মাহশা আমিনি-র মৃত্যু ইরানি মেয়েদের জাগিয়ে দিয়েছে। সে-দেশের রাজপথে মেয়েরা হিজাব/বোরখা খুলে কেটে ফেলছেন লম্বা চুল। অন্যদিকে ভারতে, কর্নাটক সরকার শিক্ষালয়ে হিজাব পরার অধিকার হরণের পর, কলেজের পথে বোরখা পরিহিত মুসকানকে তাড়া করেছিল পৌরুষ ফলানো বাহিনী। ইরানের নারীদের লড়াই কর্নাটকের মুসকানের অভিমুখে পৌঁছে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে, কখন পিতৃতন্ত্রের বর্ম, মেয়ে আপনিই খসিয়ে ফেলবে। কলমে শতাব্দী দাশ
ইরানে যে নারীজাগরণ ঘটছে এই মুহূর্তে, হিজাব-বিরোধিতা তার প্রধানতম দিক। এদিকে কিছুদিন আগেই ‘হিজাব আমার অধিকার’ ব্যানার নিয়ে মিছিল হয়েছে কলকাতা-সহ দেশের নানা শহরে। কর্নাটক সরকার শিক্ষালয়ে হিজাব পরার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার পর, কলেজের পথে বোরখা পরিহিত মুসকানকে তাড়া করেছিল ‘জয় শ্রীরাম’ রবে পৌরুষ ফলানো বাহিনী। মুসকান ‘আল্লা হু আকবর’ বলে জবাব দিয়েছে। হিজাবে-বোরখায় তার সাহস চাপা পড়েনি। তারই সমর্থনে ছিল ওই মিছিলসমূহ।
সেসব কথা ইরানেরও (Iran) অজানা নয়। বস্তুত, সম্প্রতি ইরানের এই ডামাডোলের মধ্যে, জনৈক ইরানি নারীর টুইটে ভারতের উল্লেখ দেখে ক্ষণিকের জন্য চমকে উঠলাম। হোদা কাতেবি নামের এই নারী নিজেকে ইসলামের সমর্থক ও বহু বছরের হিজাবি বলে দাবি করছেন। কিন্তু বলছেন, ‘হিজাবে আগুন দেওয়া ইসলামের অবমাননা’- এই কথা বলে মুসলমান ও অ-মুসলমান বোনেদের ভগিনিত্বে চিড় ধরানো হচ্ছে। সে-চেষ্টা করছে তাঁরই দেশের নেতারা। তা করতে গিয়ে তাঁরা ভারতের প্রসঙ্গও টানছেন হয়তো। নাহলে তিনি কেন বলছেন, ‘ইরানি মেয়েদের নিজের হিজাব পুড়িয়ে ফেলা, আর ভারতের মতো ফ্যাসিস্ট দেশে সরকারি মদতে মুসলিম নারীর হিজাব পুড়িয়ে দেওয়ায় তফাত আছে!’ হিজাব পুড়িয়ে না দেওয়া হলেও, ভারতে হিজাব নিষিদ্ধ করা হয়েছে শিক্ষাঙ্গনে, বা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে হিজাব ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনা হয়েছে মেয়েদের, এ-ও তো ঘটনা।
[আরও পড়ুন: মহালয়া ও বাঙালির বেতার-বিলাস]
প্রশ্নটা আসলে সরল ও জটিল একাধারে। প্রশ্নটার মুখোমুখি হতে চাই না বলে আমরা ‘চয়েস ফেমিনিজম’-কে আশ্রয় করি। ‘চয়েস ফেমিনিজম’ হল, ‘মেয়েকে যা ইচ্ছে করতে দাও। বাছার অধিকার দাও। কারণ এতদিন তার বাছার অধিকার খর্ব হয়েছে।’ এই তত্ত্ব অনুযায়ী, কেউ যদি গৃহবধূ হতে চায়, চায় শাঁখা-সিঁদুরে সাজতে, বা বোরখা পরতে, তাহলে সেই ইচ্ছাকে সম্মান জানানো বাঞ্ছনীয়। কিন্তু ‘চয়েস ফেমিনিজম’-এর সীমাবদ্ধতা হল, তা বুঝতে অপারগ যে, চয়েস শূন্যস্থানে সৃষ্ট হয় না। সামাজিক অনুঘটক যে কোনও চয়েস ও তার বিরোধিতার পিছনে কার্যকর। বাধ্য বধূ বা নারীবাদী- সকলেই নিজ নিজ সামাজিক স্থানাঙ্কের কারণে প্রতিরোধ বা বশ্যতা বেছেছেন। তাই সামাজিক অবস্থা-বিযুক্ত চয়েসের আলোচনা অবান্তর।
২২ বছরের মাহশা আমিনির মৃত্যু, ‘ঠিক করে’ হিজাব পরেনি বলে নীতিপুলিশের বেধড়ক ঠ্যাঙানিতে খুলির হাড় ভেঙে কোমায় চলে যাওয়া মাহশা আমিনির মৃত্যু সেই সামাজিক বাস্তবতাকে ‘চয়েস’-এর চেয়ে বড় করে তোলে। তাঁর দেশের হিজাবিনীরাও বুঝতে পারেন- হিজাব খুললেই তা পশ্চিমি শত্রুদের কাছে আত্মসমর্পণ করার সমতুল্য, এমন ভাবনার মধ্যেও কিছু মস্তিষ্কপ্রক্ষালন থাকতে পারে। মাহশার মৃত্যু মেয়েদের জাগিয়ে দিয়ে গিয়েছে বলেই ইরানের রাজপথে প্রতিবাদী মেয়েরা হিজাব/বোরখা খুলে কেটে ফেলছেন লম্বা চুল। মাহশা প্রশ্ন করতে শেখাচ্ছেন পূর্বোল্লিখিত ইসলামপ্রেমী হোদা কাতেবি-কে। তিনি বলছেন, ‘আজ যদি ইজরায়েলের পতাকা পুড়িয়ে দেওয়া হয় প্যালেস্তাইনে, কারণ ওরা নরহত্যাকারী, তাহলে কি বলা হবে তা ইসলামের অপমান, কারণ ওই পতাকায় ইসলামিক তারকা আছে? ঠিক তেমনই হিজাব এদেশে অত্যাচারের প্রতীক হয়ে উঠেছে, ইসলামের নয়।’
একই সময়ে উপমহাদেশের আরেক দেশেও চলছে হিজাব নিয়ে সংঘাত। ‘সাফ গেমস’ জিতে আসা বাংলাদেশের নারী-ফুটবলাররা দোজখে যাবেন কি না, তা নিয়ে সে-দেশের কট্টরপন্থীরা বড়ই চিন্তিত। ঊরু দেখানো মেয়েদের বিরুদ্ধে আর হিজাবের পক্ষে সে-দেশেও মিছিল দেখা যায়। অদ্ভুত সমাপতনে আর যে দেশটি এই মুহূর্তে হিজাব-বিরোধিতায় মুখর, সেই ইরানে বন্দি থাকেন জাফর পানাহি, যিনি গোপনে মেয়েদের ফুটবল খেলা দেখতে যাওয়ার কল্পনা করেছিলেন ‘অফসাইড’ ছবিতে।
হিজাব-বিরোধিতা বা হিজাব-সমর্থন- উভয় ক্ষেত্রেই কনটেক্সট তাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আমেরিকা-ইউরোপের নানা দেশেই অভিবাসী মুসলিমদের কাছে ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চিহ্ন হয়ে উঠেছিল হিজাব, টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর। উনিশ শতকে ইংরেজ ও ফরাসিরা যখন যে মুসলমান দেশে উপনিবেশ স্থাপন করেছে, তখন সেই দেশের মেয়েদের হিজাব পরা নিষিদ্ধ করতে চেয়েছে। ফ্র্যাঞ্জ ফ্যানন-এর ‘আলজেরিয়া আনভেল্ড’-এ ব্যঙ্গ করে ফ্যানন বলেছিলেন, ‘(বোরখার কারণে) শাসিতকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু সে সব দেখতে পাচ্ছে, এই চিন্তা থেকে আসে শাসকের হতাশা।’ আবার অন্যদিকে, পাঁচ বছর আগে, ২০১৭ সালে ভিদা মোহাভেদ নামের এক ইরানি মেয়ে তেহরানের রাস্তায় হিজাব খুলে আকাশে উড়িয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। আফগানিস্তানের ‘রাওয়া’ নামের নারীবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা মীনা পর্দার বিপক্ষে আর নারীশিক্ষার পক্ষে আজীবন লড়ে, শেষে খুন হন মৌলবাদীদের হাতে। এসবও ভোলার নয়।
প্রশ্ন এ-ও উঠতে পারে, নারী ও নারী-শরীরকেই সংস্কৃতি/ঐতিহ্যর বাহক হতে হবে কেন? কেন নারীকেই ঘোমটা টেনে, বা কবীর সিং-খ্যাত ‘চুন্নি ঠিক কর লো, প্রীতি’ নির্দেশে মাথা হেলিয়ে, বা বোরখা-হিজাবে নিজেকে ঢেকে সংস্কৃতি রক্ষা করতে হবে? ‘সংস্কৃতি’ বলে আমরা যাকে চিনি, সে ভালয়-মন্দয় মেশানো এক যাপন, যার মন্দ দিকগুলোর অন্যতম হল নারীবিদ্বেষে স্বাচ্ছন্দ্য। সেই সংস্কৃতিকেই যখন রক্ষা করতে হয় বিপক্ষ সংস্কৃতির আগ্রাসনের হাত থেকে, তখন নারীবিদ্বেষী চিহ্নও যে বহন করতেই হয়! করতেই হয়?
হিজাব-ফেমিনিজম ভারতেও প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে- কারণ সংখ্যালঘু হিসাবে মুসলমান মেয়েদের কোণঠাসা করা হচ্ছে। তেমনটা না হলে, চাওয়াটা যে অন্য হত না, চাওয়াটা মাহশা-র মতো হত না, তা কি নিশ্চিত করে বলা যায়? ইরানের নারীদের লড়াই কর্নাটকের মুসকানের অভিমুখে পৌঁছে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে, কখন পিতৃতন্ত্রের বর্ম, তা সে ঘোমটা হোক বা হিজাব বা চিকের আড়াল, মেয়ে আপনিই খসিয়ে ফেলবে। ততদিন একে অপরের গল্পগুলো শোনা, বোধে প্রবেশ করানো, তা আরও পাঁচজন নারীর কাছে পৌঁছে দেওয়া আর সহমর্মী হওয়া- এই হতে পারে নারীধর্ম। দুই দল দড়ির দুই দিকে তো নয়! আসলে সকলেই আছি দড়ির একই ধারে।