shono
Advertisement

অমরত্বের পথে একধাপ! মানুষের অধরা স্বপ্ন পূরণ করতে পারে জেলিফিশ?

সত্য়িই কি নশ্বর মানুষ পেতে পারে অমরত্ব?
Posted: 05:26 PM Sep 02, 2022Updated: 05:26 PM Sep 02, 2022

বিশ্বদীপ দে: ‘শুধু কবিতার জন্য’ ‘অমরত্ব তাচ্ছিল্য’ করেছিলেন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কবির মন একথা বললেও সাধারণ মানুষের মনের কোণে কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়ী হওয়ার চিরকালীন বাসনা হয়ে বয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে। শুধু মানুষ কেন, অমরত্ব পেতে দেবাসুরে অমৃত নিয়ে কী কাণ্ড হয়েছিল ভাবুন তো! কিন্তু সত্য়িই কি নশ্বর মানুষ পেতে পারে অমরত্ব (Immortality)? আপাতত এই প্রশ্নের উত্তরে জেলিফিশের (Jellyfish) দিকে তাকিয়ে বিজ্ঞানীরা।

Advertisement

হ্য়াঁ, জেলিফিশ। টারিটোপসিস ডোরনি নামের প্রজাতির এক জেলিফিশকে নিয়ে দীর্ঘদিনের আগ্রহ বিজ্ঞানীদের। এদের ‘অমর জেলিফিশ’ বলেই চেনে সবাই। এবার স্পেনের গবেষকরা এই মাছের জিনোমের পাঠোদ্ধার করে ফেলেছেন। কী এই জিনোম? যে কোনও প্রজাতির জীবের বংশগতির সব তথ্য জমা থাকে জিনে। বংশগত ভাবে জিনের যে ধারাবাহিক তথ্য তাকে একত্রে জিনোম বলা হয়। সহজ ভাষায় বললে এই জিনোম যেন ওই প্রজাতির জীবনধারণের নীল নকশা। যা পাঠ করার অর্থ তাদের জীবনের গতিপ্রকৃতি ও রহস্যকে ধরে ফেলা। ‘ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস’-এ প্রকাশিত হয়েছে এই সংক্রান্ত গবেষণাপত্রটি। কেন এই জিনোমের পাঠোদ্ধারকে ঘিরে এত শোরগোল? সেকথা বলার আগে একবার ফিরে দেখা যাক মানুষের অমরত্বের স্বপ্নকে, যা বোধহয় সমাজ গঠনেরও আগে থেকে মানুষের মনের মধ্যে বাসা বাঁধতে শুরু করেছিল।

টারিটোপসিস ডোরনি

[আরও পড়ুন: ‘সোমবার পর্যন্ত অভিষেকের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নয়’, ইডির জেরার মধ্যেই জানাল সুপ্রিম কোর্ট]

অষ্টাদশ শতাব্দীর কথা। লুই গ্যালভানি নামের এক চিকিৎসক একটা অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করলেন। তিনি পরীক্ষা করে দেখলেন দুটি ভিন্ন ধাতু, যেমন তামা ও দস্তাকে যদি একসঙ্গে জুড়ে একটি মরা ব্যাঙের স্নায়ুর আলাদা অংশে স্পর্শ করানো যায়, তাহলে সেই প্রাণহীন ব্যাঙের শরীরে যেন জীবনের স্পন্দন ফিরে আসে! নড়ে ওঠে তার পা। তিনি এর নাম দিলেন প্রাণী বিদ্যুৎ। তাঁর মতে, এই বিদ্যুৎ আসলে থাকে জীবকোষের মধ্যেই। প্রাণীর মৃত্যুর পরেও তা থেকে যায় তার শরীরের ভিতরে।

এই বিতর্কে তখন চারদিক তোলপাড়। গ্যালভানির ব্যাখ্যায় উৎসাহিত হয়ে কেউ কেউ ফাঁসিতে মৃত অপরাধীকে ইলেকট্রিক শক দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন! যদি প্রাণ ফেরানো যায় মানুষটির শরীরে! মেরি শেলি তাঁর উপন্যাসের প্রেরণা পেয়েছিলেন এই আবিষ্কার থেকেই। লেখা হয় ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন অর দ্য মডার্ন প্রমিথিউসে’র মতো কালজয়ী এক কাহিনি। যা তুলে দেয় এক প্রশ্ন। অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা কি তাহলে মৃতের প্রাণ ফেরাতে জন্ম দিতে পারে দানবের? না, গ্যালভানির ‘প্রাণী বিদ্যুতে’র থিয়োরি দ্রুতই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে হয়ে যাওয়ায় সেযাত্রায় অমরত্বের ফানুষ আর বেশি আকাশে উড়তে পারেনি। কিন্তু বিজ্ঞান যতই এগিয়েছে ততই যেন আশা বাড়তে শুরু করেছে। এইবার, এইবার হয়তো হাতে আসবে অমরত্বের বীজমন্ত্র।

পর্দায় বারবার ফিরে এসেছে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানব

[আরও পড়ুন: কাশ্মীরে ফের জঙ্গিদের নিশানায় পরিযায়ী শ্রমিক, পুলওয়ামায় গুলিবিদ্ধ বাঙালি যুবক]

সারা বিশ্বের পুরাণ, মহাকাব্যে অমরত্বের ছড়াছড়ি। ‘মহাভারত’-এ রয়েছে চিরঞ্জীবীদের কথা। যাঁদের অন্যতম অশ্বত্থামা। কপালের মণি অর্জুনের হাতে সঁপে দিতে হলেও মৃত্যু স্পর্শ করেনি একাদশ রুদ্রের অন্যতম এই যোদ্ধাকে। কৃষ্ণের অভিশাপে তিনি অবশ্য কারও সংস্পর্শে আসতে পারবেন না। কিন্তু বেঁচে থাকবেন।

সমুদ্রের পেট থেকে উঠে আসা অমৃতের কথা আগেই বলেছি। সমুদ্রমন্থনে চোদ্দ প্রকারের রত্নও উঠে এসেছিল। উঠে এসেছিল আরও কত রকমের সম্পদও। তবু সেসব নিয়ে নয়, দেবতা ও অসুরদের মধ্যে প্রচণ্ড লড়াই লেগে গিয়েছিল অমৃতের ভাণ্ডর জন্যই। শেষ পর্যন্ত বিষ্ণু মোহিনী রূপে কীভাবে দেবতাদের জন্য অমৃত নিয়ে এসেছিলেন সে কাহিনি সকলেরই জানা। এবং লুকিয়ে সেই অমৃত পান করতে গিয়ে রাহু ও কেতু কেমন ফ্যাসাদে পড়েছিল সেই আখ্যানও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে রয়েছে। এই সবই যে অমর হওয়ার জন্য।

অশ্বত্থামা

বাইবেলে রয়েছে লিলিথের কথা। হ্য়াঁ, লিলিথ হল সেই সাপ যে ছিল আদমের প্রথমপক্ষের স্ত্রী। পরে ইভের সঙ্গে আদমের সম্পর্ক হলে প্রতিশোধ নিতে নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার প্রলোভন দেখিয়েছিল। প্রচলিত মিথ অনুযায়ী, লিলিথ আজও রয়ে গিয়েছে এই পৃথিবীতেই। ছায়ামানবী হয়ে মাঝে মাঝে নিঃসঙ্গ মানুষের সামনে সে ভেসে ওঠে আচমকাই। এও যে ধরনের অমরত্বই, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

এমন উদাহরণ অসংখ্য, অজস্র। কিন্তু এ সবই তো আকাঙ্ক্ষার কথা। বিজ্ঞানের হাত ধরে আধুনিকতায় প্রবেশ করার পর ধীরে ধীরে যখন একের পর এক ভয়ংকর অসুখ ও শারীরিক বিপর্যয়কে ঠেকাতে শুরু করল মানুষ, তখন থেকেই সেই আকাঙ্ক্ষার পালে নতুন বাতাস লেগেছে। কিন্তু বিজ্ঞান, আরও বিশেষ করে বললে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভাবনীয় সাফল্যের পরও অমরত্বের স্বপ্ন অধরাই থেকে গিয়েছে।

সর্বোচ্চ কত বছর বাঁচতে পারে মানুষ? গত বছর ‘নেচার কমিউনিকেশনস’ জার্নালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে গাণিতিক মডেলিং পদ্ধতির সাহায্যে মানুষের সর্বোচ্চ আয়ু (Lifetime) কত হতে পারে তা নির্ণয় করেছিলেন গবেষকরা। আর সেই হিসেব বলছে, ১২০ থেকে ১৫০ বছরের বেশি আয়ু পাওয়া সম্ভব নয় মানুষের। কেননা ওই বয়সের পর অসুস্থতা ও ক্ষত সারিয়ে ওঠার মতো ক্ষমতা আর থাকে না মানব শরীরের। ফলে মৃত্যুকে এড়ানো অসম্ভব হয়ে যায়। ওই গবেষণাপত্রটির অন্যতম লেখক অধ্যাপক জুডিথ ক্যামপিসি সেই সময় জানিয়ে দিয়েছিলেন, ”অমরত্ব একটা অসম্ভব আইডিয়া। একটা বিষয় নিশ্চিত। সকলকেই একদিন না একদিন মরতে হবে।’’

কিন্তু মানুষ কিংবা জীবজগতের সকলের ক্ষেত্রে যে নিয়ম খাটে তা টারিটোপসিস ডোরনিদের ক্ষেত্রে খাটে না কেন? ‘হযবরল’র উধো বলেছিল, ‘চল্লিশ বছর হলেই আমরা বয়স ঘুরিয়ে দিই। তখন আর একচল্লিশ বেয়াল্লিশ হয় না— উনচল্লিশ, আটত্রিশ, সাঁইত্রিশ করে বয়েস নামতে থাকে।’ কোনওদিন বুড়ো না হওয়ার এই নিদানই ওই জেলিফিশদের আসল অস্ত্র। কোনও ভাবে মৃত্যুর আশঙ্কা তৈরি হলেই এরা বার্ধক্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উলটো রাস্তায় হাঁটে। বয়স কমিয়ে ফেলে এক বিশেষ দশাপ্রাপ্ত হয়ে। অর্থাৎ দুর্ঘটনার মুখোমুখি না হলে শারীরিক অসুস্থতায় মৃত্যুর কোনও সম্ভাবনাই নেই।

অমরত্বের স্বপ্নের দিকে আজও হেঁটে চলেছে মানুষ

এতদিন এই জেলিফিশদের জীবন মানুষকে বিস্মিত করত। কিন্তু এই রহস্যের কুলকিনারা করা যায়নি। এবার স্প্যানিশ গবেষকরা টারিটোপসিস ডোরনির ‘বোন’ টারিটোপসিস রুব্রার জিনগুলিও খতিয়ে দেখে বিষয়টি বিস্তারিত বুঝতে চেয়েছেন। টারিটোপসিস রুব্রা আবার যৌন মিলনের পরে বয়স কমানো ও বার্ধক্য এড়ানোর ক্ষমতা হারায়। বিজ্ঞানীরা জেনেছেন, টারিটোপসিস ডোরনির জিনোমে থাকা টেলোমের মানুষের মতো বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছোট হয়ে যায় না। এর মধ্যেই কি লুকিয়ে রয়েছে আসল রহস্য? আপাতত সেটাই বোঝার চেষ্টা করছেন গবেষকরা।

তবে এই গবেষণাপত্রের অন্যতম লেখক কার্লোস লোপেজ-ওটিন জানাচ্ছেন, এই গবেষণা সেই অর্থে অমরত্বের কৌশলের খোঁজ করার জন্য নয়। বরং সেলুলার প্লাস্টিসিটির (মিউটেশন ছাড়াই কোষের পালটে যাওয়ার যে ক্ষমতা ) বিষয়টি খতিয়ে দেখা, যার মধ্যে রয়েছে সময়ের পিছনদিকে যাত্রা করার চাবিকাঠি। এটিকে বুঝতে পারলে অসংখ্য ভয়াবহ অসুখকে হারিয়ে জীবনকে দীর্ঘায়িত করা সম্ভব হবে। তবে সরাসরি অমরত্বের সঙ্গে এর যোগ তিনি যতই অস্বীকার করুন না কেন, জিনোমকে বুঝতে পারা আগামিদিনে যে অমরত্বের অসম্ভব গন্তব্যে মানুষকে পৌঁছে দেবে না, তা কে বলতে পারে?

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement