সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: পহেলগাঁও আবহে প্রায় সাড়ে পাঁচ দশক পুরনো শিমলা চুক্তি বাতিল করার হুঁশিয়ারি দিয়েছে পাকিস্তান। পাক সরকারের তরফে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, "ভারতের সঙ্গে শিমলা চুক্তি-সহ সমস্ত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্থগিত রাখার অধিকার রয়েছে তাদের। ভারত পাকিস্তানের অন্দরে সন্ত্রাসকে উস্কানি দেওয়া, আন্তর্জাতিক হত্যাকাণ্ড এবং আন্তর্জাতিক আইন ভাঙা বন্ধ না করা পর্যন্ত এই চুক্তি স্থগিত রাখা হতে পারে।" প্রশ্ন হল, এই শিমলা চুক্তি বাতিল করলে আদৌ লাভবান হবে পাকিস্তান? নাকি এই চুক্তি বাতিল করলে সেটা ইসলামাবাদের জন্য খাল কেটে কুমির ডাকার শামিল হবে? সেটা বুঝতে হলে আগে জানতে হবে শিমলা চুক্তি কী?
শিমলা চুক্তি কী?
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিরাট সাফল্যের পরের বছর, ১৯৭২ সালের ২ জুলাই বর্তমান পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর সঙ্গে শিমলায় একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক মেরামত করে সীমান্তে শান্তি বজায় রাখাই ছিল এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য। যার নির্যাস, "এই চুক্তির মাধ্যমে সীমান্ত সংঘাতে ইতি টেনে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক মেরামত করার স্বার্থে বন্ধুত্বপূর্ণ, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা। এবং এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি স্থাপনে দু’দেশের সহযোগিতা।” নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তি স্থাপনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে এই চুক্তির। দক্ষিণের মানাওয়ার থেকে উত্তরের কেরান পর্যন্ত সবটাই এই চুক্তির আওতায়। এছাড়া হিমবাহ আচ্ছাদিত এলাকাও এর মধ্যেই পড়ে।
শিমলা চুক্তির মূল শর্ত কী?
চুক্তি অনুযায়ী দু’দেশের সীমান্ত এলাকা থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়া হবে। শান্তি বিঘ্নিত করতে কোনও তরফে কোনও উসকানি দেওয়া যাবে না। শান্তি বজায়ে পারস্পরিক সমন্বয় রাখতে হবে। চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার সময় কাশ্মীরে যে দেশ যে অবস্থানে রয়েছে, উভয় পক্ষই সেই অবস্থান মেনে চলবে। পারস্পরিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও কোনও পক্ষ একতরফাভাবে এর পরিবর্তন চাইবে না। এই রেখা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে হুমকি বা বলপ্রয়োগ থেকে উভয় পক্ষ বিরত থাকবে।
শিমলা চুক্তি অমান্য করলে কী হতে পারে?
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে অস্থায়ী সীমানা অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণরেখা, সেটার স্বীকৃতির মূল ভিত্তিই হল এই শিমলা চুক্তি। দু'দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত চুক্তিও শিমলাতেই লিপিবদ্ধ হয়। বস্তুত শিমলা চুক্তিতে ভারত-পাক যুদ্ধবিরতি রেখাকে নিয়ন্ত্রণরেখা হিসেবে চিহ্নিত করার কথা বলা হয়েছে। পাকিস্তান যদি শিমলা চুক্তি স্থগিত করে, তবে এই নিয়ন্ত্রণরেখার বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাবে। বস্তুত এই চুক্তি বাতিল করার অর্থ দু'দেশের মধ্যে কার্যত যুদ্ধ পরিস্থিতি। তাছাড়া দ্বিপাক্ষিক শিমলা চুক্তিতে বলা আছে, দু'দেশের মধ্যে কোনওরকম সমস্যা তৈরি হলে সেটা মিটিয়ে নেবে দুই দেশই। এই শর্তের বলে কাশ্মীর ইস্যুতে তৃতীয় শক্তির হস্তক্ষেপ এড়ানো যায়। ফলে এই চুক্তি বাতিল করে দিলে কাশ্মীর ইস্যুতে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের রাস্তা খুলে যেতে পারে।
সুদূরপ্রসারী প্রভাব
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, পাকিস্তান শিমলা চুক্তি প্রত্যাহার করলে শেষমেশ লাভ হতে পারে ভারতেরই। বস্তুত কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার দীর্ঘদিন ধরেই হুঙ্কার দিয়ে আসছে, পাকিস্তানের দখলে থাকা কাশ্মীরের অংশ অর্থাৎ PoK ছিনিয়ে নেবে ভারত। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে অমিত শাহ, রাজনাথ সিং, যোগী আদিত্যনাথের মতো শীর্ষ বিজেপি নেতারা হুঙ্কার দিলেও এখনও অধিকৃত কাশ্মীর পুনর্দখলে কার্যকরী পদক্ষেপ করতে পারেনি সরকার। সেটার মূল কারণই হল এই শিমলা চুক্তি। এই চুক্তিতেই বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রণরেখাকে দুই দেশ সম্মান করবে, এবং বলপ্রয়োগ করে সেটা লঙ্ঘন করার চেষ্টা করবে না। এই পরিস্থিতিতে অধিকৃত কাশ্মীরে আক্রমণ করলে কূটনৈতিক মহলে চাপে পড়তে হত ভারতকে। এখন পাকিস্তান যদি নিজেই শিমলা চুক্তি বাতিল করে দেয়, তাহলে সেটার দায় আর ভারতের উপর বর্তাবে না। সেক্ষেত্রে ভারত অধিকৃত কাশ্মীর দখলের লক্ষ্যে সেনা পাঠালে কিছু বলার থাকবে না আন্তর্জাতিক মহলের। অন্তত চুক্তিভঙ্গের দায় বর্তাবে না ভারতের উপর।
নিতান্ত যদি PoK দখল উদ্দেশ্য নাও হয়, শিমলা চুক্তি না থাকলে ভারতীয় সেনা অবাধে পাকিস্তানের বা অধিকৃত কাশ্মীরের মাটিতে ঢুকে জঙ্গি নিকেশ করতে পারবে। সেক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক সীমানা লঙ্ঘনের দায় বর্তাবে না দিল্লির উপর।
এই চুক্তি বাতিলের আরও একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। দুদেশের মধ্যে এই চুক্তি না থাকার অর্থ, কাশ্মীর ইস্যু আন্তর্জাতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে। সেক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তান ছাড়াও তৃতীয় শক্তি সরাসরি কাশ্মীর ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করবে। তাতে দক্ষিণ এশিয়াকে কেন্দ্র করে গোটা বিশ্বে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।