‘হু’-র হিসাবে ২০২০ ও ’২১ সালে ভারতে কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা ৪৭ লক্ষ ৪০ হাজার। যা সরকারের দেওয়া কোভিডে মৃত্যুর হিসাবের প্রায় দশ গুণ। তাহলে কি ভারতে ৯০ শতাংশ কোভিড-মৃত্যু সরকারিভাবে নথিভুক্তই হয়নি? ‘প্রকৃত’ মৃত্যুর সংখ্যাটা যদি সরকারের কারচুপি হয়, তাহলে তা ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে এক অশনিসংকেত। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী
কোভিডে অতিরিক্ত মৃত্যুর তথ্য পেশ করে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ বেজায় অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে নরেন্দ্র মোদির সরকারকে। হালে দেখা যাচ্ছে যে, কোভিডে মৃত্যুর প্রাথমিক পরিসংখ্যান সর্বত্রই কম-বেশি ছাপিয়ে গিয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তথা ‘হু’-র হিসাবে, ২০২০ ও ২০২১ সালে ভারতে কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা ৪৭ লক্ষ ৪০ হাজার। যা সরকারের দেওয়া কোভিডে-মৃত্যুর হিসাবের দশ গুণ। অর্থাৎ, ‘হু’-র দাবি অনুযায়ী, ভারতে ৯০ শতাংশ কোভিড-মৃত্যু সরকারের ঘরে নথিভুক্তই হয়নি।
গত বছরের এই সময়ে যখন দেশে কোভিডের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ আছড়ে পড়েছিল, তখন একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা দাবি করেছিল যে, ভারতে কোভিডে মৃতু্যর সঠিক গণনা হচ্ছে না। দ্বিতীয় ঢেউয়ের দিনগুলির সেই ভয়াবহ স্মৃতি কেউই হয়তো ভুলতে পারেনি। বস্তুত, দেশে এমন পরিবারের সংখ্যা খুবই কম, যারা দ্বিতীয় ঢেউয়ে কোনও আত্মীয়-পরিজনকে হারায়নি। দেশের রাজধানীতে যমুনা নদীর তীর ধরে গণচিতা জ্বলার দৃশ্য এখনও স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে। এইরকম গণচিতা দেশের বহু শহরে সেই সময়ে জ্বলেছিল। উত্তরপ্রদেশে শ’য়ে-শ’য়ে কোভিডে মৃতর দেহ গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৪০ কোটির দেশে যখন মৃত্যু প্রায় ঘরে ঘরে, তখন সরকারি হিসাবে দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃতর সংখ্যাটা কী করে দু’-তিন লাখের মধ্যে থাকে, সেই প্রশ্ন খুব বড় করে দেখা দিয়েছিল বিশ্বে। মোদি সরকারের দেওয়া হিসাবে ২০২১ সালে দেশে কোভিডে মোট মৃত্যু হয়েছে ৩ লক্ষ ৩২ হাজার মানুষের। ‘হু’ সম্প্রতি যে-তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে, ২০২১-এ ভারতে কোভিড মৃতু্যর সংখ্যাটা ৩৯ লক্ষের কম নয়। একই দাবি করা হয়েছিল ২০২১-এর জুন মাসে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিকিৎসা বিষয়ক পত্রিকা ‘দ্য ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত একটি নিবন্ধে। যা নিয়ে ঝড় উঠেছিল দেশে। মোদি সরকারের দাবি ছিল, তথ্যে বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে। ‘হু’-র সাম্প্রতিক রিপোর্টের পরেও কেন্দ্রীয় সরকার তথ্যর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। যে গাণিতিক পদ্ধতিতে ‘হু’-র বিশেষজ্ঞরা কোভিডে বিশ্বজুড়ে অতিরিক্ত মৃতু্যর সংখ্যা নিরূপণ করেছেন, তাকেই মোদি সরকার ভুল বলে উড়িয়ে দিচ্ছে।
[আরও পড়ুন: ভারতীয় রাজনীতিতে অব্যাহত প্রতিহিংসার ধারা, সংবিধানের শক্তি কি গতায়ু?]
কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা যে শুধুমাত্র ভারতেই কম করে দেখানো হয়েছে, তেমনটা কিন্তু ‘হু’-র রিপোর্টে দাবি করা হয়নি। ‘হু’-র হিসাবে বিশ্বে কোভিডে মৃত্যুর যে সংখ্যা বলা হচ্ছে, বাস্তবে তার চেয়ে সংখ্যাটা এক কোটি বেশি। এই এক কোটির মধে্য ৪৩ লক্ষ যে শুধু ভারতেই! অতিরিক্ত মৃতু্যর এই হিসাবে সরাসরি কোভিড ছাড়াও পরোক্ষভাবে কোভিডের কারণে ঘটা মৃতু্যকেও ধরা হচ্ছে। ২০২০ ও ২০২১ সালে পৃথিবীতে তার আগের বছরগুলোর তুলনায় অতিরিক্ত যে মৃতু্য ঘটেছে, তার সংখ্যা থেকেই গাণিতিক মডেল নির্মাণ করে ‘হু’ কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা বের করার চেষ্টা করেছে।
ভারতে সারা বছরে যত মানুষের মৃত্যু হয়, তাদের অর্ধেকই বাড়িতে মারা যায়। বাড়িতে মৃতু্যর ক্ষেত্রে অধিকাংশরই মৃতু্যর কারণ কোন রোগে- তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা হয় না। বাড়িতে মৃতু্যর যে-ঘটনা ঘটে, তার সিংহভাগ সরকারিভাবে নথিভুক্তও হয় না। দেশের অসংখ্য প্রত্যন্ত এলাকায় এখন শ্মশানে দাহ করতে গেলে বা কবর দেওয়ার জন্য মৃত্যু শংসাপত্রেরও প্রয়োজন হয় না। ফলে, কোভিডে মৃতু্যর ক্ষেত্রে সরকার সঠিক রিপোর্ট দেবে, এমনটা ভাবা কীভাবে সম্ভব? ‘হু’ তাদের এই অতিরিক্ত মৃতু্যর রিপোর্ট বের করার দু’দিন আগেই কেন্দ্রীয় সরকার ২০২০ সালে ‘সিভিল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম’-এর তথ্য প্রকাশ করেছে। কেন্দ্রের তরফে দাবি করা হয়েছে, ২০২০ সালে দেশে যত মৃতু্য ঘটেছে, তার ৯৯.৯ শতাংশই নাকি নথিভুক্ত হয়েছে। সরকারের এই দাবি যে একেবারেই অবান্তর, তা নিয়ে বিতর্ক করার কোনও মানেই হয় না। ২০২১-এর মে-জুন মাসে আমরা উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে গঙ্গায় শ’য়ে-শ’য়ে মৃতদেহ ভাসতে দেখেছি। এই মৃতদেহগুলো কি সমস্ত সরকারি খাতায় নথিভুক্ত ছিল? যদি সরকারিভাবে এগুলো নথিভুক্ত মৃতু্য হয়েই থাকে, তাহলে নদীতে ভাসানোর কী প্রয়োজন ছিল?
কোভিডে-মৃতদের পরিবারকে সরকার ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজে্যই দেখা গিয়েছে সরকারি হিসাবে যেখানে সেই রাজে্য কোভিডে মোট মৃতু্যর সংখ্যা ১০ হাজার ৯৪৩ জন দেখানো হচ্ছে, সেখানে ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন জমা পড়েছে ১ লক্ষ ২১ হাজার ২৭১টি। অর্থাৎ, সরকারি হিসাবে যা মৃতু্য, তার দশ গুণ বেশি পরিবার দাবি করেছে ক্ষতিপূরণের। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর রাজে্য যদি চিত্রটা এই হয়ে থাকে, তাহলে কীভাবে বলা সম্ভব কোভিডে মৃতু্যর প্রকৃত হিসাব সরকারের কাছে রয়েছে? সরকারিভাবে বলাও হয়নি প্রধানমন্ত্রীর রাজে্য কত আবেদন ভুয়া! যদি প্রধানমন্ত্রীর রাজে্যর চিত্রটা গোটা দেশেই বাস্তব হয়, তাহলে কোভিডে দেশে ‘প্রকৃত’ মৃতু্যর সংখ্যা ‘হু’-র দেওয়া তথে্যর সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
আসলে, গোড়া থেকেই মোদি সরকারের তরফে চেষ্টা ছিল দেশে কোভিডে মৃতু্য কিছুটা কমিয়ে দেখানোর। লকডাউনের শুরুতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে মোদি বলেছিলেন, লড়াইটা মাত্র সাতদিনের। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের চেয়েও কম সময়ের। মোদি সরকার সবসময়ই কোভিড মোকাবিলায় সরকারি ব্যর্থতার থেকে দেশের মানুষের চোখটা ঘুরিয়ে রাখতে চেয়েছিল। দেশে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর যে কঙ্কালসার চেহারা, তা সরকারের তরফে আড়াল করার একটা তাগিদ ছিল। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশজু়ড়ে অক্সিজেনের সংকট, ওষুধের সংকট, হাসপাতালে বেডের অভাব- চোখে আঙুল দিয়ে ‘প্রকৃত’ ছবিটা দেখিয়ে দিয়েছে। তখন মৃতু্যর সংখ্যা গোপন করে ভাবমূর্তি-সচেতন মোদি সরকারের লক্ষ্য ছিল স্বাস্থ্যক্ষেত্রের এই দৈন্যদশাকে বিশ্বের সামনে আড়াল করা।
ভবিষ্যতের স্বার্থেই কোভিডে মৃতু্যর প্রকৃত তথ্যটা সামনে আসা জরুরি। দেশের একটা বড় অংশের মৃত্যু যে নথিভুক্ত হয় না, সেই বাস্তবটা রাতারাতি বদলে দেওয়া সম্ভব নয়। এত বিশাল দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোথায়-কী ঘটছে, তার সবটা এখন সরকারের নজরদারির আওতায় আসে না। সরকারও জানে সেই কথা। কিন্তু ‘প্রকৃত’ মৃতু্যর সংখ্যাটা যদি সরকারের তরফে কম করে দেখানোর চেষ্টা থেকে যায়, তাহলে তা ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে এক অশনিসংকেত। কোভিড মোকাবিলায় দু’-বছরের এই অভিজ্ঞতা থেকেই আগামী দিনের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ভিত রচনা করা হবে। সরকারের উচিত ‘হু’-র এই তথ্যকে মান্যতা দিয়ে সেইমতো পদক্ষেপ করা।
এটা ঠিক যে, কোভিড মোকাবিলায় ‘হু’-র ভূমিকা নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে। ‘হু’-প্রধানের বহু মন্তব্য সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলেছে। সংক্রমণের গোড়ায় ‘হু’ প্রধান বলেছিলেন, ‘করোনাভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না।’ ‘হু’ প্রধানের এই দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য কোভিড মোকাবিলার প্রস্তুতির ক্ষেত্রে বিশ্বকেই বড় ধাক্কা দিয়েছিল বলে মনে করা হয়। ফলে ‘হু’-র দাবি করা কোনও তথে্যর পক্ষে সওয়াল করার আগে বিভিন্ন বিষয়ে বিবেচনা করা অবশ্যই জরুরি। মৃত্যুর ক্ষেত্রে ‘হু’ যে তথ্য সামনে এনেছে, তা গত একবছর ধরেই বিভিন্ন গবেষক ও সমীক্ষক সংস্থার দেওয়া রিপোর্টে উঠে আসছে। মোদি সরকারের উচিত সেই আলোকেই বিষয়টি দেখা। গুজরাতে সরকারি হিসাবে কোভিডে মৃত্যু ও ক্ষতিপূরণ আবেদনকারীর সংখ্যার মধে্য বিরাট তারতম্য, সেখান থেকেও মোদি সরকারের শিক্ষা নেওয়া জরুরি।