নির্মল ধর: দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও বাংলা সরকারি সাহায্যে তৈরি ছবি ‘মুজিব’ (Mujib: The Making of a Nation)। যাঁকে নিয়ে ছবি তিনি বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে শুধু বন্ধু নন, গোটা জাতির রূপকারও। আর যিনি ছবিটি বানিয়েছেন তিনি কিংবদন্তি পরিচালক শ্যাম বেনেগাল (Shyam Benegal)। রীতিমত অভিজ্ঞ, যোগ্যও বটে। আর, সরকারি অর্থ লগ্নির ফলে সাতের দশকের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দুই দেশের সরকারি মতামতের যে প্রতিফলন ঘটবে চিত্রনাট্য লেখায়, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু তার ফলে সত্যিকারের ইতিহাস যে পিছনের সারিতে চলে যাবে এই আশঙ্কা ছিলই।
সেলিনা হোসেন, আনিসউজ্জামান, আখতারউজ্জামান ইলিয়াসদের লেখা যাঁরা পড়েছেন এবং ওই সময়ে রেডিও বাংলাদেশ ও কলকাতা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান যাঁরা শুনেছেন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই তাঁরা জানেন তৎকালীন ‘সত্য’ কী ছিল, কেমন ছিল! তাঁদের কাছে শ্যাম বেনেগালের এই ‘মুজিব’ খণ্ডিত, অসত্য লাগতেই পারে। দুটি উদাহরণ – বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্রের আঁতুর ঘর ছিল এপারের কলকাতা, ওপারের কুষ্ঠিয়া নয়। দ্বিতীয় ঘটনা – ৭ মার্চ ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর উদ্দীপ্তপূ্র্ণ ভাষণ নিতান্তই সাদামাটা এবং কলকাতার ময়দানে মুজিবের জ্বালাময়ী ভাষণ একেবারেই উধাও।
[আরও পড়ুন: ‘জেলে যেতে না যেতেই নগ্ন করা হয়েছিল’, বিস্ফোরক শিল্পার স্বামী রাজ কুন্দ্রা]
রিচার্ড অ্যটেনবরো ‘গান্ধী’র চিত্রনাট্য লেখার সময় নিশ্চিতভাবেই তেমন কোনও বাধ্যবাধকতার সন্মুখীন হননি, যেমনটি হতে হয়েছে শ্যামকে। সুতরাং তাঁর নিজের অন্যান্য কাজের পাশে এই ছবি একেবারেই সাধারণ মানের লাগতেই পারে। সাতের দশকের মুক্তিযুদ্ধ বিশেষ করে এপারের বাঙালিদের যেভাবে আলোড়িত করেছিল, এই কলকাতা শহর যে আন্তরিকতা নিয়ে বাংলাদেশকে সাহায্য দিতে এগিয়ে গিয়েছিল এবং সর্বোপরি কয়েক লক্ষ নয়, কোটি হিন্দু শরণার্থীকে স্থায়ী আশ্রয় দিয়েছিল – তার কোনও উল্লেখ নেই ছবিতে।
যেমন দেখা গেল না সারা কলকাতা শহর জুড়ে ময়দানের সভায় উপস্থিত হয়ে মুজিবের ভাষণ শোনার উন্মাদনার কোনও ফুটেজ। অনুপস্থিত রয়ে গিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে ওপার বাংলার অতি সাধারণ শ্রমিক, কৃষক, ছাত্রদের স্বতস্ফূর্ত সক্রিয় অংশ গ্রহণের দৃশ্য। যা আমরা দেখেছি তারেক মাসুদ-সহ একাধিক পরিচালকের ছবিতে। শান্তনু মৈত্রর আবহ কিছু কিছু দৃশ্যকে কাঙ্খিত নাটকীয়তায় উত্তীর্ণ করতে সাহায্য করলেও গান গুলোতে মাটির গন্ধ মেলে না। নীতিশ রায়ের তৈরি বিশাল সেট, ধানমন্ডির বাডি অবশ্যই ভালো লাগে। কিন্তু পাওয়ার চাইতে না-পাওয়ার ভাগটি বেশি হলে মনতো খারাপ হয়ই! সেটাই হল। এই জন্যই বলা হয়, সমসাময়িক কোন ঘটনার চিত্রায়নে সময়ের দূরত্বটা জরুরি।
তবে হ্যাঁ, মুখ্য চরিত্রে ওপার বাংলার আরফিন শুভ (Arifin Shuvoo) অভিনয়ের যে বেশ ভালো ভাবে উতরে দিয়েছেন মানতেই হবে। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর স্ত্রীর চরিত্রে নুসরত ইমরোজ তিসা, বাবার ভূমিকায় চঞ্চল চৌধুরী, মেয়ে হাসিনার বেশে নুসরত ফারিয়া যোগ্য সঙ্গত করেছেন।
সিনেমা – মুজিব
অভিনয়ে – আরফিন শুভ, সরত ইমরোজ তিসা, চঞ্চল চৌধুরী, নুসরত ফারিয়া, রজিত কাপুর প্রমুখ
পরিচালনায় – শ্যাম বেনেগল