বিশ্বদীপ দে: সম্ভাজি মহারাজ। হঠাৎই ফের আলোচনায় উঠে এসেছেন শিবাজি মহারাজের জ্যেষ্ঠ পুত্র। সৌজন্যে হিন্দি ছবি 'ছাবা'। সেই ছবিতে অভিনেতা ভিকি কৌশলকে দেখা গিয়েছে সম্ভাজির ভূমিকায়। তবে কেবল রুপোলি পর্দাতেই নয়, ইতিহাস ও লোকশ্রুতিতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে শিবাজির মতো সম্ভাজির আখ্যানও ভেসে রয়েছে। ১৬৮৯ সালের ১১ মার্চ শিরঃচ্ছেদ করা হয়েছিল তাঁর। সেই হিসেবে সময়ের বিচারে পেরিয়ে গিয়েছে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর। তবু সেই ইতিহাস টিকে গিয়েছে। কেবল বইয়ের পাতায় নয়, লোকগাথার মতো করেই তা 'জীবন্ত' থেকে গিয়েছে।
সম্ভাজির জীবনের শুরুটাই ছিল চূড়ান্ত বেদনার। মাত্র দু'বছর বয়সে মা সাই বাইকে হারান তিনি। বাবা শিবাজি ও ঠাকুমা জিজাবাইয়ের ছত্রছায়ায় এরপর ছোট্ট ছেলেটির বেড়ে ওঠা। সন্তানকে শিক্ষিত করে তুলতে বাড়িতেই শিক্ষক নিয়োগ করেন শিবাজি। দ্রুত সে বড় হয়ে ওঠে। ঠাকুর্দার মতো সংস্কৃতে তৈরি হয় বিশেষ দক্ষতা। ছেলের মধ্যে সম্ভাবনা দেখেছিলেন শিবাজি। আর তাই যখন সে কিশোর, তখন থেকেই তাকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কাজে যুক্ত করে দেন।
শিবাজি রাজা হওয়ার পর থেকে সম্ভাজি হয়ে ওঠেন উত্তরাধিকারী। এদিকে শিবাজির আরেক স্ত্রী সয়রাবাই চেয়েছিলেন তাঁর ছেলে রাজা হোক! রাজারাম নামের সেই ছেলের জন্ম ১৬৭০ সালে। শিবাজির মাথায় রাজমুকুট ওঠার সময় সে মাত্র চার বছরের ছোট্ট শিশু। কিন্তু সয়রাবাই চেয়েছিলেন ছেলেকে রাজা করতে। প্রসঙ্গত, শিবাজি আটটি বিয়ে করলেও তাঁর পুত্রসন্তান মাত্র দু'টি। অন্যদিকে মেয়ের সংখ্যা ছয়।
শিবাজির মৃত্যু হয় ১৬৮০ সালের ৩ এপ্রিল। মারাঠাদের রাজধানী রায়গড়ের দুর্গে তাঁর মৃত্যুর পর সিংহাসন নিয়ে সংঘাত তুঙ্গে ওঠে। অথচ রাজারামের বয়স তখন মাত্র ১০। সৎ মায়ের সঙ্গে সম্ভাজির বিরোধ চলতে থাকে। শেষপর্যন্ত সেই বছরেরই ২০ জুন সিংহাসনে বসেন সম্ভাজি। মারাঠা সেনাপতি হাম্বির রাও মোহিতের সমর্থনই তাঁকে সিংহাসন পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। রাজারাম, সয়ারাবাইদের গৃহবন্দি করা হয়।
যাই হোক, এবার মুঘলদের প্রসঙ্গে আসা যাক। মারাঠাদের সঙ্গে তাদের শত্রুতা সর্বজনবিদিত। দুই শক্তিশালী সাম্রাজ্যের মধ্যে সংঘাত ছিল তীব্র। ফলে প্রায়ই লেগে থাকত যুদ্ধ। তখন মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের আমল। ১৬৮০ সালে দাক্ষিণাত্য মালভূমি যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তাঁরই হামলায়। অর্থাৎ সম্ভাজির রাজত্বকালেই বেশিরভাগ যুদ্ধ হয়। ১৬৮৭ সালে ওয়াইয়ের যুদ্ধে মৃত্যু হয় মারাঠা সেনাপতি হাম্বিররাও মোহিতের। সেই যুদ্ধে যদিও মারাঠারাই জয়ী হয়েছিল, কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল ছিল অন্যরকম। আসলে মারাঠা সেনার পঞ্চম সেনাপতি হাম্বির রাওয়ের আসল নাম ছিল হানসাজি। তাঁকে হাম্বির রাও উপাধি দিয়েছিলেন ছত্রপতি শিবাজি। এই মানুষটির মৃত্যুর পর মারাঠা সেনার মধ্যে একটা আতঙ্কের সঞ্চার হয়। অনেকেই সম্ভাজিকে ত্যাগ করেন।
এর বছর দুয়েক পরে ১৬৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে মুঘলদের হাতে বন্দি হন সম্ভাজি। তিনি ও তাঁর ২৫ জন মন্ত্রীকে বন্দি করেছিলেন মুকারাব খান। আর এরপরই মুঘলদের প্রবল অত্যাচারে মৃত্যু হয় সম্ভাজির। কিন্তু সেই মৃত্যু ছিল না সহজ। সইতে হয়েছিল প্রবল নির্যাতন। মুঘলদের প্রস্তাব ছিল, সম্ভাজি যদি সমস্ত ধনসম্পদ ও তাঁর সাম্রাজ্য মুঘলদের দিয়ে দেন তবে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হবে। প্রস্তাব ছিল ইসলাম গ্রহণেরও। তিনি সম্মত হননি। শোনা যায়, ঔরঙ্গজেব প্রাণদণ্ডের নির্দেশ দেওয়ার পর উপড়ে নেওয়া হয়েছিল সম্ভাজির দুই চোখ। তাঁর সঙ্গী কবি কলসের জিভও কেটে দেওয়া হয়েছিল। শেষপর্যন্ত ১৬৮৯ সালের ১১ মার্চ দুজনেরই শিরঃচ্ছেদ করা হয় তুলাপুরে ভীম নদীর ধারে। এমনও শোনা যায়, সম্ভাজির দেহ নাকি টুকরো টুকরো করে সেই নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আবার এমনও বলা যায়, টুকরো দেহগুলি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এমনকী দেহের অবশিষ্টাংশ কুকুরদের খাইয়ে দেওয়া হয়, এমন কিংবদন্তিও রয়েছে।
কেন স্রেফ হত্যা না করে এভাবে নির্মম মৃত্যুর করাল কবলে ছুড়ে ফেলা হয়েছিল সম্ভাজিকে? বলা হয়, সম্ভাজিকে এভাবে হত্যা করে বাকি শত্রুদেরও বার্তা দিতে চেয়েছিল মুঘলরা। তাতে তারা নিশ্চয়ই সফল হয়েছিল। কিন্তু সেই সঙ্গে বাতাসের ভিতরে মিশে গিয়েছিল সম্ভাজির বীরত্বের গাথাও। সিংহের গুহায় ঢুকে সিংহের সামনে মেরুদণ্ড ঋজু করে দাঁড়ানোর সেই কাহিনি আজও লোকগাথা হয়ে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। প্রায় চল্লিশ দিন ধরে অকথ্য অত্যাচার করেছিল মুঘলরা। শোনা যায়, প্রথমে চামড়া, পরে নখ উপড়ে নেওয়া হয়। সবশেষে চোখে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় লৌহ শলাকা! ক্ষতে ছড়িয়ে দেওয়া হয় নুন। এবং এত কিছুর পরও সম্ভাজির আশ্চর্য দৃঢ় অবস্থান মুঘলদেরও অবাক করে দিয়েছিল। আজও সেই কাহিনি মিশে রয়েছে বাতাসে। ধর্মবীর সম্ভাজির বীরগাথা ইতিহাসের পাতা হয়ে লোকশ্রুতির চিরকালীন অধ্যায়ে নিজের স্থান করে নিয়েছে।
