বিপ্লবচন্দ্র দত্ত: প্রায় পাঁচশো বছর আগেকার বিশ্বাস আজও অটুট রানাঘাটের ঘোষবাড়ির পুজোয়। পরিবারের সদস্যরা আজও বিশ্বাস করেন যে দেবীমা নিজের হাতে তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য রান্না করে নেবেন। সেই বিশ্বাসে আজও দুর্গাপ্রতিমার সামনে দেওয়া হয়, ঘি মাখানো আতপ চাল, কাঁচা সবজি এবং বিভিন্নরকম মশলাপাতি-সহ নানা জিনিস। পুজোশেষে ঘোষ পরিবারের সদস্যরা অবশ্য সেই আতপ চাল, কাঁচা সবজি রান্না করেই তৈরি করেন ভোগ। রানাঘাটের অন্যতম প্রাচীন এই পুজোকে ঘিরে রয়েছে নানারকম ইতিহাস। বলিপ্রথা চালু ও তা বন্ধ নিয়েও রয়েছে মস্ত ইতিহাস। সালটা ১৫২০। তখন রানাঘাটের নাম ছিল ব্রহ্মডাঙা। ঘোষ পরিবারের বর্তমান সদস্যদের কাছ থেকে জানা যায়, তাঁদের পৈতৃক জমিদারি ছিল হুগলি জেলার আখনা গ্রামে। সম্পত্তি নিয়ে শরিকি বিবাদে মনক্ষুণ্ণ হয়ে জমিদার চৈতন্যচরণ ঘোষ তাঁর পরিবারের সকলকে নিয়ে চলে আসেন নদিয়ার ব্রহ্মডাঙায়। গৃহদেবতা লক্ষ্মী-জনার্দনকে সঙ্গে নিয়ে এসে ব্রহ্মডাঙায় রাতারাতি মন্দির নির্মাণ করেন। সেই বছরেই বাড়িতে শুরু হয় দুর্গাপুজো। পুজো শুরুর সময় থেকেই পশুবলির জন্য বিখ্যাত ছিল এই ঘোষবাড়ির পুজো। নবমীর দিন ৫১টি পাঁঠা বলি দেওয়া হত। অষ্টমীর দিন সন্ধিপুজোর সময় দেওয়া হত মোষবলি।
[আরও পড়ুন: এক সময়ে শয়ে শয়ে ছাগল বলি হত, এখন কীভাবে পুজো হয় সিমলাপাল রাজবাড়িতে? ]
দূরদূরান্তের গ্রাম থেকে সেই বলি দেখতে আসতেন প্রচুর মানুষ। যদিও ১৫৩০ সালে এক স্বপ্নাদেশের বলে বলিপ্রথা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। তার পিছনেও রয়েছে একটি গল্প। কথিত আছে,ঘোষ পরিবারের তৎকালীন সদস্যা ব্রজবালা এক রাতে স্বপ্নে দেবীর দর্শন পেয়েছিলেন। স্বপ্নের মধ্যেই দেবী ব্রজবালাকে বলি বন্ধ করার আদেশ দিয়েছিলেন। দৈববাণী শুনতে পেয়েছিলেন ব্রজবালা। দৈববাণী হয়েছিল, দেবীর আদেশ না মানা হলে অনর্থ, অঘটন ঘটে যাবে। পরদিন সকালে সেই স্বপ্নের কথা ঘোষ পরিবারের সকলের মধ্যে জানাজানি হলেও পুজোর তালে মেতে উঠে স্বপ্নের সেই আদেশকে খুব একটা আমল দেননি কেউ। যথারীতি আগের নিয়মেই চলতে থাকে পুজো। পাঁঠা, মোষবলির রীতিও বহাল রাখা হয়। কিন্তু, সেই বছরই পরিবারে ঘটে যায় বড়সড় অঘটন। সেই সময় ঘোষ পরিবারের কর্তা ছিলেন রামগোপাল ঘোষ। সম্পর্কে তিনি ছিলেন ব্রজবালার শ্বশুর। সেই বছর দেবীপক্ষ চলাকালীন তিনি প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হন। মাত্র কয়েকদিনের জ্বরে ভুগেই তিনি মারা যান। পরিবারের সদস্যদের হুঁশ ফেরে। সকলের স্মরণে আসে সেই দৈববাণী। এরপর কুলপুরোহিতের পরামর্শে বন্ধ করে দেওয়া হয় শতাব্দীপ্রাচীন বলিপ্রথা।