shono
Advertisement

গুজরাটে কি ভোট ভাগাভাগির ফায়দা তুলেছে বিজেপি?

মানতেই হবে, বিজেপির সবচেয়ে বড় ‘ব্র্যন্ড’ নরেন্দ্র মোদি।
Posted: 01:34 PM Dec 17, 2022Updated: 01:34 PM Dec 17, 2022

এই তত্ত্বের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত নই। ভোট ভাগাভাগি যদি গুজরাটে বিজেপির বিজয়ের প্রধান কারণ হয়, তবে বিজেপির শতকরা ভোট কংগ্রেস এবং আপের মোট শতকরা ভোটের চেয়েও বেশি হয় কী করে? বঙ্গে সিপিএম ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার অভূতপূর্ব রেকর্ড করলেও তাদের শতকরা ভোট ধারাবাহিকভাবে কিন্তু কমেছে। কলমে জয়ন্ত ঘোষাল

Advertisement

ইংরেজি ভাষায় একটি জনপ্রিয় বাগধারা- Give the Devil his due. শয়তানের প্রাপ‌্যও চোকাতে হয়। উদাহরণ দিই। ধরুন, আপনি মমতা বন্দ্যোপাধ‌্যায়ের ঘোর সমালোচক। কিন্তু এই সরল সত‌্যটি আপনাকে মানতেই হবে যে, পশ্চিমবঙ্গে মমতা-ই জনপ্রিয়তম নেত্রী। বিজেপি এখানে আত্মবিকাশে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হলেও মমতার ‌‘বিকল্প’ নেই। ঠিক এই একই সূত্র অনুসরণ করে মানতেই হবে, বিজেপির সবচেয়ে বড় ‘ব্র্যন্ড’ নরেন্দ্র মোদি। দেশের বিপুল জনসমাজে মোদির প্রশংসক যেমন একটা বড় অংশ, তেমনই তাঁকে তীব্রভাবে অপছন্দ করেন এমন মানুষের সংখ‌্যাও এই বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে কম নয়। মোদিকে ইভেন্ট ম‌্যানেজার, ‘গোদি মিডিয়া’-র জনক, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার প্রতীক, স্বৈরাচারী- নানা বিশেষণে বিশেষিত করা হয়। তবু মানতে হবে, ২০১৪ সালে একক সংখ‌্যাগরিষ্ঠতায় বিজেপিকে কুর্সিতে এনে ১০ বছর টিকিয়ে রাখার প্রধান কৃতিত্ব অবশ্যই তাঁর।

গুজরাট বিধানসভা ভোটের আগে যখন অরবিন্দ কেজরিওয়াল সে-রাজ্যে পেশি আস্ফালনের রাজনীতি শুরু করেন, তখন কলকাতায় বসে তৃণমূলের এক শীর্ষ স্ট্র্যাটেজিস্ট নেতা আমাকে বলেছিলেন- দেখে নিও, গুজরাটে বিজেপি সুইপ করবে। কেজরিওয়ালের উচিত ছিল গুজরাটকে অগ্রাধিকার না দিয়ে, যেসব এলাকায় তাঁর জনভিত্তি বা শক্তি আছে, সেখানেই শক্তি বেশি খরচ করা।

[আরও পড়ুন: নতুন মোড়কে পুরনো প্রশাসন, পাকিস্তান আছে পাকিস্তানেই!]

অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, কংগ্রেস আর আপের ভোট ভাগাভাগির জন‌্য বিজেপির লাভ হয়েছে। এই তত্ত্বের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত নই। ভোট ভাগাভাগি-ই যদি গুজরাটে বিজেপির বিজয়ের প্রধান কারণ হয়, তবে বিজেপির শতকরা ভোট কংগ্রেস এবং আপের মোট শতকরা ভোটের চেয়েও বেশি হয় কী করে? বিজেপি ভোট পেয়েছে শতকরা প্রায় ৫৩ ভাগ। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার অভূতপূর্ব রেকর্ড থাকলেও কিন্তু সিপিএমের শতকরা ভোট ধারাবাহিকভাবে কমেছে। যা শতকরা ৬০ ভাগ ছিল শুরুতে, তা ৩৭ ভাগে এসে থামে। গুজরাটে বিজেপির ভোট ব্যাংক ৩০ বছর পরেও বাড়ল। ৫ বছর বিজেপি ক্ষমতায় থাকলে শাসনকাল হবে ৩৫ বছর, যা বামফ্রন্টের রেকর্ডও ভাঙছে।

ভোটের ফলাফল প্রকাশের পর ‘দ‌্য হিন্দু’ কাগজে লোকনীতি-সিএসডিএসের (সেন্টার ফর দ‌্য স্টাডি অফ ডেভলপিং সোসাইটিস) একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, গুজরাটে বিজেপির এই বিপুল জয়ের প্রধান কারণ নরেন্দ্র মোদি। ‘মোদি ফ‌্যাক্টর’, ‘মোদি ম‌্যাজিক’, ‘মোদি মিথ’ যে নামই দিন। দ্বিতীয়ত, গুজরাটে পতিদার, নিম্নবর্গ, দলিত, গরিব কৃষক নানা জাতপাত নানা ‘রং’-এর ভোটব‌্যাংককে একটা বড় গামলায় মেলাতে পেরেছে বিজেপি। উচ্চবর্ণের হিন্দু ভোট তো আছেই। কংগ্রেস বরাবর উপজাতি ও আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় জনপ্রিয় ছিল। জিনাভাই দর্জির মতো নেতা ছিলেন কংগ্রেসে। এবার ১০টি উপজাতি আসনে ১০টিই বিজেপি পেল। পতিদার আসন বিজেপি পেল ১০টির মধ্যে ৯টি। অথচ, কর্মক্ষেত্রে সংরক্ষণের দাবিতে গুজরাটে পতিদার বিক্ষোভ কম হয়নি। সৌরাষ্ট্র-কচ্ছ এলাকায় ২০১৭ সালে ৫৪টার মধ্যে ৩০টা আসন কংগ্রেস পেয়েছিল। এবার কংগ্রেস ৩টি, আর বিজেপি এই এলাকায় ৪৬টি আসন পেয়েছে।

দেশের সর্বত্র মোদির জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান তা বলব না। তা-ই যদি হত তবে হিমাচলে বিজেপি-বিরোধী অসন্তোষকে মুছে দিতে পারত মোদি ম‌্যাজিক। দিল্লি পুরভোটে এত কাণ্ড করেও বিজেপি কেজরিওয়ালকে হারাতে পারলেন না। ২০২১ সালে বঙ্গেও মোদির ছবি কাজ করেনি। মোদি বনাম মমতা লড়াইয়ে মমতা বিজেপিকে পর্যুদস্ত করেছেন। শুধু তাই নয়, উত্তরপ্রদেশ, মধ‌্যপ্রদেশ, বিহারের মতো হিন্দি বলয়ের রাজ্যেও বিজেপির জনপ্রিয়তা ক্রমহ্রাসমান। দেশের আর্থিক অবস্থা শোচনীয়, কর্মসংস্থান নেই। বাস্তবের এই প্রতিকূল পরিস্থিতিকে প্রচারের হাতিয়ার করবে– এমন ঐক‌্যবদ্ধ বিরোধী শিবিরও অবশ‌্য দেখা যাচ্ছে না। এটা সম্ভবত মোদি নামক ব্র্যান্ড আনুগত‌্যর আর-একটি পূর্বশর্ত।

আসলে, কোনও ব‌্যক্তি-নেতার ‘ব্র‌্যান্ডিং’ যখন হয় তখন সবসময় তাঁর একটা আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থাকে। লেনিন বলশেভিক বিপ্লবের ‘ব্র্যান্ড’। কিন্তু জারদের অত‌্যাচারে বিক্ষুব্ধ জনতা, আর লালফৌজের বিদ্রোহের পটভূমি ভুললে তো চলে না। মোদি ব‌্যক্তি, কিন্তু তিনি জানেন গত ১০ বছরে কোথায়-কোথায় দুর্বলতা দেখা দিচ্ছে। সেসব দুর্বলতা মোচনে তিনি ২৪X৭ কাজ করেন। সাংগঠনিক রদবদল, প্রার্থী মনোনয়ন, সরকারি জনকল‌্যাণ, ধর্মীয় মেরুকরণ, সর্বোপরি নানা জাতপাতের সংমিশ্রণে মোদির নিজস্ব ভোট ব‌্যাংক গড়ে তোলা। এক কড়াপাক মণ্ড! ২০১৪ সালে ‘হিন্দুত্ব’ আর ‘মোদি’ মিলিয়ে বলেছিলাম ‘মোদিত্ব’। আজ ২০২৪ সালের আগে গুজরাটের বিপুল জয় মোদির লোকসভা ভোটের চালচিত্র তৈরি করে দিল। মোদিত্বের নবতর সংস্করণ।

মোদি-শাহ খুব পরিশ্রমী জুটি। বিরোধীদের মধ্যে একমাত্র মমতা-অভিষেককে এইরকম পরিশ্রম করতে দেখি। রাহুল, অখিলেশ, এমনকী, নীতীশ কুমার বা স্ট‌্যালিনও এরকম ‘হোলটাইমার’ পরিশ্রমী নন। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে হেরে যাওয়ার পরদিন থেকেই মোদি-শাহ পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল-বিরোধী রাজনৈতিক অভিযানে নেমে পড়েন। হেরে যাওয়ার হতাশা, গ্লানি মুছে এই উদ‌্যম ভাবা যায়? পাশাপাশি কংগ্রেসের রাহুল গান্ধীকে দেখুন। ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’-য় যখন এত মানুষ আসছে দেখে তাঁর মনে যদি হয় যে, দিল্লির মসনদের বিরুদ্ধে মানুষের অসন্তোষ আছে, তাহলে তিনি ভারত জোড়ো কর্মসূচি থেকে গুজরাটকে কেন বাদ রাখলেন? গুজরাট গিয়ে জবরদস্ত প্রচার না-করে কেন নমো-নমো করে দায়িত্ব সারলেন?

তাই শয়তানকে তার প্রাপ‌্য দিতেই হবে। মোদির জন‌্য প্রচারের ঢক্কানিনাদ যেমন সত্য, তেমন দলের জয়-পরাজয় সবকিছুর দায়িত্বও তাঁর কাঁধে। জিতলেও মোদি। হারলেও মোদি। ঠিক তৃণমূলের মতো। জেতার কৃতিত্ব, পরাজয়ের দায় চিরকাল মমতা-ই গ্রহণ করেন।

অনেকে ভাবেন, নরেন্দ্র মোদি আর অমিত শাহ বুঝি আলাদা। আসলে নেপথ্যে মোদি-ই সব। অমিত শাহ কি এমন কোনও কাজ করতে পারেন যা মোদি চান না? মোদি যখন যুক্তরাষ্ট্রীয় ব‌্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখার জন‌্য মমতার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী হন, তখনও তিনি নরেন্দ্র মোদি। আবার উপ-রাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকড়ের রাজ‌্যসভার প্রথম দিনে যখন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁর সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের প্রশংসা করেন, তখনও তিনি নরেন্দ্র মোদি।

বিশিষ্ট সাংবাদিক অজয় সিং সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন। নাম ‘দ‌্য আর্কিটেক্ট অফ দ‌্য নিউ বিজেপি: হাউ নরেন্দ্র মোদি ট্রান্সফর্মড দ‌্য পার্টি’। অজয় এখন রাষ্ট্রপতির মিডিয়া অ‌্যাডভাইসর। আমরা মোদির ব্র্যান্ড, জনপ্রিয়তার ভাবমূর্তি, ভোট প্রচার এসব নিয়ে অনেক আলোচনা করেছি। কিন্তু অজয় দেখাতে চেয়েছেন বাজপেয়ী-আদবানি যুগ থেকে কীভাবে মোদি বিজেপির আরও বিস্তার করেছেন জনসমাজে। কীভাবে নতুন আলেখ‌্য (ন্যারেটিভ) নিয়ে এক নতুন বিজেপি গঠন করেছেন। যাতে আরও অনেক মানুষ এ দলের পরিমণ্ডলে যুক্ত হয়। এই অসাধ‌্যসাধনের জন‌্য শুধু প্রশাসনিক রণকৌশল নয়, বহু দিন ধরে মোদি আসলে সংগঠনের কাজও করে চলেছেন আরএসএস-কে সঙ্গে নিয়ে, যে-কাজ আদবানি করলেও বাজপেয়ী কখনও করেননি।

গুজরাটের সৌরাষ্ট্রের মোরবি শহরে আছে মাচ্ছু নদী। আর ১৯৭৯ সালের ১১ আগস্ট মোরবিতে ব‌্যাপক বন‌্যা হয়। সেই বন‌্যায় ২৫ হাজার মানুষ মারা যায়। শহর জলের তলায়। তখন সেচমন্ত্রী ছিলেন কেশুভাই প‌্যাটেল। যিনি পরে গুজরাটের মুখ‌্যমন্ত্রী হন। বাবুভাই যশভাই প‌্যাটেলের নেতৃত্বে তৎকালীন সরকার। রামকৃষ্ণ মিশনের রাজকোট আশ্রমের তৎকালীন সন্ন‌্যাসী প্রয়াত স্বামী আত্মস্থানন্দের সঙ্গে আরএসএসের এক যুবক ত্রাণকার্যে অবতীর্ণ হন। নাম নরেন্দ্র মোদি। ’৭৯ সালে দেশ তখন ইন্দিরা-বিরোধী মুডে। নরেন্দ্র মোদি সক্রিয় হয়ে সমাজসেবা করলেন, আর ব‌্যস্ত হয়ে পড়লেন ইন্দিরা-বিরোধী জনসংঘ-আরএসএস রাজনীতিতে। এই ঘটনাটি মনে করাতে চাইছি পাঠককে শুধু এটা জানাতে যে, আজ মোদির ‘ব্র্যান্ড’ কিন্তু এক আকস্মিক ‘পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা’ নয়। সমালোচনা অনেক। কিন্তু নয়া বিজেপি গঠনের এই কারিগরিকেও মূল‌্য দিতে হবে।

২০২৪ সালে কী হবে তার শেষ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। জাতীয় স্তরে নির্বাচনী জোটের সম্ভাবনাও কম। তা-ও একটা কথা আলোচনায় প্রাসঙ্গিক। মোদি ব্র‌্যান্ডকে মোকাবিলা করার জন‌্য ইটের বদলে পাটকেলের রাজনীতি করতে দেখা যাচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ‌্যায়কেই। কেননা তিনি ‘অ‌্যামেচার’ রাজনীতিক নন, মোদির মতোই হোলটাইমারের রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন।

(মতামত ব্যক্তিগত)

[আরও পড়ুন: ঋণনীতি যেন শাঁখের করাত, কোন পথে দেশের অর্থনীতি?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement