শীতকালীন ডালের মধ্যে অন্যতম মসুর। শীতের মরশুমে মসুর ডাল চাষে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ভাল লাভ পেতে হলে রোগ শনাক্তকরণ জরুরি। একইসঙ্গে নিতে হবে প্রতিকার ব্যবস্থাও। লিখেছেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বীরভূমের সেকমপুরের আঞ্চলিক গবেষণা কেন্দ্রের গবেষক ড. রাজু দাস।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিদিন একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের ৪৫ গ্রাম ডাল খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সেই তুলনায় আমরা মাথাপিছু মাত্র ১৭ গ্রাম ডাল গ্রহণ করি। আমাদের দেশে শীতকালীন ডালের মধ্যে ছোলার পরে মসুরের স্থান। খাদ্যগুণের নিরিখে মসুরকে স্বাস্থ্যকর খাদ্যের মধ্যে স্থান দেওয়া হয়েছে, যা প্রোটিন, ভিটামিন, ফাইবার এবং অনুখাদ্যে ভরপুর। আগামী শীত মরশুমে মসুর ডাল (Lentil) চাষে রোগ শনাক্তকরণ ও প্রতিকার ব্যবস্থা নিলে কৃষকরা লাভবান হতে পারেন।
(ক) মূল ও কাণ্ড সংযোগস্থল পচা (কলার রট)
মসুর চাষ ও মৃত্তিকাবাহিত রোগের প্রকোপ বেশি হয়। এটি একটি ছত্রাকঘটিত রোগ। এই রোগের কারণে মসুরের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে কম হয়। চারা অবস্থায় এই রোগের আক্রমণ সর্বাধিক লক্ষ্য করা যায়।
রোগের লক্ষণ
শুরুর প্রথম অবস্থায় মাটি সংলগ্ন গাছের গোড়ায় কাণ্ডের উপর কিছুটা অংশ নরম হয়ে জলে ভেজা দাগ দেখা যায়, যা ধীরে ধীরে হলুদ হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে বাদামি বর্ণ ধারণ করে এবং শেষে জায়গাটি শুকিয়ে যায়। গাছের পাতাগুলি হলদে হতে থাকে এবং গাছগুলি মাটির উপর ঢলে পড়ে।
[আরও পড়ুন: পুজোর সময় নিম্নচাপে নষ্ট প্রচুর ফুলের চারা, লোকসান দেখে মাথায় হাত ফুলচাষিদের
প্রতিকার
১। গ্রীষ্মকালে গভীর লাঙল দিয়ে জমি চাষ করে কিছুদিন ফেলে রাখতে হবে ও রোগ সহনশীল জাতের চাষ করতে হবে।
২। জমিতে নাইট্রোজেন সার নির্দিষ্ট মাত্রায় দিতে হবে ও রোগের আশ্রয়দাতা হিসাবে ফসলের অবশিষ্ট অংশ যতটা সম্ভব নষ্ট করে দিতে হবে।
৩। জমি ও আলের আগাছা পরিষ্কার রাখতে হবে এবং একই জমিতে একই ফসল ও একই জাত বারবার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
৪। জমিতে জল জমা হতে দেওয়া যাবে না ও জমিতে রোগ দেখামাত্র আক্রান্ত অংশ তুলে ফেলতে হবে।
৫। শেষবার জমি চাষের সময় প্রতি একর জমির জন্য ৫০০-৬০০ কেজি কম্পোস্ট বা ভার্মিকম্পোস্ট বা খামারের সারের সঙ্গে ট্রাইকোডার্মা এবং সিউডোমোনাস ৪-৫ কেজি বাণিজ্যিক মিশ্রণ ভালভাবে মিশিয়ে ৭ দিন ছায়ায় ভেজা চটের বস্তা চাপা দিয়ে রেখে প্রয়োগ করতে হবে।
৬। রোগমুক্ত ভাল মানের সংহিত বীজ ব্যবহার করতে হবে এবং বীজ শোধন করতে হবে। প্রতি কেজি বীজের জন্য ৩ গ্রাম কার্বাক্সিন ৩৭.৫ শতাংশ + থাইরাম ৩৭.৫ শতাংশ ডি এস বা ২.৫ মি.লি. ভ্যালিডামাইসিন ৩ শতাংশ এস.এল. বা ট্রাইকোডার্মা হারজিয়িনাম ও সিউডোমোনাস ফ্লুওরেসেন্স (১০ গ্রাম + ১০ গ্রাম) প্রয়োগ করতে হবে।
৭। আক্রান্ত গাছ ও তার আশপাশের কিছুটা অংশ জুড়ে ১ গ্রাম থায়োফেনেট মিথাইল ৭০ শতাংশ ও ২ গ্রাম ক্লোরোথ্যালোনিস ৭৫ শতাংশ প্রতি লিটার জলে গুলে ভাল করে মাটি ভিজিয়ে দিতে হবে।
(খ) ধসা বা ঝলসা রোগ (আল্টার্নারিয়া জনিত ঝলসা)
পূর্ব ভারতে এই রোগটি ক্রমবর্ধমান। যখন গাছে ফুল আসে, তখন বেশি তাপমাত্রা ও এক থেকে দু’দিনের হালকা বৃষ্টি এই রোগ বৃদ্ধির জন্য সহায়ক।
[আরও পড়ুন: ঔষধিগুণ সম্পন্ন সজনে চাষেই লক্ষ্মীলাভের সুযোগ, জেনে নিন খুঁটিনাটি]
রোগলক্ষণ
প্রথম অবস্থায় পাতার অগ্রভাগে রোগের লক্ষণ দেখা যায়। পরবর্তীতে পাতার ধার বা কিনারা বরাবর ছোট ধূসর বর্ণের দাগ দেখা যায়। পরবর্তীতে রোগের বৃদ্ধি হলে সমস্ত পাতা গাঢ় বাদামি বর্ণের হয়ে যায়। আক্রান্ত পাতাগুলি লক্ষ করলে দেখা যায় এক কেন্দ্রীয় অনেকগুলি বলয়ের সমষ্টি। পরবর্তীতে দাগগুলি পরস্পর মিশে গিয়ে পাতা ঝলসে যায় এবং পরে সমস্ত গাছটি শুকিয়ে যায়। রোগটি এক বা একাধিক শাখায় হতে পারে বা শুঁটিতে লক্ষ্য করা যায়।
প্রতিকার
১) ফসল কাটার পর গভীরভাবে মাটি কর্ষণ করে আক্রান্ত গাছের অবশিষ্ট অংশ মাটির মধ্যে মিশিয়ে দিতে হবে।
২) প্রতি কেজি বীজে ২ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম ৫০ শতাংশ ডব্লু. পি. বা ৩ গ্রাম ম্যানকোজেব ৭৫ শতাংশ ডব্লু.পি. বা ১০ গ্রাম ড্রাইকোডারমা ভিরিডি দিয়ে বীজ শোধন করতে হবে।
৩) ফসলে রোগ দেখা দিলে প্রথম অবস্থায় সতর্কতামূলক হিসাবে প্রতি লিটার জলে ২.৫ গ্রাম ম্যানকোজেব ৭৫ শতাংশ ডব্লু.পি স্প্রে করতে হবে। পরবর্তীতে রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেলে ২.৫ গ্রাম মেটালোক্সিল ৮ শতাংশ + ম্যাকোজেব ৬৪ শতাংশ বা ১ মিলিলিটার ডাইফেনকোনাজোল ২৫ শতাংশ ই.সি. বা ১ গ্রাম ক্যাপটান ৭০ শতাংশ + হেক্সাকোনাজোল ৫০ শতাংশ ডব্লু.পি বা ০.৫ গ্রাম ট্রাইফ্লোক্সিসস্টবিন ২৫ শতাংশ + টেবুকোনাজোল ৫০ শতাংশ স্প্রে করতে হবে। প্রয়োজনে ১০-১৫ দিন বাদে আরও একটি স্প্রে করা যেতে পারে।
(গ) মরচে রোগ (রাস্টা)
এই রোগটি প্রতি বছরই কিছু কিছু জায়গায় কমবেশি দেখা যায়। এই রোগটি গাছে ফুল আসার সময় লক্ষ্য করা যায়।
রোগের লক্ষণ
এই রোগের আক্রমণে মরিচার মতো উঁচু উঁচু অংশ পাতার কিনারা, বৃন্ত ও কাণ্ডে দেখা যায়। পাতার নিচের দিকে এবং শুঁটিতে প্রথম অবস্থায় হলদেটে সাদা বর্ণের দাগ দেখা যায় বা পরবর্তীতে বাদামি বর্ণের ১ মিলিলিটার ব্যাসার্ধের গোলাকার উঁচু উঁচু অংশে পরিণত হয়। পরবর্তীতে এগুলি একে অপরের সঙ্গে মিশে যায়। রোগের তীব্রতা বেশি হলে আক্রান্ত গাছের পাতাগুলি ঝরে যায় বা গাছ মারা যায়। আক্রান্ত গাছের বীজগুলি অপুষ্ট হয় বা কোনও বীজ দেখা যায় না।
প্রতিকার
১) ফসল চাষের পরিবর্তন করলে পরবর্তী ফসলে রোগের আক্রমণ কম হয়।
২) রোগের প্রথম অবস্থায় প্রতিষেধকমূলক হিসাবে প্রতিলিটার জলে ২.৫ গ্রাম ম্যানকোজেব ৭৫ শতাংশ স্প্রে করতে হবে। পরবর্তীতে রোগের আক্রমণ তীব্র হলে প্রতিলিটার জলে ১ মিলিলিটার ডাইফেনকোনাজোল ২৫ শতাংশ ই.সি. বা ০.৪ গ্রাম মাইক্লোবুটানিল ১০ শতাংশ স্প্রে করতে হবে। প্রয়োজনে ১০-১৫ দিন বাদে আরও একটি স্প্রে করা যেতে পারে।