাইনের সেই রিকিতা চন্দ।’’ সুসজ্জিত মঞ্চের একেবারে সামনে এসে একজন তার আঁকা ছবিটি তুলে ধরলেন কয়েকশো মানুষের সামনে। নাহ, হাততালি পড়ল না। এক অদ্ভুত নীরবতা গ্রাস করেছে সবাইকে। আর জি কর-কাণ্ড এক কিশোরীর মনে কতটা গভীর প্রভাব ফেলেছে, বুঝে নিতে অসুবিধা হল না কারও। রিকিতার হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন সাগরদিঘি থানার ওসি বিজন রায়। তখনও কেমন যেন স্থির নিকিতার দৃষ্টি। প্রতিবাদী।
জঙ্গিপুর পুলিশ জেলার তরফে সাগরদিঘি থানায় রবিবার রক্তদান শিবিরের পাশাপাশি হয় ছাত্রছাত্রীদের জন্য অঙ্কন প্রতিযোগিতা। সেই অঙ্কন প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন স্কুল থেকে প্রায় ৮০ জন অংশ নিয়েছিল। আর আর জি কর-কাণ্ডে নিজের মতো করে যে ভাবে প্রতিবাদ ও আর্তি রং-তুলিতে তুলে ধরল নবম শ্রেণির মেয়েটি, তা দৃষ্টান্ত বলেই মনে করছেন বিচারক থেকে আয়োজক থানার পুলিশও। উপস্থিত ছিলেন অভিনেতা রবীন দত্ত ও রক্তযোদ্ধা সঞ্জীব দাস। তাঁরা বলেন, ‘‘একটা নৃশংস ঘটনা ছাত্রছাত্রীদের মনেও কতটা প্রভাব ফেলতে পারে, রিকিতার ক্যানভাস তাই দেখিয়ে দিল। আমরা যারা বড়, বিষয়টি নিয়ে তাদেরও ভাবা প্রয়োজন।’’ ওসি বিজন রায় জানান, ছাত্রীর এই মানসিকতাকে কুর্নিশ জানাই। পুলিশের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তার চিন্তাভাবনা অঙ্কনের মাধ্যমে ফুটিয়ে ছাত্রীটি সবাইকে সচেতনতার বার্তা দিয়েছে। পাশাপাশি সবাইকে এটাও ভাবতে হবে পুলিশ সমাজের বন্ধু। যে কোনও অপরাধ সংঘটিত হলে তা নিরসনে প্রশাসনের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন।
[আরও পড়ুন: ১৫ দিন টানা জেরা, অবশেষে সিবিআইয়ের হাতে গ্রেপ্তার সন্দীপ ঘোষ]
আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া উচিত নয়। ধর্ষণের মতো ঘটনা বন্ধে মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন তা ছাত্রীটি অঙ্কনের মাধ্যমে বার্তা দেওয়ায় আমাদের বিচারে তা সেরা ছবির স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।’’ রিকিতার মা মাধবী চন্দ জানান, মেয়ে প্রথাগতভাবে আঁকা শেখে না। কিন্তু আঁকতে ভালোবাসে। আর প্রতিযোগিতাতে যেহেতু কোনও বিষয় নির্দিষ্ট ছিল না, তাই মনের মধ্যে গুমরে থাকা কষ্ট থেকেই হয়তো এই ছবিটা এঁকেছে। আমিও শুনে কেঁদে ফেলেছি। আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি, একটা খুব খারাপ ঘটনা কীভাবে তার মনে চেপে বসেছিল। প্রকাশের এই জায়গা না পেলে হয়তো জানতেই পারতাম না, মেয়ের এই প্রতিবাদী মন।’’ রিকিতা থাকে সাগরদিঘি থানার পাশাপাশি। বাবা পুলিশকর্মী। নদিয়ায় কর্মরত। আর জি কর-কাণ্ডের পর বাবা ছুটিতে বাড়ি এলেও রিকিতা কিন্তু এসব নিয়ে একদিনও প্রশ্ন করেনি। তবে রিকিতার দাদা বলেন, ‘‘আসলে আমাদের সাগরদিঘিতেই দুই বড় নাগরিক মিছিল হয়েছে। সেগুলি দেখেছে বোন। তাছাড়া টিভি খুললেই তো...।
[আরও পড়ুন: সায়নের জামিনের বিরোধিতা, সুপ্রিম কোর্টে খারিজ রাজ্যের মামলা]
হয়তো মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল আর জি করে ঘটে যাওয়া নৃশংসতা। তাই ছবি এঁকে ‘নো রেপ’ বার্তা বোনের।’’ স্থানীয় একটি বেসরকারি স্কুলে পড়ে মেয়েটি। তার সঙ্গে তার স্কুলের আরও ২০ জন এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল। রিকিতা বলে, ‘‘শনিবার বিকালে স্কুল থেকে মাকে ফোন করে জানায়, সাগরদিঘি থানার ওই আঁকা প্রতিযোগিতায় আমার নাম পাঠানো হয়েছে। আমি আঁকতে ভালোবাসি। তাই গিয়েছিলাম। কিছু ভেবে যাইনি। কিন্তু...।’’ কেঁদে ফেলে রিকিতা। তারপরে বলে, ‘‘এ ছাড়া আর কীই বা আঁকতে পারতাম।’’ সতি্যই তো।