অংশুপ্রতিম পাল, খড়গপুর: একফালি গ্ৰাম্য রাস্তাটির একেবারে শেষ প্রান্ত। এখানেই রাস্তার দুধারে দুজনের বাড়ি। একজন হলেন কুশধ্বজ কর। অপরজন মানস বাগ। দুজনেই ফুলচাষি। দুজনেই লক্ষ্মীপুজোর আগের রাত শুক্রবার দুটি বাইকে ফুলের বস্তা বোঝাই করে বেরিয়ে পড়েছিলেন। দুজনের পরিবারেই স্ত্রী সন্তান রয়েছে। বাবা যখন মাঝরাতে দুটো পয়সা উপার্জনের জন্য বেরিয়ে গিয়েছিলেন তখন গভীর ঘুমে ছিল মানসের দুই মেয়ে সুপর্ণা বাগ ও সুদেষ্ণা বাগ। একজন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। অপরজন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। একইভাবে কুশধ্বজ যখন সেই গভীর রাতে বেরিয়ে পড়েছিলেন ফুলের সম্ভার নিয়ে তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল তাঁর ডেবরা কলেজের কলা বিভাগের প্রথম বর্ষে পড়ুয়া মেয়ে মৌসুমী কর ও অষ্টম শ্রেণির পড়ুয়া মেয়ে মৌমিতা কর। দুই পরিবারের সন্তানদের কাছে বাবাদের এই গভীর রাতে বেরিয়ে যাওয়া খুবই চেনা গল্প ছিল। কিন্তু তাঁরা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে নি বাবারা আর ফিরে আসবেন না। সিমেন্টের বস্তা বোঝাই একটি বেপরোয়া লরি যে তাদের বাবাদের প্রাণ কেড়ে নেবে সেটা তারা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। অথচ ঘটনার পর যখন সবকিছু জানতে পারল তখন সব শেষ। বাবা বলে ডাকার জন্য আর কেউ রইল না। কোজাগরী পূর্ণিমার চাঁদের আলো তখন তাদের কাছে অমাবস্যার নিকশ কালো অন্ধকার হয়ে প্রতিভাত হচ্ছে। খড়গপুর দুই নম্বর ব্লকের কালিয়াড়া (৫/২) গ্ৰাম পঞ্চায়েতের কৈগ্যাড়া গ্ৰামে এখন শোকের ছায়া। গ্ৰামের দুই সন্তানের এমন অকাল মৃত্যুতে সকলেই হতবাক।
[আরও পড়ুন: ‘আত্মপ্রচারমূলক ফলক সরাতে হবে’, বিশ্বভারতী ইস্যুতে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপ চাইলেন মমতা]
শোকাচ্ছন্ন। কেউ ভাবতেই পারছেন না এরকম একটি সর্বনাশ এই দুটি পরিবারের উপর আছড়ে পড়বে। গোটা গ্ৰামে ৫০টি পরিবারের বসবাস। এই দুজনের মৃত্যুর ঘটনা সকলকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। শনিবার একটি বাড়িতেও কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো হল না। এমনকি এইদিন দুপুরে বহু বাড়িতে হাঁড়ি পর্যন্ত চড়েনি। কথা বলার অবস্থায় নেই সদ্য স্বামীহারা দিপালী কর ও রানু বাগ। ছেলেকে হারিয়ে নির্বাক হয়ে গিয়েছেন মা লক্ষ্মীবালা বাগও। এর আগে স্বামী ও বড় ছেলেকে হারিয়েছেন। এবারে মেজ ছেলেকে হারালেন। শনিবার সকাল থেকেই গোটা গ্ৰামের মানুষ এই দুটি পরিবারকে ঘিরে রয়েছে।
এদিকে একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছেন চরখী গ্ৰামের ধুমকেতু পাতর। কথা বলার মত অবস্থায় নেই মা শীলা পাতর। একমাত্র ছেলের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার পর থেকেই অনবরত কেঁদে চলেছেন। ছেলের এরকম একটি মৃত্যুর খবর ধুমকেতুর মতো যখন শুক্রবার রাত তিনটা নাগাদ বাড়িতে আছড়ে পড়ল তখন একেবারেই হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন ধুমকেতু পাতর। শুক্রবার রাত দেড়টা নাগাদ ছেলের সাইকেলে নিজের হাতে ফুলের সম্ভার তুলে দিয়েছিলেন। তারপর যখন খবর পেয়ে বুড়ামালায় পৌঁছলেন তখন দেখেন সব শেষ। বাবা বলে ডাকার জন্য ছেলে আর নেই।
[আরও পড়ুন: ‘আমার নাম বলতে PA-কে চাপ দিচ্ছে’, ইডির বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ সুজিত বসুর]
এই গ্ৰামে মোট ৪৫টি পরিবারের বসবাস। ঘটনার পর থেকে গোটা গ্ৰামে শোকের পরিবেশ। সমস্ত প্রস্তুতি থাকলেও শনিবার কোনও বাড়িতেই লক্ষ্মী পুজো হয়নি। এদিকে অকালে বাবাকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেল বিরামচক গ্ৰামের সুমন দাস ও সুমনা দাস। নবম শ্রেণির ছাত্র সুমন ও চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী সুমনা দাস জানে না কী হবে তাদের ভবিষ্যৎ। অসুস্থ মা বুল্টি দাসের চিকিৎসা কীভাবে হবে, বাবা-ই তো ফুল চাষ ও দিনমজুরি করে সবকিছু করতেন। এই গ্ৰামে ১৪টি পরিবারের বসবাস রয়েছে। ঘএকইভাবে ষাঁড়পুর গ্ৰামে রবীন্দ্রনাথ ওরফে নান্টু দাসের মৃত্যু সব আনন্দ কেড়ে নিয়েছে গোটা গ্ৰাম থেকে। কোনও লক্ষ্মী পুজো হয়নি কোথাও। সবমিলিয়ে শুক্রবার রাতের পথ দুর্ঘটনায় মৃত পাঁচ ফুলচাষির মৃত্যুতে পাঁচ কিমি এলাকা জুড়ে চারটি গ্ৰামে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে।