দুলাল দে, মস্কো: দাভর সুকেরের নাচটা দেখলেন? টিভিতে হয়তো দেখা যায়নি। কিন্তু লুঝনিকির ভিভিআইপি বক্সে দু’হাত তুলে নাচছিলেন তিনি। সেই সুকের। যিনি ক্রোয়েশিয়ান ফুটবলে ভগবান। এখন ক্রোয়েশিয়া ফুটবল ফেডারেশেনের সভাপতি। বিশ্বকাপের আগে, গতবছর অক্টোবরে কিছুই ভাল যাচ্ছিল না। হঠাৎ আল ইন ক্লাব থেকে যুগোস্লাভ কোচ দালিচকে আনলেন দাভর সুকের। বিশ্বকাপের আগে প্রস্তুতির জন্য হাতে কম সময়। কিন্তু একটা বদলে সব বদলে গেল। অঘটনের বিশ্বকাপে প্রথমবার ফাইনালের টিকিট ক্রোয়েশিয়ার হাতে। ছ’বার বিশ্বকাপ খেলে এই প্রথমবার। তারপর? শেষের বাঁশি বাজতেই দৌড়। কে কাকে ধরবেন? মান্দজুকিচের উপর সবাই ঝাঁপালেন। ডাগআউট থেকে উঠে দৌড়লেন অধিনায়ক মদ্রিচ। তাঁরা টেনে আনলেন কোচকে। তাঁকে মাটিতে ফেলে চেপে বসলেন তাঁর উপর। তখন দালিচ কোচ নন। মদ্রিচদের বন্ধু।
[ধরাশায়ী ইংল্যান্ড, ব্রিটিশদের হারিয়ে ইতিহাস লড়াকু ক্রোটদের]
হয়তো দু’দেশের কূটনৈতিক সমস্যার জন্য সেই রং-চং মাখা ব্রিটিশদের দেখা নেই। তবুও তো সেন্ট পিটার্সবার্গের বেলজিয়াম-ফ্রান্সের থেকে ভাল। অন্তত মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামের সিট ফাঁকা নেই। তবে লাতিন আমেরিকার দলগুলি না থাকায় পরিচিত ওলে..ওলে.. আর নেই। বদলে ইংল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়ার সমর্থকদের সারাক্ষণ ধরে নিজেদের মতো করে চিৎকার গান গাইলেন। প্রেসবক্সের ডানদিকের গ্যালারির বারপোস্টের পিছনটা ইংল্যান্ডের। বাঁদিকটা ক্রোয়েশিয়ার। একদিকে সাদা তো অন্যদিকে লাল। কী অদ্ভুত ইতিহাসকে সামনে রেখে খেলতে নামে দু’দল। ’৬৬-র ফাইনাল ছেড়ে দিলে আর কোনও ফাইনালে খেলতে পারেনি ইংল্যান্ড। ক্রোয়েশিয়া তো পারেইনি। সেরা ফল বলতে সেই ৯৮-তে তৃতীয় স্থান পাওয়া।
এই দলটার উপর কার প্রভাব বেশি? পেপ গুয়ার্দিওলা না মরিসিও পচ্চেতিনো? না কী সাউথগেট? তথ্য বলছে, ৬৬’র পর ফের বিশ্বকাপ দেখতে পাওয়া এই ইংল্যান্ড কোচ সাউথগেট এদিন যে দল সাজালেন, তাতে প্রথম একাদশে পেপের তিন ফুটবলার। পচ্চেতিনোর তিনজন। ইংল্যান্ডের মূল ডিফেন্সটাই দাঁড়িয়ে পেপের উপর।
[এবার কি ইস্টবেঙ্গলের পথে রবিনহো? বড়সড় চমক দিতে চলেছে লাল-হলুদ]
গত দুটো বিশ্বকাপে যা দেখা গিয়েছে এই বিশ্বকাপেও তার অন্যথা নেই। স্প্যানিশ পেপ গুয়ার্দিওলা যেখানে, বিশ্বকাপ সেখানে। ২০১০-এ বার্সেলোনার কোচ থাকাকালীন বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন স্পেন। ২০১৪-তে বায়ার্ন মিউনিখের কোচ থাকাকালীন চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। এবার ২০১৮-র দিকে লক্ষ্য রাখুন। গত মরশুম থেকে পেপ ম্যাঞ্চেস্টার সিটির কোচ। তাহলে ইংল্যান্ডেই আসা উচিত। আর তা প্রায় হয়েও গিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন, কোচ যখন সাউথগেট, তাহলে পেপের অবদানটা কোথায়? চিরাচরিত ৪-৪-২ সিস্টেমের ব্রিটিশ ফুটবলকে চুরমার করে ভেঙে সাউথগেট চলে গিয়েছেন ৩-৫-২ তে। এক্ষেত্রে সাউথগেটের তিন ডিফেন্ডারের দু’জনই পেপের। কাইল ওয়াকার আর জন স্টোনস। জাতীয় দলে থাকলেও, দু’দিন আগে ওয়াকার প্রকাশ্যে বলেছেন, “ম্যাঞ্চেস্টার সিটিতে পেপ আমাকে যে পজিশনে যেভাবে খেলান, জাতীয় দলেও সাউথগেট সেভাবেই খেলাচ্ছেন।” একই কথা প্রযোজ্য স্টোনসের ক্ষেত্রেও। বাকি রইলেন স্ট্রাইকার স্টারলিং। সবই ঠিক রয়েছে। কিন্তু সাউথগেটের হাতে তো মদ্রিচ নেই। যিনি চাইলে যে কোনও দিকে খেলাটাকে সুইচ ওভার করতে পারেন।
[ফ্রান্সের হাত ধরে বিশ্বকাপে স্বপ্নপূর্ণ আফ্রিকার! অপেক্ষা ফাইনালের]
ক্লাব ফুটবলে কোচিং করার অভিজ্ঞতা বলতে একমাত্র মিডলসবরো। এমনকী অনূর্ধ্ব-২১ জাতীয় দল থেকে একেবারে সিনিয়র দলে কোচিংয়ের সুযোগটাও তো কোনওমতে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো। সেইসময়ে জাতীয় কোচ স্যাম অ্যালার্ডি ফুটবলার কেনাবেচার মতো দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে চাকরি না খোয়ালে এখন লন্ডনের বাড়িতে বসেই বিশ্বকাপটা দেখতে হত সাউথগেটকে। ২০১৬-র সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ফুটবলার কেনাবেচার দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসতে স্যামকে সরিয়ে জুনিয়র দল থেকে সিনিয়র দলে নিয়ে আসা হয় সাউথগেটকে। তারপরই বোঝা যায়, ইংল্যান্ড ব্রিটিশ স্টাইলের ফুটবল খেলছে না। ইউরোপের অন্য স্টাইল ৩-৫-২ তে যতটা সম্ভব বলা নিয়ন্ত্রনে রেখে ম্যাচ ঘোরানোর সিস্টেম। এবং খেয়াল করে দেখুন, সেই ২০১৬ থেকে পেপও তো ম্যাঞ্চেস্টার সিটিতে। শোনা যায়, বিশ্বকাপের শিবির শুরুর আগে ম্যাঞ্চেস্টারে বেশ কয়েকটা সিটিং হয় পেপ আর সাউথগেটের। তারপরেই চার ডিফেন্ডারের ভাবনা থেকে সরে এসে ম্যাঞ্চেস্টার সিটির মতো তিন ডিফেন্ডারে খেলার ভাবনা কোচের।
[‘হিরো’ থাইল্যান্ডের খুদে ফুটবলাররাই, সেমিফাইনালের জয় উৎসর্গ পোগবার]
হ্যারি কেন, ডেলে আলি আর এদিনের গোলদাতা ট্রিপিয়ারকে নিয়ে টটেনহ্যাম হটস্পার কোচ মরিসিও পচ্চেতিনোর প্রভাব এই জাতীয় দলে অস্বীকার করা যাবে না। তাই হয়তো সাউথগেট ব্রিটিশ ফুটবলের চিরাচরিত উইং থেকে বল তুলে সেকেন্ড বল ফলো করা ছেড়ে, জমিতে পাস খেলছে। চেষ্টা করে যতটা সম্ভব বল ধরে খেলাটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। স্টেডিয়াম ছেড়ে যাওয়ার আগে ক্রোয়েশিয়া কোচ বলেন, “ফাইনালে কী হবে সে তো পরের কথা। আমরা ইতিমধ্যেই ইতিহাসে ঢুকে পড়েছি। রবিবার জিতলে সেটা হবে বোনাস।” উলটো সুর ইংল্যান্ড অধিনায়ক হ্যারি কেনের। বলেন, “আমরা সত্যিই সমালোচনার যোগ্য। ওরা গোলটা পেয়ে যাওয়ার পর খেলাটা ধরে ফেলল। তারপর আমরা কিছুই পারিনি।”
The post ইতিহাস ফেরাতে ব্যর্থ হ্যারি কেনরা, লুঝনিকির রাত দেখল সিংহ শিকারি ক্রোটদের appeared first on Sangbad Pratidin.