সুতীর্থ চক্রবর্তী: কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অস্বস্তি প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। আন্তর্জাতিক মেডিক্যাল জার্নাল ‘দ্য ল্যানসেট’ যেভাবে তাদের সম্পাদকীয় এবং একাধিক নিবন্ধে ভারতের বর্তমান এই কোভিড সংকটের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর সরকারকে দায়ী করেছে, তা বেশ নজিরবিহীন। গত বছর কোভিড শুরুর সময় আন্তর্জাতিক স্তরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেয়ার বলসোনারো-র সমালোচনা হয়েছিল। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল করোনাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে নিজেদের দেশে সংকট তৈরি করার। এবার মোদির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক স্তরের চিকিৎসা সংক্রান্ত ম্যাগাজিনের আক্রমণ আরও শাণিত।
[আরও পড়ুন: সম্পাদকীয়: ‘মার্কস হারলেন, রবীন্দ্রনাথ জিতলেন?’]
মার্কিন একটি সংস্থা পূর্বাভাস দিচ্ছে, ১ আগস্টের মধ্যে ভারতে কোভিডে মৃত্যু দশ লক্ষে পৌঁছতে পারে। এটা খুবই উদ্বেগের। এখন দেশে কোভিডে মৃত্যু আড়াই লক্ষ ছুঁইছুঁই। রোজ চার হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এখন থেকে টানা ১ আগস্ট পর্যন্ত যদি রোজ চার হাজার করে মৃত্যু হয়, তাহলেও দশ লক্ষে পৌঁছনো সম্ভব নয়। তার মানে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির ধারণা ভারতে অচিরেই কোভিডে দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা দশ হাজারে পৌঁছবে। চার হাজার মৃত্যুতেই দেশজুড়ে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি, তা আমরা উপলব্ধি করছি। মৃতদেহ শ্মশানে দাহ করা যাচ্ছে না, মাটিতে কবর দেওয়া যাচ্ছে না। সর্বত্র স্থানাভাব। দেহ গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনার অভিযোগ উঠেছে। দৈনিক দশ-পনেরো হাজার কোভিডে মৃত্যু ঘটলে দেশে লাশের পাহাড় জমে যাবে!
এইরকম একটা ভয়াবহ ভারতের ছবি এঁকে ল্যানসেটের সম্পাদকীয়তে সবটার জন্য দায়ী করা হয়েছে মোদি সরকারকে। এই ম্যাগাজিনের অভিযোগ, গত বছরের শেষ দিক থেকে এই বছরের গোড়া পর্যন্ত ভারত সরকার সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছিল কোভিডকে। গত বছরের শুরুতে কোভিডের প্রথম ঢেউয়ের সময় ভারতের ভূমিকা যে প্রশংসনীয় ছিল, তা নিয়ে সংশয় নেই। থালা বাজানো, প্রদীপ জ্বালানো ইত্যাদি নিয়ে ব্যঙ্গ হয়েছে ঠিকই, বা হঠাৎ করে লকডাউন ঘোষণা করে দেওয়ায় পরিযায়ী শ্রমিকদের যে দুর্বিষহ অবস্থায় পড়তে হয়েছিল, তা নিয়েও সরকারকে নিন্দার মুখে পড়তে হয়। কিন্তু তবুও, সরকার দ্রুততার সঙ্গে পদক্ষেপ করে সেবার যে কোভিড সংক্রমণের শৃঙ্খলকে ভাঙতে সমর্থ হয়েছিল, তা স্বীকার করতেই হয়। তা নিয়ে দেশে-বিদেশে যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছিলেন মোদি। সেটাই আত্মতুষ্টি হিসাবে কাজ করেছে কি না এখন প্রশ্ন তা নিয়েই।
ল্যানসেটের সম্পাদকীয় বলছে, প্রথম দফার করোনা চলে যাওয়ার পর মোদি সরকার ভেবেছিল, অতিমারী মনে হয় চিরতরে বিদায় নিয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন মন্তব্য করেছিলেন, অতিমারী শেষের শুরু হয়ে গিয়েছে। মোদি সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই বিবৃতি আত্মাহুতির শামিল বলে এখন মনে করা হচ্ছে। কীভাবে অতিমারীর দ্বিতীয় তরঙ্গকে উপেক্ষা করা হল, তা নিয়েই চলছে বিশ্বজুড়ে সমালোচনা। ল্যানসেট বলছে, ভারতের সরকার দেশের উপর এই বিপর্যয়কে কার্যত ডেকে এনেছে। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২০-তে করোনার প্রথম ঢেউ শিখর ছুঁয়েছিল। সেদিন দেশে নতুন সংক্রমণ ছিল ৯৭,৮৬০। তারপর থেকে দৈনিক সংক্রমণ রোজ কমতে থাকে। এটা কমতে কমতে এ বছরের মার্চ মাসে দশ হাজারের কমে চলে গিয়েছিল। এই কমার গতি দেখেই কেন্দ্রীয় সরকার ধরে নিয়েছিল অতিমারী বোধহয় আর ফিরবে না। কারণ, মার্চ মাসেই দেশের পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোটের বিশাল আয়োজন শুরু হল। কুম্ভমেলায় ছাড় দেওয়া হল। যাবতীয় সভা-সমাবেশ, বিয়েবাড়ি, সামাজিক অনুষ্ঠানের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়া হল। এটা যে কত বড় ভুল, তা এখন বোঝা যাচ্ছে।
করোনা চলে গিয়েছে ভেবে যখন সমস্ত সমাবেশে ছাড় দেওয়া হল, তখন কিন্তু টিকাদানের গতি বাড়িয়ে দেশবাসীকে সুরক্ষিত করার চেষ্টা হয়নি। আন্তর্জাতিক স্তরের বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন, ভারতের সরকারের নীতি নির্ধারকদের অনেকের ধারণা হয়ে গিয়েছিল, ভারতে গোষ্ঠী অনাক্রম্যতা তৈরি হয়ে গিয়েছে। ফলে টিকা না নিলেও অত চিন্তা নেই। কিন্তু এখন বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, টিকা নিয়েও উদ্বেগে থাকতে হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সংক্রমণ বেশি ছড়িয়ে পড়লে ভাইরাস রূপ পাল্টে আরও দুর্দম হয়ে ওঠে। তখন তাকে ওষুধ দিয়েও রোখা যায় না। এই অপ্রতিরোধ্য ভাইরাসকে ভ্যাকসিন দিয়েও মারা যায় না। ভারতের ক্ষেত্রে এখন সেরকমটাই হতে চলেছে কি না, প্রশ্ন সেটাই। অনেক দিন ধরেই বিজ্ঞানীরা পূর্বাভাস দিচ্ছেন, এবার বুঝি ভাইরাসের শক্তি কমবে। দ্বিতীয় ঢেউ আস্তে আস্তে বিদায় নেবে। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সেটা ঘটছে না। সংক্রমণও বাড়ছে, মৃত্যুও বাড়ছে। অর্থাৎ, ভাইরাস ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে যদি ভাইরাস আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে যায়, তাহলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু মৃত্যু প্রত্যক্ষ করা ছাড়া আমাদের সামনে বিকল্প কিছু থাকবে না। ওষুধ প্রতিরোধকারী ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান আমরা হামেশাই পাই। এই ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের শিকার হলে অনেকেরই প্রাণ যায়। করোনা হল এক অতি সংক্রমণকারী ভাইরাস। এই ভাইরাস যদি সমস্তরকম ওষুধ ও প্রতিষেধক প্রতিরোধকারী হয়ে যায়, তাহলে তা কী বিপজ্জনক হতে পারে, সেটা কল্পনাতেই আনা যাচ্ছে না।
শুধু শহর নয়, এবার গ্রামেও যেভাবে করোনার থাবা বিস্তৃত হয়েছে, তা অকল্পনীয়। মানুষ যে অবশেষে ভয়ংকর ভীত হয়ে পড়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। সরকার পরিপূর্ণ লকডাউন না করলেও দুপুরের পর থেকে এই রাজ্যের বহু অঞ্চলে রাস্তাঘাট শুনশান হয়ে যাচ্ছে। প্রথমবার লকডাউন মানার ক্ষেত্রে আমাদের অনেক দ্বিধা ছিল। এবার অর্থনীতির কথা চিন্তা করে সরকার লকডাউনে আগ্রহী না হলেও মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে লকডাউন করে ফেলছে। আসলে, এখন লোকে আর জীবিকার কথা চিন্তা করছে না। করোনার থেকে প্রাণ বাঁচানোটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। বছরের গোড়ায় মোদি সরকার সবকিছু দ্রুত স্বাভাবিক করে অর্থনীতিকে বাঁচানোর কথা বলেছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, আম ও ছালা দুটোই যাওয়ার পথে। অর্থনীতি তো বাঁচলই না। মানুষের প্রাণ বাঁচানোই এখন দুষ্কর হয়ে উঠছে।