অবসরের জন্য প্রস্তুত থাকতে গেলে সেই জীবনের সম্ভাব্য মাসিক খরচ সম্পর্কেও একটি সম্যক ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়। কারণ সেই বুঝে যদি একটি বাজেট তৈরি করে রাখা যায়, তাহলে পরবর্তীতে মাথাব্যথা থাকবে না। পড়ুন নীলাঞ্জন দে-র এই কলমে
গত সপ্তাহে প্রকাশিত সঞ্চয়-এর পাতায় রিটায়ারমেন্ট ফান্ড সংক্রান্ত লেখা পড়ে অনেকেই জানতে চেয়েছেন কীভাবে অবসরকালে খরচ তথা অন্যান্য প্রয়োজনীয় দিকগুলির উপর নজর রাখা যায়। খরচের রাশ টানা সোজা নয়, সে তো সকলেই জানে। তবে সামান্যভাবে প্রস্তুতি নেওয়া বোধহয় তেমন দুঃসাধ্য নয়। এক্ষেত্রে প্রাথমিক কর্তব্যগুলির মধ্যে পড়ে বাজেট তৈরি। এখানে রইল তারই আলোচনা।
প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে বাজেট একটি ‘এস্টিমেট’ মাত্র। স্বাভাবিকভাবেই ঠিক কখন, কত বছর বয়সে অবসর নিচ্ছেন, তার উপর অনেক কিছুই নির্ভর করবে। ধরুন, পঞ্চাশ বছরে যদি করেন, তাহলে এক রকম হিসাব, আবার আরও বেশি বয়সে যদি করেন, তাহলে অন্য রকম হবে। আজকাল নানা কারণে ‘আর্লি রিটায়ারমেন্ট’-এর প্রবণতা দেখতে পাই, কাজেই স্বাভাবিক অবসর কালের আগেই কর্মজীবনের ইতি টানার ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। ঠিকভাবে প্রস্তুতি নিলে পরে বেশি অসুবিধায় পড়তে নাও হতে পারে।
প্রশ্ন উঠবেই, কোন ধরনের খরচ, অবসরজীবনে বেশি প্রাধান্য পাবে।
রিটায়ারমেন্ট বাজেট কিভাবে বাড়ে-কমে, তাও জেনে নেওয়া জরুরি। সাধারণভাবে বললে, তিনটি প্রধান কারণ নিয়ে সাবধানতা দরকার–
এক, অর্থনৈতিক ট্রেন্ড, যেগুলির জন্য মুদ্রাস্ফীতির হার পরিবর্তিত হয়ে যায়।
দুই, ইন্টারেস্ট রেট এবং তার অদলবদল। এক্ষেত্রে যদি আপনার পোর্টফোলিও ডেট-ভিত্তিক হয়ে থাকে, তাহলে অনেক রকম বিপদের আশঙ্কা থাকে।
তিন, অ্যাসেট প্রাইসের পরিবর্তন – অর্থাৎ, স্টক মার্কেটে (এখানে ধরে নিচ্ছি অন্তত কিছু টাকা আপনি স্টকে রেখেছেন) উচু-নিচু হওয়ার ফলে, আপনার ভ্যালুয়েশন কিভাবে বদলাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে অবসরকালে আপনাকে কয়েকটি বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। এই পয়েন্টগুলি লক্ষ্য করুন। বলে রাখি, যদি হঠাৎ-অবসর হয়ে থাকে, তাহলে এগুলি হয়তো আরও বেশি প্রযোজ্য হবে –
১. আপনার বাড়ি বা মূল বাসস্থানের উপর কোন মর্টগেজ আছে কি না। থাকলে আরও কত বছরের জন্য।
২. আপনার স্বাস্থ্য বিমা কি যথেষ্ট পরিমাণে আছে? নিশ্চয় আপনি বিমার জন্য প্রিমিয়াম দেওয়া বন্ধ করতে চাইবেন না।
৩. আপনার জন্য খরচ কমানোর কোনও পন্থা আছে কি? তা কীভাবে করতে পারবেন, ভেবে নিন। নিছক সিনেমা-থিয়েটার দেখা বন্ধ করার কথাই কেবল বলছি না।
৪. এও মনে রাখুন, স্বাস্থ্য খাতে খরচ আপনার জন্য বাড়বে বই কমবে না। ওষুধ-পত্র বা সামগ্রিকভাবে চিকিৎসার খরচ তো কীভাবে বাড়ছে, তা সবাই জানে। আপনি কোনওভাবেই ব্যতিক্রমী নন।
৫. যদি কোনও অ্যান্যুইটি কিনে থাকেন, তাহলে কিছু সুবিধা পাবেন। ‘সঞ্চয়’ আগে এ ব্যাপারে আলোচনা করেছে। আপনি যদি অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সী হন, তাহলে অ্যানুইটির উপযোগিতা বিশেষভাবে জেনে রাখুন।
রিটায়ারমেন্ট বাজেট এই সমস্ত পয়েন্টগুলির ভিত্তিতে গঠিত হতে পারে –
খরচ
১। খাদ্য, জ্বালানি, পেট্রল সমেত মাসিক সাংসারিক খরচ,
২। ভাতা, ট্যাক্স ইত্যাদি
৩। জীবন এবং স্বাস্থ্য বিমার প্রিমিয়াম
৪। ওষুধপত্র বা নিয়মিত চিকিৎসার খাতে খরচ
রোজগার
১। কর্মজীবনের কারণে পেনশন, সরকারি বা বেসরকারি
২। অ্যানুইটি, সুদ ইত্যাদি
৩। নিজস্ব পোর্টফোলিও থেকে রোজগার – যথা, সিস্টেম্যাটিক উইথড্রয়াল প্ল্যান দিয়ে যদি নির্দিষ্ট পরিমাণে টাকা প্রতি মাসে তোলেন।
বিঃ দ্রঃ যদি খরচের বহর না মেটাতে পারেন, প্রদত্ত সারণিতে দেওয়া রোজগারের পন্থাগুলি থেকে, তাহলে অচিরেই অসুবিধায় পড়বেন, বলাই বাহুল্য। তাই ইনভেস্টমেন্ট ইনকাম যাতে সুষ্ঠুভাবে থাকে তার জন্য সময় নষ্ট না করে আজ থেকেই পরিকল্পনা করুন।
যদি সম্ভব হয়, প্রথম দু-তিন বছর আপনি নিজের পোর্টফোলিওর উপর ৭-৮ শতাংশের বেশি নির্ভর করবেন না। মানে, ইনভেস্টমেন্ট ভেঙে সংসার চালানো থেকে যতটা পারেন বিরত থাকুন। পরের বছরগুলি থেকে ইনফ্লেশনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে আপনাকে ভাঙিয়ে আনতে হবে।
রিটায়ারমেন্টের আর এক প্রবল তাগিদ হল খরচ কমিয়ে চলার প্রয়োজনীয়তা। ‘সঞ্চয়’-এর পাঠককে আমরা জানিয়ে দিতে চাই, খরচ কমানো এ যুগে খুবই শক্ত, কারণ এর জন্য বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। অল্প বয়স থেকে ইনভেস্টমেন্টের কোনও বিকল্প নেই – পরে ত্যাগ স্বীকার যাতে বেশি কষ্টদায়ক না হয় তার জন্য আগেই ব্যবস্থা নিন।
(লেখক লগ্নি বিশেষজ্ঞ)