ঠিক এক বছর আগের ওমিক্রন স্মৃতি উসকে দিয়ে দরজায় কড়া নাড়ছে করোনার (Coronavirus) নয়া প্রজাতি বিএফ.৭। নিউ ইয়ার সেলিব্রেশনে মেতে ওঠার আগে জেনে নিন কতটা সংক্রামক এই ভাইরাস? প্রাণঘাতীই বা কতটা? বিশ্লেষণে ডা. অভিজিৎ চৌধুরী, ডা. দীপ্যমান গঙ্গোপাধ্যায় ও ডা. গোপালকৃষ্ণ ঢালি।
এক ঝাপটায় ১৮ জন কাত! এবং পাটিগণিতের অঙ্ক মেনে সেই ১৮ জনের একজনের থেকে আরও ১৮ জন পজিটিভ। এইভাবে সংক্রমণ ছড়ায় সার্স কোভ-২’র নয়া অবতার বিএ.৭। গোটা বিশ্ব থরহরি কম্প। ওমিক্রনের তুতোভাই বিএফ.৫.২.১.৭ সম্পর্কে এমনটাই এখনও পর্যন্ত জানতে পেরেছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ভরসার কথা একটাই, সংক্রমণে অতীতের সব রেকর্ড ভাঙলেও মৃত্যুর হার কম। এই ভাইরাসের এখনও কোনও নমেনক্লেচার হয়নি। গোত্র মিলেছে কিন্তু নামকরণ হয়নি।
তিন বছর আগে করোনা গোটা বিশ্বজুড়ে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। ভাইরাসের মারণ কামড়ে রোজ শত শত সহ-নাগরিকের শবদেহ দেখে বাকরুদ্ধ অবস্থা। তখন আশার আলো দেখিয়েছিল ভ্যাকসিন। নতুন নাম আচরণবিধির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল মাস্ক আর সামাজিক দূরত্বের। অজানা শত্রুর থেকে জীবন বাঁচাতে দেশজুড়ে করোনা ভাইরাসের জিন বিশ্লেষণ (জিনোম সিকোয়েন্সিং) শুরু হয়।
যার জেরে একের পর এক করোনার নতুন প্রজাতি ও উপ প্রজাতির আলফা, বিটা, ডেল্টার মতো নতুন জিনের সন্ধান মিলেছিল। কিন্তু ঘটনা হল গত দেড় বছরে আমাদের দেশে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের কেন্দ্রীয় অনুদান বন্ধ ছিল। ফলে করোনা ভাইরাসের চরিত্র বিশ্লেষণ এবং সেই অনুযায়ী ভ্যাকসিনের গুণগত মানের উন্নতি হয়নি। এখন প্রশ্ন একটাই, করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় সংক্রমণের মতো আবার কি বিএফ.৫.২.১.৭ অবতার পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে আছড়ে পড়বে? আবার সবাই অসুস্থ হবে?
যাদবপুরের কেন্দ্রীয় গবেষণা সংস্থার অন্যতম বিজ্ঞানী ডা. দীপ্যমান গঙ্গোপাধ্যায় বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। তাঁর কথায়, “গত দেড় বছরে অল্প বিস্তর সবার করোনা হয়েছিল। জীবন স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে। আমরা অনেকটাই স্বস্তিতে আছি। এমতাবস্থায় চিন, আমেরিকা বা আর কয়েকটি দেশের মতো ভারতেও আছড়ে পড়বে ওমিক্রনের নতুন সাব ভ্যারিয়েন্ট এমনটা বলা ঠিক নয়। কারণ আমাদের মধ্যে স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। তাই চিন বা মালয়েশিয়ার মতো দেশে যা চলছে তেমন অবস্থা ভারতে হওয়ার কোনও যুক্তি নেই। তবে মাস্ক ব্যবহার করতেই হবে।”
[আরও পড়ুন: ২ বছরে পাঁচ শতাংশ বেড়েছে ফুসফুসের ক্যানসার, জানাল কেন্দ্র, মারণ রোগ বাড়ছে কেন? ]
গবেষকের অভিমত, দেশে জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়েছে সরকারি অনুদান। ফলত আচমকা সংক্রমণ বাড়লে ফের জিনোম পরীক্ষা করা অনেকটাই চাপের। তাই এখন থেকেই টেস্ট ও ট্র্যাক শুরু করতে হবে। তবেই বোঝা যাবে সার্স কোভ-২-এর নতুন কোনও উপ প্রজাতি এসেছে কি না? অনুজপ্রতিম গবেষকের বক্তব্য থেকে একধাপ এগিয়ে ডা. অভিজিৎ চৌধুরীর প্রশ্ন, “এতদিন যে ক’টি ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে সেগুলোর গুণগত মানের উন্নয়ন হয়েছে কি না তা নিয়েও সংশয় আছে? মোদ্দা কথা, এতদিন যে ভ্যাকসিন পাওয়া যাচ্ছিল সেটা দিয়ে আদৌ কোনও কাজ হবে কি? কারণ, ভাইরাসের জিনের বদল হয়েছে। আরও শক্তিশালী ভাইরাস তৈরি হয়েছে। তাহলে ভ্যাকসিনকেও সেই অনুযায়ী উন্নত করা উচিত ছিল। তাহলে এখন দুশ্চিন্তা করতে হত না।”
চিন, জাপান এবং আফ্রিকার দেশগুলিতে যেভাবে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে তাতে ভারতে এই ভাইরাস কবে ভয়াবহ চেহারা নেবে? আইসিএমআর (ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ)-এর সহ অধিকর্তা গবেষক ডা. সমীরণ পণ্ডা হাসতে হাসতে বলেছেন, “নয়া অবতার তো জুলাইয়ে দেশে ঢুকেছে। তিনজন আক্রান্ত হয়ে দিব্যি সুস্থ হয়ে গেলেন। নতুন করে আর তো কোনও সংক্রমণের খবর নেই।”
কিন্তু শত্রু যখন কোভিড (COVID-19) তাই সব কৌশল তৈরি থাকতে হবে। কারণ, চিনে রোজ গড়ে ৩-৫ হাজার মৃত্যু হচ্ছে। আক্রান্ত লাগামছাড়া। দ্বিতীয়ত, কোন পথে ঢুকবে কেউ জানে না। রাজ্যের কোভিড প্রোটোকল কমিটির প্রধান ডা. গোপালকৃষ্ণ ঢালির কথায়, “বিদেশ ও কেন্দ্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সংক্রমণ ছড়ায়। আবার এমনটাও দেখা গিয়েছে যে, আক্রান্ত ব্যক্তি বুঝতেই পারল না তার শরীর বাসা বেঁধেছে বিএফ.৫.২.১.৭ ভাইরাস।
এমনও হয়েছে সংক্রমণের কয়েকদিনের মধ্যে দ্রুত অবস্থার অবনতি এবং রোগীকে সিসিইউ, আইসিইউ নিয়ে যেতে হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হচ্ছে। চিকিৎসকের কথায়, ভৌগোলিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে ভাইরাসের জিনের চরিত্র বদল হয়। অর্থাৎ চিন-জাপান বা আফ্রিকায় ওমিক্রনের বিএফ.৫.২.১.৭ এই সাব ভ্যারিয়েন্ট যতটা খতরনাক, ভারতে এমনটা নাও হতে পারে। তাই বছর শেষের উৎসবের সময় মাস্ক ব্যবহারে জোর দেওয়া হচ্ছে। গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে। জ্বর, শ্বাসকষ্ট বা নাক দিয়ে জল গড়ালেই হাসপাতালে যেতে হবে। আরটিপিসিআর পজিটিভ হলেই হাসপাতালে ভরতি করে জিন বিশ্লেষণ করতে হবে। সঙ্গে চলবে চিকিৎসা।