বয়সকালে মুখগহ্বর অনেক অসুখের উৎস। শরীরের এই অঙ্গ অত্যন্ত স্পর্শকাতর। বয়সের ভারে নানাভাবে দুর্বল হয়। তাই বয়স্কদের মুখ, দাঁত, মাড়ির বিশেষ গুরুত্ব বুঝিয়ে পরিচর্যার সঠিক পথ দেখালেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জেরিয়াট্রিক স্পেশালিস্ট ডা. অরুণাংশু তালুকদার ও ডেনটিস্ট ডা. সোমা হালদার। লিখলেন জিনিয়া সরকার।
বয়স্ক মানুষ আর শিশু এই দু’জনের ক্ষেত্রেই কিন্তু শরীরের বিশেষ যত্ন দরকার। তবে বয়স্কদের ক্ষেত্রে কিছু জিনিস বাধ্যতামূলক। তেমনই একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে মুখগহ্বরের স্বাস্থ্যের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া। ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের তথ্য এদেশে প্রায় ৫০ শতাংশ ৬৫ ঊর্ধ্ব মানুষের দাঁত প্রায় থাকে না, নষ্ট হয়ে যায়। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভের তথ্য, ৫৫-৭৭ শতাংশ বয়স্করা পেরিওডন্টাইটিসে (মাড়িতে ইনফেকশন, দাঁত পড়ে যাওয়া) ভোগেন। আর ৪৫ শতাংশের প্রকাশ পায় ড্রাই মাউথের প্রবণতা, দাবি ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ ডেন্টাল রিসার্চের।
বর্তমানে সময়ের সঙ্গে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির কারণে বেড়েছে মানুষের গড় আয়ু। আজ সমাজের একটি বড় অংশ হলেন সিনিয়র সিটিজেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এই সিনিয়র সিটিজেনদের মধ্যে ৭০ শতাংশই মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য নিয়ে একেবারেই সচেতন নন। প্রচলিত ধারণা যে, বয়সের সঙ্গে তো দাঁত যাবেই। এখানেই ভুল করেন। চিকিৎসা সম্পর্কিত ভীতি বা অবহেলা আরও সমস্যার দিকে ঠেলে দেয়।
ওল্ড ম্যান! ‘মডিফায়েড স্টিলম্যান’
আসলে শারীরিক অক্ষমতার বশে আলাদা করে যত্ন নেওয়া আর হয়ে ওঠে না। কিন্তু এটা জানলে খুব অবাক হবেন যে মুখগহ্বরের যত্ন নেওয়া সম্ভব খুব বেসিক কিছু পদ্ধতি মানলে।
দু’বেলা এক্সট্রা সফট ব্রাশ দিয়ে খুব হাল্কা হাতে ‘মডিফায়েড স্টিলম্যান’ পদ্ধতিতে দিনে দু’বার ব্রাশ করুন। সাধারণত আমরা ব্লাশ ধরে উপর-নিচ করে দাঁত মাজতে থাকি। এটা না করে মাড়ি ও দাঁতের মাঝে ব্রাশকে ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ধরতে হবে ও মাড়ি থেকে বাইরের দিকে ব্রাশ করতে হবে। অর্থাৎ উপরের দাঁত হলে ব্রাশ উপর থেকে নিচে ও নিচের দাঁত হলে নিচ থেকে উপরে ব্রাশ করুন। এটাই ‘মডিফায়েড স্টিলম্যান’ পদ্ধতি। দাঁতের মাঝে কোনও গ্যাপ তৈরি হলে তা পরিষ্কার হবে ‘ইন্টার ডেন্টাল ব্রাশের’ মাধ্যমে।
রোজের যত্ন
দাঁতের ক্যাভিটি হোক বা মাড়ির সমস্যা, সব থেকে বড় কারণ ‘প্লাক’। তা দূর করতে ব্রাশ করার পাশাপাশি দরকার প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার ক্লোরহেক্সিডিন মাউথওয়াশের ব্যবহার।
বাজারে ভালো ব্র্যান্ডের যে কোনও ফ্লোরিডেটেড টুথপেস্ট ব্যবহার করুন। তবে সেনসিটিভ দাঁতের জন্য ডিসেনসিটাইজিং টুথপেস্ট একটানা অনেকদিন ব্যবহার করবেন না। ক্রমাগত
এই ডিসেনসিটাইজিং টুথপেস্ট ব্যবহার করে অনেকেই পরে মুখগহ্বরের জ্বালা বা আলসারের শিকার হন। তাই এটি ব্যবহারের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
নড়া দাঁত বা আলগা হয়ে যাওয়া ফলস দাঁত মুখে রাখবেন না। এতে দাঁত পরিষ্কার হয় না
ও প্লাক জমতে থাকে। দাঁতের নানা রোগ ছড়ায় ও হজমগত সমস্যাও হয়। যাঁরা ব্রাশ করতে অক্ষম তাঁদের জন্য ইলেকট্রিক ব্রাশ ভালো।
ডায়েটে ফাইবার ও প্রোটিন জাতীয় খাবার বেশি পরিমাণে রাখুন। যা আপনার দাঁত ও হজমশক্তি ভালো রাখে।
অসুখ যা দাঁতকে কাবু করে
ডায়াবেটিস দাঁতের জন্য সর্বাধিক ক্ষতিকর। মাড়ির অসুখ পেরিওডন্টাইটিসের সবথেকে বড় কারণ হল এটি। মাড়ি ফোলা, রক্ত ও পুঁজ জমা, দাঁত নড়ে পড়ে যাওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায়।
হার্টের অসুখে রোগীকে ব্লাডথিনার দেওয়া হয়। যার কারণে একবার মুখগহ্বরের কোথাও রক্ত পড়া শুরু হলে আর বন্ধ হতে চায় না। তাই হার্টের রোগীদের নিয়তি ডেন্টাল চেকআপ, স্কেলিং করা উচিত। দাঁত তোলার আগে নিত্য কী ওষুধ খান সেটা চিকিৎসকে জানান।
অন্যদিকে একাধিক গবেষণার তথ্য, একটি অবহেলিত ও অপরিষ্কার মুখগহ্বর বা দাঁত হার্ট ও ফুসফুসের রোগ কয়েক গুণ বাড়াতে পারে।
যাঁরা নিউরোসাইক্রিয়াটিক ওষুধ খাচ্ছেন তাঁদের মুখের লালারস বা স্যালাইভা অনেক কমে যায়। এমনিতে বয়স্কদের ড্রাই মাউথ এর প্রকোপ বেশি থাকে। এছাড়া স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের ব্যবহারে বয়স্কদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল হয় ও মাড়ীর সমস্যা বাড়ে। এর জন্য দাঁতের গোড়ার (রুট কেরিস) ক্যাভিটি হয়, যার চিকিৎসা করা খুবই কঠিন। দাঁতটি ভঙ্গুর হয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে স্যালিভা সাপ্লিমেট নেওয়া ও নিয়মিত দাঁতের চেকআপ, ব্রাশিং খুব জরুরি।
আর একটি রোগে প্রবীণরা খুব ভোগেন সেটি হল ‘ক্যান্ডিডিয়াসিস’ বা ফাংগাল ইনফেকশন। এটি হলে জিভে বা মুখগহ্বরের অন্য যেকোনও স্থানে সাদা কোটিং হয় ও জ্বালাভাব হয়। যা সাধারণত শারীরিক দুর্বলতা ও মুখগহ্বরের অপরিচ্ছন্নতার সম্মিলিত কারণে হয়।
বয়সকালে সতর্ক না হলে ক্যানসারের ঝুঁকি
যে সব প্রবীণ সিগারেট, খৈনি, গুটখা খান, তাঁদের এই রোগের সম্ভাবনা সর্বাধিক। বিশেষত বয়সের সঙ্গে ক্যানসারের সম্ভাবনা অনেক বেশি বেড়ে যায়। আর প্রথম স্টেজে ক্যানসারে কোনও ব্যথা থাকে না। ফলে অনেক দেরি করে ধরা পড়ে ও অসুখ ছড়িয়ে যায়। তাই প্রবীণদের প্রতি বছর অন্তত একবার ক্যানসার স্ক্রিনিং প্রয়োজন।
এ রাজ্যে সব সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে এই স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা আছে। এখানে হার্টের রোগী বা বিভিন্ন শারীরিক সমস্যাযুক্ত রোগীদের ‘মাল্টিডিসিপ্লিনারি অ্যাপ্রোচ’-এর মাধ্যমে যে কোন দাঁতের সার্জারি বিনামূল্যে করা হয়। এতরকম ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও শুধু সচেতনতার অভাবে বয়সকালে দাঁতের অসুখের প্রবণতা বাড়ে।
মুখের প্রভাব শরীর জুড়ে
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন অঙ্গেরই কর্মক্ষমতা কমে যায়। তার মধ্যে মুখগহ্বরও রয়েছে। দাঁত বা মাড়ির নানা সমস্যা ছাড়াও মুখের অভ্যন্তরে নানা ক্ষতি হয়। যেমন লালাগ্রন্থি দুর্বল হতে থাকে, মুখ-জিভ শুকিয়ে যাওয়ার সমস্যা বাড়তে থাকে, মুখের পেশি দুর্বল হয় ফলে কিছু চিবিয়ে খেতে অসুবিধা শুরু হয়। ধীরে ধীরে জিভের স্বাদগ্রন্থির কর্মক্ষমতাও কমতে থাকে। এগুলি বয়স্কদের অন্যতম মুখগহ্বরের অসুখ। তাই বয়স্করা শক্ত খাবার খেতে চান না, পুষ্টির অভাব দেখা দেয়। বয়স্কদের মধ্যে অপুষ্টিজনিত সমস্যা তাই এত বেশি। আর এই পুষ্টির অভাব থেকেই শরীরে অন্যান্য সমস্যাও প্রকাশ পায়।
বয়সকালে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে, শরীরে নানা ধরনের সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে। তাই মুখগহ্বরের বিশেষ যত্ন নিন, শক্ত খাবার চিবিয়ে খাওয়ার অভ্যাস রাখা জরুরি। বিভিন্ন স্বাদের জিনিস খেলে উপকার। বিশেষত ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার বা টকজাতীয় খাবার মুখের জন্য ভালো।