রাজদীপ সরদেশাই: গত শতকের ছয়ের দশকে ভারতের সমাজতান্ত্রিক পরিমণ্ডলে হিন্দি সিনেমাগুলির কথা ভাবুন। সেখানে প্রায়ই ‘ভিলেন’-এর ভূমিকায় দেখা যেত অসাধু, শোষণ-করিয়ে উদ্যোগপতিদের। আজ, বহু দশক পরে, কৃষক আন্দোলন ফের তৈরি করল পরিচিত সেই স্টিরিওটাইপ ‘শত্রু’ চরিত্র। সিংঘু সীমান্তে এই শৈত্যপ্রবাহেও চারিদিকে পোস্টার পড়েছে ‘আদানি-আম্বানি’-কে টার্গেট করে। সেসব পোস্টার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বিদ্রুপ করা পোস্টারগুলোর মাঝে জায়গা করে নিচ্ছে করে। পাঞ্জাবের মাটিতে রিলায়েন্স জিও টেলিকমের টাওয়ার ভাঙচুর করা হয়েছে। আদানির সামগ্রী বর্জন করা হয়েছে। মজবুত এই আক্রমণের ফলে এই দুই কর্পোরেট গোষ্ঠী– আদানি ও আম্বানি বাধ্য হয়ে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেয় যে, ভবিষ্যতে তাদের কোনও পরিকল্পনা নেই কৃষিক্ষেত্রে কোনওরকমের ‘কন্ট্রাক্ট ফার্মিং’-এর কাজ শুরু করার। যে রাজনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়েছিল কৃষিক্ষেত্র এবং মোদি সরকারের মধ্যে, সেখানে ভারতের দুই বৃহৎ কোম্পানির ফেঁসে যাওয়ার ব্যাখ্যা তাহলে কী?
[আরও পড়ুন: গ্রামীণ এলাকার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, কেন্দ্রের কৃষি আইনের প্রশংসায় IMF]
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের কর্পোরেট ক্ষেত্রটি খুব কমই আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে। শেষবার ভারতের ব্যবসায়িক ক্ষেত্রের বিরুদ্ধে সরাসরি এমন গণক্ষোভ তৈরি হয়েছিল ২০১১ সালে ‘ইন্ডিয়া এগেন্সট কোরাপশন প্রোটেস্ট’-এর সময়ে। সে সময় অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সমর্থকরা ভারতের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক আভিজাত্যের বিরুদ্ধে বৃহৎ আঘাতের উদ্দেশ্যে কিছু বিশেষ কর্পোরেট গোষ্ঠীকে বেছে নিয়ে বারবার আক্রমণ করেছিল। কিন্তু যেই কেজরিওয়াল ক্ষমতায় চলে এলেন, ধীরে ধীরে তিনি তাঁর অস্ত্রমুখ ভোঁতা করে ফেললেন যেন। শাসনব্যবস্থার কঠোর বাস্তবতা দেখল, তিনি কীভাবে নিজেকে সরিয়ে আনলেন অবারিত অভিযোগের রাজনীতি থেকে।
কেজরিওয়াল ব্র্যান্ডের সরে যাওয়ার পর যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছিল রাজনৈতিক সক্রিয়তায়, তা কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী এসে পূরণ করলেন। ২০১৪ সালে রাহুল গান্ধীর নির্বাচনী প্রচারের অন্যতম অস্ত্র ছিল আদানি-আম্বানির বিরোধিতা। ২০১৫ সালের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর রাহুল জোরাল সওয়াল করেন এই মর্মে যে, মোদি সরকার ‘সুট বুট কি সরকার’। এই বিদ্রুপ ক্ষমতাসীন সরকারকে এতটাই বর্শাবিদ্ধ এবং অপ্রস্তুত করেছিল যে, ‘গরিবো কি সরকার’ ভাবমূর্তি বলবৎ করতে একপ্রকার বাধ্যই হয়ে একাধিক নীতি তৈরি করতে উদ্যোগী হয়েছিল তারা। এমনকী, ২০১৬ সালের প্রবল বিতর্কিত নোটবন্দির ঘোষণাতেও তারা ‘ধনী বিরোধী’, ‘দরিদ্রপন্থী’ রাজনৈতিক বক্তব্য রেখেছিল পূর্বকথিত আখ্যানকে বদলে ফেলার উদ্দেশ্যে।
আর এখন, পাঁচ বছর পর এবং আরও একটি নির্বাচনে মাত হয়ে, রাহুল গান্ধী আবার ফিরে এসেছেন তাঁর চিরাচরিত বিষয় নিয়ে– কৃষক উদ্বেগকে হাতিয়ার করে। সাদা চোখে কংগ্রেস নেতৃত্বের আদানি-আম্বানির প্রতি আক্রমণ কিছুটা গোলমেলে, খানিক ভণ্ডও বটে। সবকিছুর পরেও, কংগ্রেস হল সেই দল, যারা ক্ষমতায় থাকাকালীন পছন্দসই কর্পোরেটের সঙ্গে বস-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। ১৯৮০ সাল নাগাদ, ইন্দিরা গান্ধী-প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সদয় দৃষ্টিতেই আম্বানি সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। গৌতম আদানি গুজরাটের মাটিতে ব্যবসায়িক কামড় বসাতে পেরেছিলেন যখন কংগ্রেস-সমর্থিত চিমনভাই প্যাটেলের সরকার তাঁকে ১৯৯০ সালে সস্তায় জমির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। প্রতিবেশী মহারাষ্ট্রেও একই দশা। তারাও আদানির সঙ্গে ইনফ্রা প্রোজেক্টের শুরুতেই চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। আসলে, আদানি-আম্বানি দুই সংস্থাই অন্যান্য বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যবসায়িক সংস্থার মতো পূর্বতন কংগ্রেস জমানার লাইসেন্স পারমিট রাজের বিশেষ সুবিধা ভোগ করে এসেছে।
তা সত্ত্বেও, কেবল এখনই ভারতের এই দুই ধনীতম শিল্প প্রতিষ্ঠান উন্মাদ রাজনৈতিক বিতর্ক থেকে নিজেদের দূরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। তাহলে, কী এমন নাটকীয় পরিবর্তন ঘটল? প্রথমত, মিডিয়ার চালচিত্র এমন রূপান্তরিত হয়েছে যে, খেলা ও খেলার নীতি ঘুরে গিয়েছে পুরোপুরি। হাজার হাজার বৈচিত্রপূর্ণ প্ল্যাটফর্মের এই মাল্টি-মিডিয়ার মহাবিশ্বে, তা সে ইউটিউব চ্যানেল হোক বা সোশ্যাল মিডিয়া সাইট, আখ্যান ও ঘটনার স্টোরিলাইন ‘নিয়ন্ত্রণ’ করা প্রায় অসম্ভব। সরকারের প্রোপাগান্ডা মেশিন এখন নাগরিক ক্রিয়াকলাপের আওতায় এমনভাবে ঢুকে পড়েছে যে সেখানে লুকনোর কোনও জায়গা নেই। ভাইরাল ভিডিওগুলি এখন সত্য এবং হুজ্জতের মাঝে সম্পূর্ণ অস্পষ্ট সীমারেখায় শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলছে। এমনকী, সর্বাধিক শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলিও জনসাধারণের ক্রোধের জিম্মায় চলে যাওয়ার মতো খাদে দাঁড়িয়ে। আর, সেখানে আছে শোরগোল ও মগজধোলাই করা মিডিয়ার বাস্তুতন্ত্র। ফলে, দ্বন্দ্বে বা আলোচনায় যাওয়ার পূর্বনির্ধারিত কোনও নিয়ম নেই।
দ্বিতীয়ত, আদর্শের সংঘাত যদি ‘কৃষক বনাম দামোদর শেঠ স্বরূপ শিল্পপতি এবং তাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক’ হয়ে যায়, তখন জয় একতরফেরই হয়। কৃষকের প্রতিবাদকে কেবলমাত্র একটা বিন্দু অবধি নিন্দা ও ধিক্কার জানানো যায়। কিন্তু জমাট শীতে ‘অন্নদাতা’-রা কাঁপতে কাঁপতে আন্দোলনে রত– এমন ছবির বিপ্রতীপে যদি কল্পিত ভারতের সমৃদ্ধ ভুঁইফোঁড় বড়লোকদের ছবি ফুটে ওঠে, তা অন্যায়ের অনুভূতি জাগিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট। এর ফলে কোনওরকম যৌক্তিকতার বোধ ব্যতিরেকেই উত্তেজনাপূর্ণ আবেগী প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত হয়ে ওঠে। আদানি ও আম্বানিদের সাকিন যে গুজরাট, যা কিনা প্রধানমন্ত্রীরও নিজের রাজ্য– কেবল এ তথ্যটুকুই এমন ধারণাটিকে শক্তিশালী করে তোলে যে, ক্ষমতার সান্নিধ্যে এই শিল্পপতিরা অযাচিত সুবিধা ভোগ করে নিচ্ছে। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রীও আদানির সঙ্গে তাঁর আহমেদাবাদভিত্তিক বিশেষ সমীকরণ কখনও গোপন করেননি। উদাহরণস্বরূপ: ২০১৪-য় নির্বাচনী প্রচারের সময় তিনি আদানির বেসরকারি বিমান ব্যবহার করেছিলেন এবং একই বিমানে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নিতে দিল্লি পৌঁছেছিলেন।
বিগত দশকে, মন্দা-র সময়কালেও মুষ্টিমেয় ভারতের কোটিপতি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীই তাৎপর্যপূর্ণ বৃদ্ধির বাস্তবতা কায়েম করতে পেরেছিল। যেখানে কিনা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয়রই আয়ের স্তর যেই কে সেই তিমিরেই থেকে গিয়েছে, কিংবা আরও বিপন্ন হয়েছে। লাভজনক খাতগুলিতে নির্দিষ্ট শিল্পপতিদেরই প্রায় আধিপত্য– টেলিকম, পেট্রোলিয়াম, জাহাজ বন্দর, বিমানবন্দরগুলি– সর্বত্র এক ছবি। যা কেবলমাত্র একটি অসম অর্থনৈতিক পটচিত্রকেই নিশ্চিত করে। যেখানে নিয়ন্ত্রণকারী কোনও নীতি নেই, কর্তৃপক্ষ নেই। সাধারণ সময়ে, এ সমস্ত বিষয়কে হয়তো বা অবহেলা করা যেতে পারত, পাত্তা না দেওয়া যেতে পারত। সর্বোপরি, বাজার উদারীকরণের সময়, দেখা তো গিয়েছিলই যে, ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি ধন-সম্পদশালী কোটিপতিদের ‘নেসেসারি ইভিল’ হিসাবে চিহ্নিত করা বন্ধ করে দিয়েছিল। এবং দেখাদেখি, উদ্যোগপতি বা নিজের শিল্প, স্টার্ট-আপ বিষয়ে এই শ্রেণি রীতিমতো উদ্যাপন করা শুরু করেছিল, স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। কিন্তু, কোভিড-কালে, যেখানে চাকরি চলে যাচ্ছে, যেখানে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, যেখানে বৃদ্ধি বা লাভের কোনও নামগন্ধ নেই– সেখানে মাত্র সীমিত কিছু মানুষের মধ্যেই সুবিধাপাতির যারপরনাই বাড়বাড়ন্ত হবে, এমনটা দেখা গেলে অসন্তুষ্টি তৈরি তো হবেই।
সেদিক থেকে দেখলে, কৃষকদের এই ‘আদানি-আম্বানি’ বিরোধিতা, তা সে যতই নিরাকার মনে হোক না কেন, আসলে এক বিস্তৃত অসন্তোষের প্রতীক। তা হল– একচেটিয়া বাজারের নবোদয় এবং ভয়টা ‘প্রকৃত’ হোক বা ‘কাল্পনিক’, যে, এই একচেটিয়া প্রবণতা ভবিষ্যতে আয়ের বৈষম্যকে আরও বিস্তৃত করবে। এসবেরই বিরুদ্ধে এই আন্দোলন। কৃষি সংস্কারের মাধ্যমে প্রকৃত আয়-ব্যয় বিশ্লেষণের দিকে মনোনিবেশ করার পরিবর্তে শিল্পপতিদের অপব্যবহারের রাজনীতি পুনরুদ্ধার-প্রাপ্ত হচ্ছে। এই প্রতর্ক এখন এক অবিশ্বাস বা সন্দেহপ্রবণতায় সিদ্ধ হয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন রাষ্ট্রশক্তি এবং বড় বড় শিল্পপতির মধ্যে জোটবদ্ধতা বা যোগসূত্রের প্রতি এই ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাস। ২০১৪ সালে, মোদি রাজনৈতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’ (ঘুষ নেব না, ঘুষ নিতেও দেব না) হয়ে উঠেছিল হুজুগে চিৎকার, স্লোগান। লক্ষ লক্ষ ভারতীয়কে আকর্ষিত করতে চুম্বকের মতো কাজ করেছিল এই স্লোগান। আকর্ষিত করেছিল কারণ, সে সময় আর্থিক কেলেঙ্কারির দাগ লেগে যাওয়া ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে মানুষ হয়ে উঠেছিল ক্ষুব্ধ এবং ক্লান্ত। নরেন্দ্র মোদি চাতুরির সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত চিত্রটি কম-বেশি অক্ষুণ্ণ রাখতে পেরেছেন, তবে অন্তরঙ্গতার দোষারোপ উঠে এসেছে, যা তিনি ঝেড়ে ফেলতে পারেননি। তা ফেলতে হবে। অন্যথায় সিংঘু সীমান্তের উপর দিয়ে প্রবাহিত ধীর বাতাস আরও তীব্র আকার ধারণ করবে।
পুনশ্চ, সিংঘু সীমান্তে, একদল তরুণ কৃষকের সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছিল। তাঁরা আমাকে আনন্দের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে ‘আদানি-আম্বানি’-র জোট সম্পর্কিত সাম্প্রতিকতম উপহাসের ভিডিওটি দেখাচ্ছিলেন। মজার বিষয় হল, লক্ষ করলাম, ওঁরা সকলেই জিও মোবাইলের গ্রাহক!