কিংশুক প্রামাণিক: মাথায় গেরুয়া পাগড়ি, বুকে জাতীয় পতাকাকে লোগোর মতো করে লাগিয়ে কাঁটায় কাটায় সাড়ে ছ’টায় তিনি দৈত্যাকার মঞ্চে আবির্ভূত হলেন। তখন অ্যাকোয়াটিকাতে উপচে পড়েছে ফ্যান-ফলোয়ারদের ঢল। বাইরে সর্পিল লাইন চলে গিয়েছে এক কিলোমিটার দূরে। হাজার হাজার টাকা দিয়ে কেনা টিকিট হাতে নিয়ে অধীর অপেক্ষা দেখে মনে হচ্ছিল, কী সাংঘাতিক ক্রেজ তৈরি করেছেন জিয়াগঞ্জের সাধারণ ছেলেটি! গান তো বাঙালির হৃদয়ে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গীতিকার সুরকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে যে ইতিহাস লেখা হয়। গর্ব করার মতো কত প্রতিভা যুগে যুগে এই মাটিতে। তাই বলে গ্রামের ছেলেটাকে নিয়ে এই উন্মাদনা! শচীন-সৌরভের জুটিতে লুটি দেখতে ইডেনের বাইরে টিকিট ব্ল্যাক হত। এদিন অ্যাকোয়াটিকার বাইরে সেই সুযোগ ছিল কি না জানি না। কিন্তু শিবরাত্রির জলঢালা ফেলে যঁারা হার্ট থ্রবকে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ছিলেন, তঁাদের চোখেমুখে ছিল বিস্ময় প্রতিভাকে চাক্ষুষ করার উল্লাস। অরিজিৎ (Arijit Singh) দেখালেন তিনি কত বড় পারফর্মার।
হাইভোল্টেজ অরিজিৎ সিং প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা মন্ত্রমুগ্ধ করেই শুধু রাখলেন না, মেশালেন পার্সোনাল টাচ। এমনকী, তৈরি করে দিলেন সংবাদপত্রের হেডলাইনও। গেরুয়া গানটি গাইলেন এবং সাফ বলে দিলেন “এই গান নিয়ে এত বিতর্ক কেন, গেরুয়া সন্ন্যাসীদের রং, স্বামীজির (Swami Vivekananda) রং। স্বামীজি যদি সাদা পরতেন তাহলে কি সাদা নিয়েও কথা হত?” কলকাতায় আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণে বলতে উঠে ‘রং দে গেরুয়া’ গেয়েছিলেন অরিজিৎ সিং। অমিতাভ, শাহরুখ, জয়া, শত্রুঘ্ন, সৌরভে উজ্জ্বল মঞ্চে অরিজিতের গানের কলি নিয়ে কোনও কোনও মহল থেকে বিতর্ক তৈরি করা হয়। এদিন যেন তার জবাব দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন গেরুয়া সন্ন্যাসীদের রং। স্বামী বিবেকানন্দ পরতেন। বস্তুত, মুখ্যমন্ত্রীও বার বার এই কথাই বলে এসেছেন, গেরুয়ায় কারও ঠিকেদারি নেই। স্বামীজি গেরুয়া পরতেন। এদিকে এই অনুষ্ঠানের স্থান বদল নিয়ে অরিজিৎ রসিকতা করে বলেন, ‘‘শেষ অবধি অনুষ্ঠান হচ্ছে। বলা হয়েছিল গন্ডগোল হতে পারে। এখানে কেউ গন্ডগোল করলে তাঁকে মঞ্চে নিয়ে আসব কিন্তু।’’
[আরও পড়ুন: ‘মোদির দাসত্ব করছে নির্বাচন কমিশন, চোরেদের উচিত শিক্ষা দেব’, শিব সেনা ‘খুইয়ে’ তোপ উদ্ধবের]
নিজের সুপারহিট গানগুলি চুটিয়ে গাইলেন। সঙ্গে কিশোর, লতা, হেমন্ত, মান্না, সন্ধ্যার গানও। বাদ গেল না সপ্তপদী। এমনকী শ্যামা সংগীতও। সবচেয়ে অবাক করলেন সুরজিৎ, অনিন্দ্য, শিলাজিৎ, রূপমের মতো আজকের শিল্পীদের গান গেয়ে। এত বড় জায়গায় পৌঁছে কে কবে এই উদারতা দেখিয়েছেন। কলকাতায় সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় জলসা। পুলিশ ছিল সক্রিয়। সাউন্ড লাইটের কাজে জ্যাকসন মঞ্চের ছোঁয়া। গিটার, পিয়ানো, ড্রাম, বাঁশি- কী ছিল না! তিনি বাঙালি নন, তবু অরিজিৎ সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানটি করলেন বাংলায় কথা বলে। দর্শকাসনে সেলিব্রিটি নেতাদের ভিড় ছিল লক্ষণীয়। নিজের মায়ের কথা থেকে ৬ মাসের বাচ্চা নিয়ে যে দর্শক এসেছিলেন তাঁর কথা বলে বিস্ময় যুবক বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি শুধু দেশের এই মুহূর্তে সেরা গায়ক নন, মানুষ হিসাবেও অনেক উঁচুতে। হাজার হাজার মোবাইলের আলো মোমবাতির মতো জ্বেলে তাঁকে কুর্নিশ করল কলকাতা।