shono
Advertisement

আর কবিতা প্রকাশ করবেন না জয় গোস্বামী! এ কেমন ‘আত্মপরীক্ষা’?

বইমেলার আগে কবির সিদ্ধান্তে মন খারাপ পাঠকের।
Posted: 09:08 PM Jan 09, 2024Updated: 10:40 PM Jan 09, 2024

কিশোর ঘোষ: শিল্পীর নৈতিকতা আত্ম-সন্দেহে! মনে করালেন জয় গোস্বামী (Joy Goswami)। সম্প্রতি কবি জানিয়েছেন, ‘আমার ৫০ বছর কবিতাপ্রকাশের পূর্তি আমি আমার রচনা প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েই উদযাপন করতে চাই।’ এই সংবাদে মন খারাপ পাঠকের। তবে কিনা আত্ম-সন্দেহের প্রশ্নে সাহিত্য পাঠকের অবশ্যম্ভাবী দুজনের কথা মনে পড়বে। একজন ফ্রাঞ্জ কাফকা। যাঁর সাহিত্যসৃষ্টির সামান্য অংশই জীবদ্দশায় প্রকাশিত। নিজের প্রতি ঘোর সংশয়ে মোট কাজের ৯০ শতাংশই পুড়িয়ে ফেলেন। বাকি ১০ শতাংশের একটি অংশ হারিয়ে গিয়েছিল বা অপ্রকাশিতই ছিল। এমনকী কাফকার নিজের প্রতি নির্মমতাই ‘উইলে’র মতো বৈষয়িক কাজকে জগৎখ্যাত করেছিল। ওই উইলে পরাবাস্তববাদের সম্রাট ঘনিষ্ঠ বন্ধু ম্যাক্স ব্রডকে নির্দেশ দেন, তাঁর অসমাপ্ত কাজগুলো যেন ধ্বংস করা হয়। প্রশ্ন হল, সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি হঠাৎ প্রকাশ কিংবা ‘আত্মপ্রকাশ’ থেকে সরে যাচ্ছেন কেন? এ কেমন উদযাপন?

Advertisement

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘জয় গোস্বামীর কবিতা প্রকাশের ৫০ বছর’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা। কলেজ স্ট্রিটের বই বিপণীগুলিতে যা বিনামূল্যে বিলি করা হচ্ছে। জয়ের চমকে দেওয়া সিদ্ধান্তের কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে ওই পুস্তিকার দীর্ঘ লেখায়। উল্লেখ্য, ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ক্রিসমাস ও শীতের সনেটগুচ্ছ’। সেই হিসেবে গ্রন্থপ্রকাশের ৪৮ বছর হল। তবে কিনা কবিতা প্রকাশের (পত্রপত্রিকায়) ৫০ বছরের উল্লেখ করা হয়েছে এখানে। অন্যদিকে ১৯৫৪ সালে জন্ম জয়ের। অর্থাৎ ২০২৪ সালে সত্তর বছর বয়স হবে কবির। সংখ্যাতত্ত্বের এই বিচার অবশ্য তুচ্ছ। বরং কবির বক্তব্যে ফেরা যাক।

 

[আরও পড়ুন: যিনি স্বপন কুমার, তিনিই শ্রীভৃগু! গোয়েন্দা গল্পের মতোই রোমাঞ্চকর খোদ লেখকের জীবনও]

কৃশ পুস্তিকায় জয় জানিয়েছেন, “যেসব সম্পাদক আমার লেখা সম্মান দিয়ে এত বছর প্রকাশ করে এসেছেন তাঁদের কাছে আমার আভূমি-নত কৃতজ্ঞতা অর্পণ করি। পাশাপাশি আমার কাছে আর লেখা চেয়ে চিঠি না দেওয়ার অথবা ফোন না করার জন্যেও মিনতি জানাই। তাঁদের ‘না’ বলতে আমার দুঃখ হবে অথচ ‘না’ তো বলতেই হবে আমার আত্মপরীক্ষার জন্য।’ এই ‘আত্মপরীক্ষা’ ঠিক কেমন, সেই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন।

জয় লিখেছেন, “… একটি কবিতার পিছনে সর্বোচ্চ পরিশ্রম প্রয়োগ করার সময় লেখাটি কবে ছাপা হয়ে বেরোবে, এই বাসনাটিকে বিচ্ছিন্ন করা। যে-কোনো বাসনার মধ্যেই একরকম উত্তেজনা থাকে। লেখার উত্তেজনাটি জাগ্রত রইল। ছাপার বাসনা তথা উত্তেজনা নির্বাপিত হল সম্পূর্ণ। তা কি সম্ভব? আমার পক্ষে? এই বয়সেও যদি তা সম্ভব না হয়, তবে তা কবে হবে?” আরও লিখেছেন, “এই পথটিই আমার সামনে পড়ে রয়েছে একমাত্র পথ হিসেবে। নিজের সম্পর্কে মমত্ব বর্জন করার এই এক উপায়। এ কেবল এক আত্মপরীক্ষা চালানো। এক আধ্যাত্মিক অনুশীলন।…”

 

[আরও পড়ুন: সিনেমার পর্দায় পদ্মশ্রী ধনীরাম টোটোর উপন্যাস, তবু কেন মন ভালো নেই লেখকের?]

বলা বাহুল্য, নিজেকে কঠিন পরীক্ষার মুখে দাঁড় করিয়েছেন জয়। শিল্পের ঐশ্বরিক ‘সহজতা’ এবং শিল্পীর ‘জটিল’ অহংকারের দ্বন্দ্বকে নতুন করে মনে করাচ্ছেন তিনি। আমাদের মনে পড়ছে, চর্যা পদকারদের কথা, অজন্তার গুহাচিত্রকরদের কথাও। যে সকল শিল্পীদের কাছে কাব্যচর্চা ছিল ঈশ্বরসাধনা। আত্মবিসর্জন বা সমর্পণই ছিল মোক্ষ। একই কাব্যদর্শনের হুঁশিয়ারি দেয় রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’ কবিতাটি। অনন্তের নৌকায় শিল্পের ঠাঁই হয়, স্থান পান না শিল্পী! কাফকার মতো আরেক ‘আধুনিকে’র কথাও মনে পড়ে আমাদের। যাঁর গুপ্তধনে ভরা ট্রাঙ্ক বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। জীবদ্দশায় মাত্র ১৫৬টি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল জীবনানন্দ দাশের। ইচ্ছায় নয়, অনিচ্ছার আত্মপরীক্ষার মধ্যে পড়েছিলেন ‘সাতটি তারার তিমির’-এর কবি। সেই পরীক্ষা আজও দিতে হয় বহু কবিকে। অপরপক্ষে প্রতিষ্ঠানের ভিতরে থাকায়, জনপ্রিয় কবি হয়ে ওঠায় হাত খুলে লিখেছেন ও প্রকাশ করেছেন জয়। বাণিজ্যিক পত্রিকা, প্রকাশনার চাপও কি ছিল না? সেই প্রেক্ষিতে ‘বানপ্রস্থে’ এই সিদ্ধান্ত স্বাভাবিক এবং শ্রদ্ধা জাগানোও বটে।

যদিও কলকাতা বইমেলার আগে এমন সংবাদে মন খারাপ জয় গোস্বামী অগুন্তি পাঠকের। তথাপি বাংলা কবিতার নিষ্ঠাবান পাঠক নিশ্চয়ই চাইবেন, কবির এই ‘আত্মপরীক্ষা’, ‘নিজের সম্পর্কে মমত্ব বর্জন’, কবিতার প্রতি নিষ্ঠা তথা ‘আধ্যাত্মিক অনুশীলন’ সফল হোক। উপনিষদ বলে, কবি হলেন ঈশ্বরের মুখপাত্র। তাঁকে এমন গভীর সিদ্ধান্তেই তো মানায়।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement