সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: দিয়েগো মারাদোনা কোপা আমেরিকা জেতেননি কখনও। উইম্বলডন অধরাই থেকে গিয়েছে ইভান লেন্ডলের কাছে। বিশ্বকাপ ছোঁয়া হয়নি ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর। তেমনই আইপিএল বিরাট কোহলির (Virat Kohli) অধরা-স্টেশন হয়েই রয়ে গেল। এবারও।
রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু (Royal Challengers Bengaluru) রূপকথা থেমে গেল বুধরাতে। নিরুচ্চারে আরও একবার বলে দিয়ে গেল, ক্রিকেট আসলে টিম গেম। দীর্ঘ ১৭ বছর 'কিং কোহলি' খেলছেন একই ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে। কাপ না পাওয়ার আক্ষেপ আরও একবার তাড়া করল তাঁকে। ব্যর্থ মনোরথে বুধবার রাতে নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম থেকে নিঃশব্দে মহানিষ্ক্রমণ ঘটল বিরাট কোহলির। আক্ষেপ-হতাশা নিংড়ে নিচ্ছিল মহাতারকাকে। শরীর দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছিল না পাওয়ার যন্ত্রণা।
বেঙ্গালুরু দিগভ্রষ্ট হওয়ার পরদিন কেভিন পিটারসেনের মতো তারকা অযাচিত ভাবে কোহলিকে পরামর্শ দিয়ে গেলেন, ''দল পরিবর্তন করে দেখতে পারো বিরাট।'' যদি ভাগ্য খোলে!
[আরও পড়ুন: ‘জীবনে ভয় থাকা জরুরি!’ হঠাৎ কেন এমন মন্তব্য ধোনির?]
প্রতি বছর আইপিএল শুরুর সময়ে ফেভারিটের তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয় আরসিবির জার্সিতে। আর দিনের শেষে প্রাপ্তি হয়ে রয়ে যায় সেই হতাশা।
মনে পড়ে যায় সেই কবিতার লাইন-
রাজা আসে যায় রাজা বদলায়
নীল জামা গায় লাল জামা গায়
এই রাজা আসে ওই রাজা যায়
জামা কাপড়ের রং বদলায়….
দিন বদলায় না!
বছর বদলায়, সেই একই চিত্রনাট্য বদলায় না। বদলাতে পারেননি কোহলি নিজেও।
দেড় দশকের বেশি সময় ধরে আরসিবি নামের হেভিওয়েট ব্র্যান্ডের পোস্টার বয় বিরাট কোহলি। মাঠের বাইরে ব্র্যান্ড এনডোর্সমেন্টের উপার্জনে অনুঘটক স্বয়ং 'কিং কোহলি'। ক্রিকেট যদি পণ্য হয়, তাহলে সেই পণ্যের বিশ্বজনীন পণ্যদূত যে দিল্লির ছেলেটাই।
মাঠের বাইরে অবিসংবাদী চরিত্র। মাঠের মধ্যেও নিয়মিত ব্যাটে ঝড় তুলেছেন চিরচেনা লাল জার্সিতে। স্ট্রাইক রেট ইস্যুতে সমালোচকদের ব্যাটেই জবাব দিয়েছেন। অরেঞ্জ ক্যাপ জেতার দৌড়ে সবার আগে কোহলি। ১৫ ইনিংসে ৭৪১ রানের মালিক। তবুও তাঁর দলের রথের চাকা থেমে গেল আসল সময়ে।
আরসিবি আসলে সুপারস্টার সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী। যে দর্শন বলে, খেলা থাকুক নিজের মতো, নিজের জায়গায়। তারকাদের হাতেই আসলে খেলাটার জিয়নকাঠি। তাঁদের দেখতেই মাঠ ভরাবেন ভক্ত-অনুরাগীরা। ব্যক্তিগত প্রতিভার ঝলকানিতে বিপক্ষকে মাটি ধরিয়ে বিজয়কেতন ওড়াবে আরসিবি।
এই দর্শন, এই বিশ্বাস থেকেই আরসিবিতে আবির্ভাব ঘটেছে এবি ডিভিলিয়ার্স, ক্রিস গেইল, শেন ওয়াটসন, গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, ফ্যাফ দু প্লেসিস, অনিল কুম্বলে, মুথাইয়া মুরলীধরন, মিচেল স্টার্কদের মতো প্রবাদপ্রতিম মহীরুহদের। নিজেদের দিনে জ্বলে উঠলে তাঁদের রোখে কার সাধ্যি! একেক দিনে একেকজন জ্বলবেন হয়তো কিন্তু সমষ্টিগত ভাবে আলো জ্বালালেন কবে?
গত কয়েকটি আইপিএলের স্কোর কার্ড বলছে, বিরাট কোহলি প্রায় প্রতি বছরই রানের এক শৃঙ্গ থেকে আরেক শৃঙ্গে বিচরণ করেছেন কিন্তু তাঁর দল আছড়ে পড়েছে বাস্তবের রুখা সুখা জমিতে।
চলতি বছর খাদের কিনারা থেকে একটা দলকে একা কোহলি পৌঁছে দিয়েছেন প্লে অফে। অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন ঘটিয়ে ভক্ত-অনুরাগীদের মুখে হাজার ওয়াটের আলো এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু মোক্ষম সময়ে চলল না বিরাট-ম্যাজিক। তারকাপ্রথার এই এক সমস্যা। ব্যক্তিগত দক্ষতার এটাই অন্ধকার, নেতিবাচক দিক। শুধু বিরাট কেন? গ্লেন ম্যাক্সওয়েল নামের এক ঝড় 'ডাক' দেখার রেকর্ডই করে বসলেন। ১০টি ম্যাচ থেকে মাত্র ৫২ রান করেন ম্যাড ম্যাক্স। তাঁর ব্যাট বোবা থেকে যাওয়ায় ভুগতে হয়েছে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুকে। কে ভুলতে পারে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে পায়ে চোট নিয়ে অজি তারকা একাই উড়িয়ে দিয়েছিলেন আফগানিস্তানকে। আসল দিনে অধিনায়ক ডুপ্লেসিসের 'গাণ্ডীব'ও বিশ্বাসঘাতকতা করে বসে। ১৭২ রানের পুঁজি নিয়ে বেঙ্গালুরু বোলাররা আগুন জ্বালাতে আর পারলেন কোথায়! রাজস্থান ব্যাটারদের জন্য আরও প্রলম্বিত হল আরসিবির খেতাব জেতার স্বপ্ন। কবে আসবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ কেউ জানেন না।
দল হয়ে না ওঠায় শচীন তেণ্ডুলকরকেও অনন্ত প্রতীক্ষায় থাকতে হয়েছিল। ছনম্বর বিশ্বকাপে এসে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ পেয়েছিলেন মাস্টার ব্লাস্টার। নিজের পঞ্চম বিশ্বকাপে এসে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করেছিলেন এলএম ১০।
মণিমাণিক্য দিয়ে দল তৈরি করেও প্যারিস সাঁ জাঁর বিপর্যয়ই দেখেছে ফুটবলবিশ্ব। একক প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে এক পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির খর্বকায় আর্জেন্টাইন মেক্সিকোয় রূপকথা লিখে গিয়েছিলেন। ফুটবল-ঈশ্বর মারাদোনার সেই ক্যারিশমা ব্যতিক্রম হিসেবেই ধরা হয়। তা কখনও নিয়ম নয়।
ফুটবলের মতো ক্রিকেটও আসলে টিম গেম। একক কৃতিত্বে ক্রিকেট ম্যাচ জিতিয়ে দেওয়ার নজির রয়েছে বহু। তবে লম্বা লিগে একক দক্ষতা, প্রতিভার ঝলকানি ফিকে হয়ে যায় ধারাবাহিকতার কাছে। ধারাবাহিকতাই শেষ কথা বলে যায়। বলতে দ্বিধা দ্বন্দ্ব নেই, গোটা টুর্নামেন্ট জুড়ে সেই ধারাবাহিকতাই মিসিং লিঙ্ক হয়ে থেকে গেল আরসিবি-তে।
ঘটনাচক্রে কোহলি-দুপ্লেসিসদের স্বপ্ন যে দল ভেঙেচুরে দিল বুধরাতের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামে, সেই দলের দর্শন আবার বিপরীত মুখী।
কোনও এক শেন ওয়ার্ন সেই কবে সুপারস্টারহীন একটা দলকে প্ৰথম মরশুমেই চ্যাম্পিয়ন করে গিয়েছিলেন। তারপর বছরের পর বছর কেটে গিয়েছে, জাদুকর ওয়ার্নও পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গিয়েছেন কিন্তু অজি কিংবদন্তি ওয়ার্নের রাস্তা থেকে সরে আসেনি রাজস্থান। সঞ্জু স্যামসনের নেতৃত্বে একটা লড়াকু, পরিশ্রমী দল তৈরি করেছে রয়্যালস পরিবার।
চলতি আইপিএলের শুরু থেকে দুদ্দাড়িয়ে ছুটছে কলকাতা নাইট রাইডার্স। তাদের মেন্টর গৌতম গম্ভীর প্রথম দিনই পরিষ্কার করে দিয়েছেন তাঁর দর্শন, ''এই গ্রুপের প্রত্যেকের সঙ্গে সমান ব্যবহার করা হবে। এখানে সিনিয়র-জুনিয়রের ভেদাভেদ নেই। ঘরোয়া ক্রিকেটার বা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারের মধ্যে কোনও পার্থক্য করা হবে না। আমাদের একটাই লক্ষ্য। একটাই মিশন। সেটা হল আইপিএল জয়। প্রত্যেককেই একটা সহজ সরল পথ অবলম্বন করতে হবে। ২৬ মে আমাদের ফাইনাল খেলতে হবে।'' একটা দল হয়ে উঠে ফাইনালের টিকিট জোগাড় করেছে কেকেআর।
দীর্ঘ সতেরো বছরেও আরসিবি একটা দল হয়ে উঠতে পারল না? কোহলিদের লাগাতার ব্যর্থতা কিন্তু সেই প্রশ্নই তুলে দিয়ে যাচ্ছে। তারকা সংস্কৃতি কি আগামী দিনে বদলাবে বেঙ্গালুরু? উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ।