রাজ কুমার, আলিপুরদুয়ার: নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে শতবর্ষ পুরনো জয়ন্তীর (Jayanti) জনপদ। সব ঠিকঠাক মতো এগোলে ২০২৫ সালের মার্চের আগেই ব্রিটিশ আমলে তৈরি জয়ন্তী গ্রামের কোনও অস্তিত্ব থাকবে না। একসময় এখানে রেলপথ ছিল। ছিল ডলোমাইট (Dolomite) কারখানা। বড় বড় সব সরকারি বেসরকারি ডলোমাইট খননকারী কোম্পানিও ছিল। আজ আর সেসবের কিছুই নেই। তাই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া সুন্দরী জয়ন্তী বক্সা ব্যঘ্র প্রকল্পের কোর এলাকা (Core area) থেকে সরে যাবে। ‘জয়ন্তী ভিলেজ রিলোকেশন ফর্মে’ সইও করে দিয়েছেন এখানকার বাসিন্দারা। পুনর্বাসন, আর্থিক ক্ষতিপূরণ সবই পাবেন। কাজেই ভিটেমাটি ছেড়ে নতুন জীবনের পথে হাঁটতে আগ্রহী।
জয়ন্তী গ্রামটি বক্সা ব্যঘ্র প্রকল্পের (Buxa Tiger Reserve Forest)কোর এলাকার মধ্যে পড়ে। বন্যপ্রাণ আইন অনুযায়ী, কোর এলাকায় জনবসতি থাকার কথা নয়। তাই সেখান থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেয় বনদপ্তর। জয়ন্তীর বেশিরভাগ মানুষেরা সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। এর জন্য জয়ন্তীর প্রত্যেক পরিবারকে ১৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেবে সরকার। জয়ন্তীকে সরিয়ে নিতে খরচ হবে প্রায় ৭০ কোটি টাকা। তবে এর সবটাই দেবে কেন্দ্র। এছাড়া রাজ্য সরকার প্রত্যেক পরিবারকে ৫ ডেসিমেল করে জমি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হাসিমারার (Hasimara) গুদামডাবরি এলাকায় জয়ন্তী থেকে সরে যাওয়া পরিবারদের জমি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার।
[আরও পড়ুন: ‘পরিচালকের হাত কেটে ফেলা হোক!’, ‘জওয়ান’ দেখে বিস্ফোরক মন্তব্য শাহরুখ ভক্তের]
মূলত বনে বাঘেদের থাকার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতেই মানুষহীন বন তৈরি করতে চায় বনদপ্তর। বিষয়টি নিয়ে বক্সা ব্যঘ্র প্রকল্পের ক্ষেত্র অধিকর্তা অপূর্ব সেন বলেন, “যে কোনও টাইগার রিজার্ভ থেকে বনবসতিবাসীকে সরানোর জন্য এই প্যাকেজ গোটা দেশেই চালু রয়েছে। জয়ন্তী-সহ বক্সাতে দু-একটি গ্রামের লোকজনে সঙ্গে এই বিষয়ে আমাদের কথা হয়েছে। তারা বন ও পরিবেশের কথা বিবেচনা করে সরে যেতে চাইলে এই প্যাকেজ পাবেন।” জানা গিয়েছে, ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, জয়ন্তীতে লোকসংখ্যা প্রায় ৭০০ জন। প্রায় ২০০ পরিবারের এই জনসংখ্যা দিনদিন কমছে। এই সব পরিবারের বেশির ভাগই জয়ন্তী থেকে সরে যেতে চাইছেন।
[আরও পড়ুন: ‘মধ্যরাত পর্যন্ত দেখুন কী করি’, শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্যকে হুঁশিয়ারি রাজ্যপালের]
জয়ন্তীর বাসিন্দা তপন দত্ত বলেন, “জয়ন্তী তো দিনদিন শ্মশাণে পরিণত হচ্ছে। একসময় বাইরে থেকে মানুষরা জয়ন্তীতে কাজ করতে আসতেন। এখন উলটোটা। জয়ন্তী নদী যে কোনওদিন এই জনপদকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। সেই কারণে আমরা বনদফতরের প্যাকেজে রাজি হয়ে এখান থেকে সরে যাওয়ার জন্য লিখিতভাবে মত দিয়েছি।” জয়ন্তীর আরেক বাসিন্দা মণিকুমার লামার বক্তব্য, “বনের ভিতর কোনও সুযোগ সুবিধে নেই। আমাদের জীবন এভাবে কাটল। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম এভাবে কেন থাকবে? বনদপ্তরের কড়াকড়ি। এলাকায় কোনও কাজ নেই। নেই হাসপাতাল ও ভাল স্কুলও। ফলে শুধু পারিবারিক ভিটের আবেগে ভর করে আর এখানে থেকে কোনও লাভ নেই। সেই কারণে বনদপ্তরের প্যাকেজে আমরা রাজি হয়ে গেছি।”
বাংলাদেশ থেকে এখানে এসে ঘর বেধেছিলেন তপন দত্তের বাবা। তপন বাবু দর্জীর কাজ করেন। তিনি বলেন, “১৯১৫ সালে জয়ন্তী নদীতে রেলব্রিজ তৈরি হয়। এখানে ১৯০৫ সালেই রেল পথ চালু হয়ে যায়। জয়ন্তী মিলনী সংঘ ক্লাব স্থাপন হয় ১৯৪২ সালে। স্বাধীনতার আগের অনেক ইতিহাসই এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জয়ন্তীর আনাচে কানাচে। কিন্তু সেই ইতিহাস ধুয়ে জল খেলে আমাদের চলবে না। সামনের ডাকে সারা দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় নেই।”
দেখুন ভিডিও: