রমেন দাস: ‘কাল খেল মে হাম হো না হো, …পর হাম তুমহারে রহেঙ্গে সদা’। আসলে এ যেন এক গল্প! এক ‘জোকারে’র ভালো রাখার কাহিনি। এই গল্পে, যাঁর ঘরে রোজ নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তিনিই যেন বলে চলেছেন, ‘খারাপ ক্যানভাসেও, ভালো রাখার ছবি আঁকি আমি!’ কে তিনি?
সেলিম আহমেদ (Salim Ahmed) ওরফে সেলিম জোকারওয়ালা। বড়দিন (25th December) আসলেই যাঁর ব্যস্ততা থাকে তুঙ্গে। কলকাতার বেনফোর্ড লেনের গলি ঘুপচিতেই তিনি সাজিয়ে তোলেন ‘অন্য সান্তাক্লজ’দের (Santa Claus)। লাল জোব্বা, সাদা মোজা আর রঙিন ঝোলা নিয়ে যে সান্তারা ঘুরে বেড়ান কলকাতার গলি থেকে রাজপথ। তাঁদের নিয়েই আসলে কারবার এই সেলিমের। শহরের শীতলতম দিনে উৎসবের আবহে উষ্ণতা ছড়ান তিনিও।
রিপন স্ট্রিট থেকে ডানদিকে একটু এগোলেই, সংকীর্ণ গলি পেরিয়ে ৩ নং বেডফোর্ড লেন। এখানেই বসবাস সেলিম আহমেদের। পাঁচতারা হোটেল থেকে শুরু করে অভিজাত ক্লাব, বিয়ে-জন্মদিন, সর্বত্র তিনিই ‘সাপ্লাই’ দেন সান্তা-চ্যাপলিনদের। সার্কাস মঞ্চের জোকারদের সাজিয়ে দেন সেলিম। প্রত্যেক মুহূর্তে আনন্দের আতিশয্যে তিনিই যেন ছড়িয়ে দেন এক মুঠো আলো!
শীতের মরশুমে বড়দিনের (Christmas 2023) সময় যে ‘সান্তাওয়ালা’দের ঝোলা কাঁধে তিলোত্তমায় খুঁজে পাওয়া যায় বারবার, তাঁদের বেশিরভাগই সেলিমের দলের। লাল রঙের ভাঙা গেট পেরিয়ে সিঁড়ির কাছের দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরটাই এই সান্তাক্লজদের ডেরা।
মাদার মেরির (Mother Merry) সন্তানের জন্মদিনে উত্তর মেরুর অজানা কোনও বরফে মোড়া দেশ থেকে হাজির হন সান্তা বুড়ো! আদতে তিনি কী করেন, কেন আসেন, তাঁর অস্তিত্ব আছে কি না, তা-ও রূপকথার মতোই সত্যি! কিন্তু কেন তাঁদের সম্বল করেই এমন পেশা বাছলেন কলকাতার সেলিম জোকারওয়ালা (Joker) ?
সেলিম বলছেন, ”সত্যিই এটা আজব পেশা! ১৯৯২ সালের আগস্ট মাসের প্রথম দিন। বড়দিনের আগে লিন্ডসে স্ট্রিটের একটি দোকানে সাজানোর কিছু কাজ করছিলাম। অনেক কাজের পরে দোকানের মালিক বললেন, ‘সব ঠিকাছে কিন্তু কুছ মজাদার চাহিয়ে।’ রেগে গেলাম, চোখের কোণায় জল চলে এল। এত কাজের পরেও এমন কথা!” একটু থেমে ফের বলতে শুরু করলেন সেলিম আহমেদ। ”মাথা গরম হয়ে গেল। রাগের মাথায় বলে ফেললাম, মজা লাগলে জোকার নিয়ে আসুন!”
কিন্তু এই রাগই আশীর্বাদ হল সেলিম জোকারওয়ালার জীবনে। সেলিমের কথায় , ”এরপর ওই দোকানদার বললেন, ‘লে কে আইয়ে জোকার!’ তখনই মনে হয়েছিল জোকার সাজার ব্যবসা করলে কেমন হয়? ছুটতে ছুটতে বাড়ি-ভাইদের সঙ্গে কথা বললাম। এরপরে গেলাম দর্জির কাছে। জোকারের পোশাক বানিয়ে দিতে বললাম। এক মেক-আপ আর্টিস্টকেও গিয়ে বললাম, জোকারের পোশাক বানিয়ে দাও। ব্যাস্! পরের দিন জোকার সেজে সেই দোকানে গেলাম। আমাকে দেখে সকলে মজা পেলেন। রাতারাতি হয়ে গেলাম জোকার!” সেই থেকেই শুরু।
[আরও পড়ুন: বিজয় দিবস: শহিদ স্মরণে শক্তি প্রদর্শন সেনার, কলকাতার আকাশে খেল দেখাল বিমানবাহিনীও]
১৯৭০ এর রাজ কাপুর অভিনীত ‘মেরা নাম জোকার’ (Mera Naam Joker) সিনেমা তিনি দেখেছেন ৫০০ বার! একবার শাম্মি কাপুরের সঙ্গে নাকি মুখোমুখি সাক্ষাত হয়েছে সেলিমের। তাঁর কথায়, “একটা অনুষ্ঠানে শাম্মি কাপুরের সঙ্গে দেখা হয়, তিনি আমাকে বলেছিলেন রাজ কাপুরের পরে, বাস্তব জীবনে সেলিম জোকারওয়ালারাই আসল জোকার।”
আজ আর ভয় করে না সেলিমের। নিজে তো বটেই সমাজের বহু ‘বামুন’, বহু মানুষের রোজগারের পথও দেখিয়েছেন তিনি। নূর আলি, ফিরোজ আলিদের আয়ের জন্য তাঁর চেষ্টায় সর্বোচ্চ। কখনও চার্লি চ্যাপলিন, কখনও জোকার সাজিয়ে তাঁদেরও দেখিয়ে দিয়েছেন বাঁচার পথ। ওঁদের সংসারে খানিকটা সুখ এসেছে শীতের শুরুতে। দিকে দিকে খিলখিল করে হাসিয়ে তোলার কারিগর হিসাবে ঢুঁ মেরেছেন ওঁরা। থুরথুরে বুড়োর কাঁপা কাঁপা সাজানো গলা আর অন্ধকারের ছায়া মাখা হাসির মুখোশেই এক পৃথিবী সুখ গাঁথছেন ওঁরাও। যেন অজানা দেশের স্লেজ গাড়ির ওই লোকটার আদিপুরুষ হিসাবেই রয়ে গিয়েছেন এই সেলিমরা, থুড়ি জোকাররা!