সুব্রত বিশ্বাস: রেলের সফটওয়্যার বানিয়ে দালাল সংস্থার কাছে মোটা টাকায় বিক্রি করছিল দীর্ঘদিন ধরে। যে সফটওয়্যার দিয়ে দালাল সংস্থাগুলি নিমেষে কেটে নিচ্ছিল তৎকাল টিকিট। জগদ্দল, বনগাঁ, রানাঘাট, বেলতলা বিভিন্ন জায়গা থেকে একের পর এক দালাল ও এজেন্সি মালিকদের ধরে জিজ্ঞাসাবাদ চালাচ্ছিল আরপিএফ। এরপরই মূল পাণ্ডার সন্ধান পায় তারা। রবিবার রাতে কলকাতার বড়তলা থানা এলাকা থেকে চন্দ্র গুপ্তা নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে আরপিএফ। মাস্টারমাইন্ড চন্দ্রনাথ একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার সিইও বলে জেনেছে পূর্ব রেলের আরপিএফ (RPF)। শিয়ালদহ আদালতের নির্দেশে সোমবার তাকে হেফাজতে নেওয়া হয়। আগে ধৃত আট এজেন্ট এবং দালালকেও গ্রেু্তার করে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে আরপিএফ।
বহু বছর ধরে ইন্টারনেটের মাধ্যমে রেলের টিকিটের অধিকাংশটাই চলে যাচ্ছে দালালচক্রের হাতে। আপৎকালীন পরিষেবার উদ্দেশ্যে যে তৎকাল টিকিটের ব্যবস্থা রয়েছে তা নিমেষে উধাও হচ্ছে সফটওয়্যারের কারিগরীতে। সম্প্রতি রেলের সাইবার ক্রাইম বিভাগ একের পর এক এমন এজেন্সির সন্ধান পাচ্ছে যারা রেলের সফটওয়্যার কিনে তা ব্যবহার করে সাফ করে দিচ্ছে রিজার্ভেশন টিকিট। টিকিট না পেয়ে সাধারণ যাত্রীরা বাধ্য হয়ে দালালদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। সেখানে মোটা টাকা দিয়ে টিকিট করাতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। সম্প্রতি শিয়ালদহ আরপিএফ এর ক্রাইম ইন্টেলিজেন্স বিভাগ, ব্যারাকপুর আরপিএফ, কৃষ্ণনগর আরপিএফ তেহট্ট, বেলঘরিয়া প্রভৃতি অঞ্চল থেকে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে। তারা সফটওয়্যার বিক্রির চক্রের সঙ্গে যুক্ত।
দেশজুড়ে এমন অসংখ্য চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠায় সংরক্ষিত টিকিট পাচ্ছেন না সাধারণ যাত্রীরা। বিশেষত তৎকাল টিকিট দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে এজন্য। সম্প্রতি বোর্ড কর্তাদের সঙ্গে জোন আধিকারিকদের ভিডিও মিটিংয়ে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দালালদের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি তাৎকাল পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ার প্রসঙ্গে ভাবনা চিন্তাও করা শুরু হয়। এই পরিষেবা বাতিল হলে সাধারণ মানুষকে চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হবে। যাত্রীদের মতে, পরীক্ষা, চিকিৎসা, নিকটজনের শারীর খারাপে যাতায়াতে তৎকাল পরিষেবা জরুরি। তা বন্ধ হলে অসুবিধার মধ্যে পড়তে হবে।
[আরও পড়ুন: আনন্দপুরের পর ফুলবাগান, এবার রেস্তরাঁয় শ্লীলতাহানির চেষ্টা তরুণীর, ধৃত ৩]
পূর্ব রেলের লিলুয়ায় প্রথম সাইবার ক্রাইম ধরতে সেল খোলা হয় ১৫ আগস্ট। এরপর একের পর এক দালাল এজেন্ট ধরা পড়ে যারা রেলের সফটওয়্যার বিক্রি করছে। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদন্তকারীরা জেনেছে, উচ্চমানেরই সফটওয়্যারে আগে থেকেই দালালরা যাত্রীর নাম, ঠিকানা, গন্তব্য, তারিখ, ট্রেনের নাম-নম্বর, লিঙ্গ প্রয়োজনীয় সব কিছু তথ্য লোড করে রাখে। রিজার্ভেশনের লিংক খোলা মাত্রই প্রিন্টার ওকে বাটন টেপার সুযোগ মেলে। তড়িৎগতিতে টিকিট বের করে নেয়। এত তাড়াতাড়ি কোনও কাউন্টারে সম্ভব নয়। পূর্ব রেলের রিজার্ভেশনের জনৈক কমার্শিয়াল আধিকারিকের কথায়, টাইপিংয়ে এক্সপার্ট কোনও রিজার্ভেশন ক্লার্ক কাউন্টারে থেকে এত দ্রুত ফর্ম ফিলাপ করতে পারবেন না। একটা ফর্ম ফিলাপ করে টিকিট করতে ন্যূনতম সাত-আট সেকেন্ড লাগবেই। ততক্ষণে দালালরা কাজ হাসিল করে ফেলে। রেলের রিকুইজিশনে এক সঙ্গে ছ'জনের টিকিট করা গেলেও, এজেন্টদের কাছে এক সঙ্গে বারোজনের টিকিট করার সুযোগ রয়েছে।
এজেন্সি নিয়োগ করে আইআরসিটিসি। এখন রেলের আশি শতাংশই ই-টিকিট। যা নিয়ন্ত্রণ করে কর্পোরেট সংস্থাটি। রেল সরাসরি নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এই দুর্নীতি চক্র মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। যার ফল ভোগ করছেন সাধারণ মানুষ। উল্লেখ্য, বেশ কয়েক বছর আগে দিল্লির চাঁদনী চক এলাকার কয়েকটি সংস্থা উন্নতমানের রেলেই সফটওয়্যার বাজারে বিক্রি করা শুরু করে। শুরু হয় তদন্ত। ধরা পড়ে চক্রের পাণ্ডারা। রেলের সঙ্গে যুক্ত কর্পোরেট সংস্থার কয়েকজন আধিকারিকও ধরা পড়ে ছিল। আবার এধরনের চক্র সক্রিয় হওয়ায় উদ্বেগ বেড়েছে রেলের।