সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: কেউ বলেন বিরহ, কেউ বা বলেন ঐশ্বর্যের দম্ভ ফুটে উঠেছে শাহজাহানের অর্থব্যয়ে নির্মিত তাজ মহলের প্রতিটি পাথরে!
তবে, তাজ মহল যে অপরূপ এক পুরাকীর্তি, সেটা অস্বীকার করতে পারেন না অতি বড় নিন্দুকও!
অস্বীকার যে করা যাবে না, সেটা জানতেন শাহজাহানও। এও বেশ বুঝেছিলেন, পত্নী মুমতাজ মহলের স্মৃতিতে উৎসর্গীকৃত এই সমাধি এক আদর্শ হয়ে থাকবে। প্রিয়জনের মৃত্যু হলে অনেকেই তাঁর দেখাদেখি নির্মাণ করতে চাইবে এরকম সমাধিসৌধ। অনুসরণ আর অনুকরণের এই যুগলবন্দি যাতে তাজ মহলের মাহাত্ম্য ক্ষুণ্ণ না করে, সেই জন্যই তিনি কেটে নিয়েছিলেন তাজ-নির্মাতা শ্রমিক আর স্থপতিদের হাত।
এত করেও কিন্তু অনুসরণ-অনুকরণ এড়ানো গেল না। হুবহু না হলেও তাজের নকশা নিয়ে সারা পৃথিবী জুড়েই গড়ে উঠল নানা স্থাপত্য। ক্যালিফোর্নিয়ায় ২ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তৈরি হল তাজের আদলে হাউজবোট। আটলান্টিক সিটিতে গড়ে উঠল ট্রাম্প তাজ মহল ক্যাসিনো। উত্তর প্রদেশের এক দরিদ্র পোস্টমাস্টার স্ত্রীবিয়োগের পর তৈরি করলেন ৫০ বর্গফুটের সিমেন্টের তাজ মহল। অন্য দিকে, পৃথিবীর চোখ ঝলসে দেওয়ার জন্য দুবাই বহু অর্থব্যয়ে তৈরি করছে তাজ আরাবিয়া, যা মূলত বিলাসবহুল হোটেল হিসেবেই নাম কিনবে।
কিন্তু, উত্তর প্রদেশের পোস্টমাস্টারের কথা বাদ দিলে এদের কোনওটিই মকবরা নয়। মকবরা মানে কবর বা সমাধিসৌধ। একটু স্পষ্ট করে বললে- বিখ্যাত কোনও মানুষের সমাধিসৌধ।
অথচ, ভারত কিন্তু তাজ মহলকে বাদ দিয়েও তার চারটি রাজ্যের বুকে ধরে রেখেছে চারটি মকবরা। যাদের মধ্যে তিনটি মকবরা স্থাপত্যে প্রায় হুবহু অনুসরণ এবং অনুকরণ করেছে তাজ মহলকে। চতুর্থটি আধুনিক সময়ের জাতক এবং খ্রিস্টধর্মী। খুব সম্ভবত সেই জন্যই তা তাজের নির্মাণশৈলী মেনে গড়ে ওঠেনি।
তাজ মহলে তো সবাই যায়। আপনি একবার সময়-সুযোগ মতো এই চার অন্য তাজের খোঁজের বেরিয়ে পড়ুন না ঘর ছেড়ে! দেখবেন, চোখের জল আর প্রিয়জনের বিরহ সব ক্ষেত্রেই এক। সে যেমন শাহজাহানের ক্ষেত্রে, তেমনই অন্যদের ক্ষেত্রেও। এছাড়াও, এই চারটি অভিনব স্থাপত্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। তাজ মহল দেখার আনন্দের চেয়ে তা কোনও অংশে কম হবে না।
এক এক করে তাহলে এগোনো যাক অন্য তাজের খোঁজে!
• ঔরঙ্গাবাদের বিবি কা মকবরা:
অনেকে রসিকতা করে বলে থাকেন, এই স্থাপত্যটি না কি দরিদ্র মানুষের তাজ মহল! হবেও বা!
আসলে, এই মকবরাটি নির্মিত হয়েছিল মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের স্ত্রী রাবিয়া দুরানির স্মৃতিতে। ১৬৫০ সালে তাঁদের পুত্র আজম শাহ তৈরি করেন এই স্মৃতিসৌধ।
সত্যি বলতে কী, আজম শাহের অবস্থা তখন খুব একটা ভাল ছিলও না। ঔরঙ্গজেব তাঁর সারা জীবন সিংহাসন ধরে রাখার জন্য মুঘল সাম্রাজ্যের অর্থ ব্যয় করে গিয়েছিলেন একের পর এক যুদ্ধ-বিগ্রহে। ফলে, আজম শাহ যখন সিংহাসন পেলেন, তখন মুঘল কোষাগার প্রায় শূন্য। তার উপর মাথা চাড়া দিচ্ছে নানা বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি। সেই জন্যই বোধহয় রসিকতা করে এই দারিদ্র্যের তকমাটি জুড়ে যায় বিবি কা মকবরার গায়ে।
ইতিহাস বলছে, সেই সময়ে বিবি কা মকবরা নির্মাণে খরচ হয়েছিল ৬,৬৮,২০৩ টাকা। খুব একটা হেলাফেলা করার মতো রাশি কিন্তু নয়। তাজ মহলের নকশা অনেকটাই নিখুঁত ভাবে অনুকরণ করা হয়েছিল এই সৌধ নির্মাণে। জয়পুর থেকে এসেছিল সাদা মার্বেল পাথর। বিশাল বাগানের ভিতর বসানো হয়েছিল ফোয়ারা, রাবিয়া দুরানির কবরের চার পাশে মাথা তুলেছিল তাজের মতোই চারটি উচ্চ মিনার। তফাতের মধ্যে এর অভ্যন্তর মূল্যবান রত্নখচিত ছিল না। সেই জন্যই বোধহয় এহেন রসিকতা!
কী ভাবে যাবেন: ট্রেন ধরে চলে আসুন ঔরঙ্গাবাদ। স্টেশন থেকে ভাড়ার গাড়িতে বিবি কা মকবরা।
দেখার সময়: সপ্তাহের সাত দিনই সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত খোলা থাকে এই সৌধ। দর্শনী লাগে মাত্র ১০ টাকা।
• আগ্রার লাল তাজ:
অনেকেই আগ্রা আসেন তাজ মহলের টানে। দেখেন, চার পাশে ঘোরেন, ছবি তোলেন। তার পর ফিরে যান বাদ বাকি সব কিছুর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে। খেয়ালই করেন না, সাদা তাজের খুব কাছেই রয়েছে এই লাল তাজ!
লাল তাজ তার শরীর পেয়েছিল লাল বেলেপাথরে। ১৮০৩ সালে আগ্রার বুকে তা মাথা তুলে দাঁড়ায়। মজার ব্যাপার, এটিই একমাত্র মকবরা যা এক পত্নী নির্মাণ করেছিলেন তাঁর স্বামীর স্মৃতিতে। এবং, দু’জনের কেউই ছিলেন না ভারতীয়। স্বামীর নাম জন উইলিয়াম হেসিংস। আর, স্ত্রীর নাম অ্যান হেসিংস।
ইতিহাস বলছে, জন উইলিয়াম হেসিংস ছিলেন এক ডাচ সৈনিক এবং ব্যবসায়ী। অভিযানের রোমাঞ্চে ১৭৯২ সালে, মাত্র তেরো বছর বয়সে স্বদেশ ছেড়ে তিনি প্রথম পা রাখেন সিংহলে। সেখানে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে। কোম্পানির হয়ে লড়তে থাকেন একের পর এক যুদ্ধে, পাশাপাশি চালিয়ে যেতে থাকেন ব্যবসারও কাজ। ভারতের বহু যুদ্ধেই অংশ নিয়েছিলেন জন উইলিয়াম হেসিংস। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন আগ্রা আক্রমণ করে, তখন তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রাণ দেন হেসিংস।
সমস্ত সম্পত্তি ব্যয়ে অতঃপর স্বামীর স্মৃতিতে এই লাল তাজ নির্মাণে মন দেন অ্যান হেসিংস। তবে, ব্যবসায়ীর তো আর বাদশাহর মতো সম্পদ থাকা সম্ভব নয়। তাই এই মকবরা আসল তাজের ঠিক এক পঞ্চমাংশ দৈর্ঘ্য পেয়েছিল। তাজ মহলের অভ্যন্তর যেমন সেজে উঠেছিল মোজেকে, তেমনটাও এখানে দেখা যায় না। শুধু ঢোকার মুখে দেখা স্থাপত্যের গায়ে দেখা যায় দুটি ফলক। তার একটা সময়সারণি, অন্যটি সমাধিলিপি। সেই সমাধিলিপিতে লেখা রয়েছে, বিরহের বহু ক্ষত প্রিয়তমা পত্নীর জন্য রেখে গিয়েছেন হেসিংস।
কী ভাবে যাবেন: ট্রেন ধরে পৌঁছে যান আগ্রা। তার পর স্টেশন থেকে একটা গাড়ি নিয়ে চলে আসুন ভগবান সিনেমার কাছে আগ্রা সিভিল রোডে।
দেখার সময়: রোজ সকাল ৬টা থেকে সন্ধে ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে লাল তাজ বা জন হেসিংসের সমাধিগম্বুজ। দর্শনী লাগে ২০ টাকা।
• জুনাগড়ের মহাবত মকবরা:
উঁহু, মহব্বত নয়! মহাবত মকবরা!
তাজের আদলে যে ক’টি সমাধিসৌধ নির্মিত হয়েছে ভারতে, তার মধ্যে গুজরাতের এই মকবরাই স্থাপত্যগুণে সর্বাধিক অনুপম। অথচ, সব চেয়ে বেশি অবহেলিতও!
ইতিহাস বলছে, এই মকবরায় রয়েছে দুই নবাবের সমাধি। তাঁদের একজন মহাবত খানজি, অন্য জন বাহাদউদ্দিন হুসেনভাই। ১৮৭৮ সালে মহাবত খানজি নিজেই শুরু করেছিলেন এই মকবরা তৈরির কাজ। মৃত্যুচিন্তা কি কোনও ভাবে বিষণ্ণ করে তুলেছিল তাঁকে? তবে, ১৮৯২ সালে যখন এই মকবরাটি সম্পূর্ণ হয়, তখন আর মহাবত খানজি জীবিত ছিলেন না। সৌধনির্মাণের কাজ শেষ করেছিলেন তাঁর পুত্র বাহাদুর খানজি। আর, বাহাদউদ্দিন হুসেনভাই ছিলেন নবাব রসুল খানজির উজির। মজার ব্যাপার, তাজের মতোই এটিও সমাধিসৌধ হলেও কেবলমাত্র ইসলামি স্থাপত্যরীতি অনুসরণ করে কিন্তু এটি নির্মিত হয়নি। একই সঙ্গে এর গঠনে দেখা গিয়েছে ইউরোপিয়ান এবং হিন্দু স্থাপত্যরীতিরও সংমিশ্রণ।
ফলে জুনাগড়ে এলে দেখা যাবে, মহাবত মকবরার থাম তৈরি হয়েছে গথিক আদলে। জানলার গঠনে রয়েছে ফরাসি ছায়া। অন্য দিকে রুপোলি দরজা আর মার্বেল পাথরের জালিতে, গম্বুজে-মিনারে ধরা দিয়েছে ইসলামি স্থাপত্য। মিনারের গায়ের ঘোরানো সিঁড়ির স্থাপত্যে দেখা গিয়েছে হিন্দু খিলান। এই জাঁকজমক কিন্তু তাজ মহলের শরীরও পায়নি।
কী ভাবে যাবেন: ট্রেনে করে আসুন জুনাগড়ে। স্টেশন থেকে গাড়ি নিয়ে মুলাওয়াড়া, এম জি রোডে। সেখানেই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে মহাবত মকবরা।
দেখার সময়: প্রত্যেক দিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধে ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে মহাবত মকবরা। এখানে প্রবেশের জন্য কোনও দর্শনী লাগে না।
• আইজলের মিজো তাজ:
স্থাপত্যের দিক থেকে দেখলে তাজ মহলকে কোনও ভাবেই অনুসরণ করেনি এই সমাধিসৌধ। এক নজরে দেখে বরং একে গির্জা বলে মনে হতে পারে! তাহলে?
আইজলের কে ছনথুয়ামা এই যুগের শাহজাহান। স্ত্রী রোজানপুই ভারতে-র মৃত্যুর পর, মিজোরামের রাজধানী থেকে অল্প দূরে, এক পাহাড়চূড়ায় তিনি নির্মাণ করেন এই সৌধ। স্থানীয়রা আদর করে একে বলেন মিজো তাজ। সেই কারণে এবং শাহজাহানের ভাবনার অনুসারী বলেই এই সৌধটিকেও তালিকাভুক্ত করা হল। যদিও নির্মাতা একে কে ভি প্যারাডাইস নামেই চিহ্নিত করতে চান।
দীর্ঘ ইতিহাসের অনুষঙ্গ না থাকলেও মিজো তাজ কিন্তু যথেষ্টই সুন্দর। যে পাড়চূড়ায় সে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেখান থেকে পাখির চোখে দেখা যায় আইজলকে। তা ছাড়া, নজর কাড়ে এর সাদা, মসৃণ মার্বেল-শরীরও। কলকাতা থেকে ফোয়ারা এনে, জয়পুর থেকে সাদা মার্বেল এনে, চেন্নাই থেকে কাচ এনে ছনথুয়ামা তৈরি করেছেন এই তিনতলা সমাধিসৌধ। যার ভিতরে চিরনিদ্রায় শায়িতা রোজানপুই। কবর ছাড়াও রয়েছে তাঁর ব্যবহৃত পোশাক এবং অন্য জিনিসপত্রও। বড় আদরে, মমতায় তা সাজিয়ে রেখেছেন ছনথুয়ামা।
কী ভাবে যাবেন: ফ্লাইটে আসুন আইজল। সেখান থেকে পৌঁছে যান ডার্টল্যাং লেইতানে। যা আইজল সিটি সেন্টার থেকে মিনিট কুড়ির ব্যবধানে অবস্থিত।
দেখার সময়: সোম থেকে রবি- প্রতি দিনই খোলা থাকে মিজো তাজ। দর্শনী লাগে ১০ টাকা।
The post অন্য তাজের খোঁজে appeared first on Sangbad Pratidin.