কুণাল ঘোষ: মেসিদর্শন ঘিরে শনিবার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গণে যা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটল, তার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে চলে এসেছে। এর মধ্যে অন্তর্ঘাতমূলক চক্রান্তের আশঙ্কাও রয়েছে, যার সুতো দিল্লির একটি প্রভাবশালী অংশের হাতে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অসীম রায়ের নেতৃত্বে তদন্তকমিটি গড়ে দিয়েছেন। সেই তদন্ত শুরু হয়েছে।
কেন এবং কীভাবে এই ঘটনা ঘটল, এই প্রশ্নের জবাবে একদিকে যেমন বেসরকারি আয়োজকের চূড়ান্ত গাফিলতি কিংবা কিছু ছবি-লোভী হ্যাংলার দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ রয়েছে, পাশাপাশি গেরুয়া পতাকা হাতে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান তুলে যারা গুন্ডামি করল, সেই সূত্রে আরও বড় ষড়যন্ত্রের প্লট নিয়ে চর্চা চলছে।
কেন এলেন না শতদ্রু
অনুষ্ঠানের আগের দিন দুপুরে ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস যুবভারতীতে চার ঘণ্টা অপেক্ষা করেছিলেন আয়োজক শতদ্রু দত্তর জন্য। মেসিকে নিয়ে ঠিক কী হবে, খুঁটিনাটি পরিকল্পনা জানার ইচ্ছা ছিল তাঁর। এধনের বড় অনুষ্ঠান বা খেলা আগেও হয়েছে। বেসরকারি আয়োজকের থেকে চূড়ান্ত প্রস্তুতি জানার জন্য গিয়েছিলেন অরূপ। চার ঘণ্টা বসে ছিলেন। বারবার শতদ্রুকে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তিনি তখন যাননি। অন্যসূত্রে অরূপকে বলা হয়, সব ঠিক আছে। চিন্তার কিছু নেই। তখন বৈঠক হলে হয়তো মেসিদর্শনের ফাঁক থাকত না। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে নামানো হল মেসির জন্য, অথচ পুলিশকে সবিস্তার কর্মসূচি ঠিকসময়ে যথাযথভাবে জানানো হল না। এই অন্ধকারে রাখার প্রবণতা কেন?
দিল্লির সুতোর টান?
আশঙ্কা এবং চর্চা, শতদ্রুর উপর কি দিল্লির এক প্রভাবশালী অংশের চাপ ছিল? ভারতের অন্য জায়গায় সব মসৃণ হোক, কিন্তু ভোটের মুখে বাংলার ভাবমূর্তি নষ্ট করতে কলকাতায় বিশৃঙ্খলা করাতে হবে। প্লট: মেসিকে এমনভাবে ঘিরে ফেলতে হবে, যাতে দর্শকরা দেখতে না পেয়ে ক্ষিপ্ত হন। সেই ক্ষোভকে কাজে লাগাতে দর্শকাসনে ঢোকানো থাকবে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেওয়া ক্যাডারদের। ফুটবলপ্রেমীদের সঙ্গে মিশে এমনভাবে তাণ্ডব করতে হবে, যা বড় খবরে পরিণত হয়। বিজেপি ইস্যু করতে পারে। সেইমতোই আয়োজকরা কেন্দ্রীয় বাহিনী, নিজস্ব নিরাপত্তারক্ষী দিয়ে ঘিরে রাখা হয় মেসিকে। একেবারে মুখের সামনে রাখা হয় আলোকচিত্রীদের। সঙ্গে ছাড়া হয় মাত্রাতিরিক্ত প্রবেশপত্র। মেসিকে জিপে তুলে ঘোরানো এবং বড় স্ক্রিনে দেখানোর ব্যবস্থা আয়োজক করেননি। কই, হায়দরাবাদ বা মুম্বইতে তো মাঠে মেসিকে ঘিরে এত কেন্দ্রীয় বাহিনী বা আয়োজকদের নিরাপত্তাবাহিনী দেখা গেল না! রহস্য না? অঙ্ক কষেই এই পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, বলে একটি সূত্র। এরপর দর্শকরা ক্ষিপ্ত হন। তখন গ্যালারির কিছু পকেটে উত্তেজনা বাড়ায় আগাম ঢুকে থাকা কিছু যুবক। জনতার ক্ষোভের সুযোগে তারা পরের কাজটুকু সারে। সূত্রের খবর, যেহেতু বাংলায় সামনেই ভোট এবং তৃণমূল কার্যত অপ্রতিরোধ্য, তাই পরের পর চক্রান্ত ব্যর্থ হওয়ায় এবার মেসির ইভেন্ট টার্গেট করেছিল এই মহলটি। বেসরকারি আয়োজককে অপব্যবহার করে, চাপ দিয়ে এই ছক সাজানো হয়েছিল বলে অনুমান। এ বিষয়ে খোঁজখবর চলছে।
বিজেপির ছক স্পষ্ট
যেভাবে গেরুয়া পতাকা নিয়ে মাঠে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান হয়েছে, তা ফুটবল মাঠে হতে পারে না। যারা যে ভাষায় কথা বলে ভাংচুর করেছে বলে ফুটেজ, তারা ক্রীড়াপ্রেমী হতে পারে না। এরা একটা চক্রান্তের অংশীদার। প্লটের প্রথম পর্যায়ে জনতাকে উত্তেজিত করা গেলেই এদের কাজ শুরুর নির্দেশ ছিল। জনতার পদপিষ্ট হওয়া এড়াতে পুলিশ কড়া ব্যবস্থা তখন নেয়নি। সেই সুযোগে বিশ্বমানের স্টেডিয়ামটির ক্ষতি করে বাংলার বদনাম করে দিল এরা। তারপর এটা নিয়ে প্রচারে নামল। যে বিজেপি নেতা কল্যাণ চৌবের সভাপতিত্বে এআইএফএফের জমানায় বিশ্বফুটবলে ভারতের ক্রমাবনতি চলছে, এবার আইএসএল করতে পারছে না, তিনি এবং তাঁর দল এখন বড় বড় কথা বলছেন। বেঙ্গালুরুতে আইপিএলে পদপিষ্ট হয়ে প্রায় তিরিশ হতাহত, কুম্ভমেলায় আগুন ও পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুমিছিল, গুজরাততে পরপর সেতু ভেঙে পড়া; সারা ভারতের পরিস্থিতি ভুলে বিজেপি ও বিরোধীরা যুবভারতী নিয়ে প্রচারে ব্যস্ত। বস্তুত, এবার বাংলায় ভোট না থাকলে হয়তো সব মসৃণ হত। হায়দরাবাদে ভোট থাকলে সেখানে হয়তো চক্রান্তের জাল ছড়াত।
অন্তর্ঘাতে আরও কারা
এই বেসরকারি আয়োজক বা তার টিমের কাউকে ব্যবহার করে যদি এই চক্রান্ত হয়, তা হলে প্রশ্ন, এদের সঙ্গে গোপন আঁতঁাতে কে বা কারা আছে? পুলিশ-প্রশাসনের কোথাও কোনও সর্ষের মধ্যে ভূত আছে কি না। কোন এলাকা থেকে ‘জয় শ্রীরাম’ গ্রুপ ঢুকল? নজরদারির কী ব্যবস্থা ছিল? জাল কোথায় কোথায় ছড়ানো? ভোটের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিড়ম্বনায় ফেলতে কে বা কারা আগ্রহী, ছদ্মবেশী মুখ এবং মুখোশ কোথায় কী করছে, কোন নেটওয়ার্কে কাজ হচ্ছে, কোনও কোনও এজেন্সি অন্তর্ঘাতে সক্রিয় ছিল কি না, এই প্রশ্নগুলি স্বাভাবিকভাবে আসবেই।
ফাঁদে পা
মেসির দৃশ্যমানতা ঢেকে দর্শকদের তাতিয়ে দেওয়ার প্লট এবং ব্যবস্থা আগেই করা ছিল। বোকার মতো ফাঁদে পা দিল ছবি-লোভী কিছু মুখ। তারা এতটাই হ্যাংলামি করল যে, ক্ষোভের অভিমুখ আসল চক্রান্ত থেকে সরে গেল। সমালোচিত হল পরিচিত মুখেরা। অবশ্য সেই সমালোচনা তাদের প্রাপ্য। ক্রীড়ামন্ত্রী হিসাবে অরূপ বিশ্বাস ওখানে থাকতে পারেন। কিন্তু বাকিরা মেসির ভিড়ে ঘুরঘুর করছিলেন কেন? এঁদের জন্য চক্রান্তকারীদের ক্যামোফ্লেজের সুবিধা হয়ে গেল। যে অনুষ্ঠান মসৃণ হত, তাকে রাজনৈতিক প্রচারের হাতিয়ার অঙ্ক কষেই করে দিল বিরোধীরা।
তদন্ত চলছে
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে গঠিত কমিটি তদন্ত শুরু করেছে। কেন মেসিকে আলাদা করে ঘোরানো হল না, কাদের কতজন নিরাপত্তাকর্মী ঘিরে ছিলেন, বাকি কারা ছিল ও কেন ছিল, ‘গেরুয়া পতাকা’ ধারীরা কোন উদ্দেশ্যে তাণ্ডবে ঢুকল, আয়োজকের উপর বাইরের কারও কোনও চাপ ছিল কি না, জলের বোতল মাঠে কেন ঢুকল, হামলাকারী গ্রুপ কারা কোথা থেকে এল, এসব প্রশ্ন-সহ সব দিক খতিয়ে দেখছে কমিটি।
অকারণ মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণ
অকারণে মুখ্যমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করে বিজেপি ও বিরোধীরা বুঝিয়ে দিচ্ছে তাদের আসল উদ্দেশ্য কী। বাংলার গায়ে কাদা লাগিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে টার্গেট করে কুৎসিত আক্রমণ করছেন। অথচ এই আক্রমণ তাঁর প্রাপ্য নয়। কারণ, যে ঘটনা ঘটেছে, তার কোনও দায় মুখ্যমন্ত্রীর ছিল না। তিনি আমন্ত্রিত। তিনি যাচ্ছিলেন। তিনি যাওয়ার পথেই অঘটনের কথা শোনেন। মেসি বেরিয়ে গিয়েছেন। তাই তিনি মাঝপথে ফিরে যান। গোটা ঘটনা শুনে তিনি প্রবল বিচলিত ও ক্রুদ্ধ হন। সঙ্গে সঙ্গে যাকে যা বলার বলেন। দর্শকদের টাকা ফেরতের নির্দেশ দেন। প্রাক্তন বিচারপতি অসীম রায়ের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি করে দেন। পুলিশ বেসরকারি আয়োজককে গ্রেপ্তার করে।
যুবভারতীতে যা হয়েছে, তা মুখ্যমন্ত্রী যাওয়ার আগে
অনুষ্ঠান সরকারি ছিল না। বেসরকারি সংস্থা করেছে। তারা যা সহযোগিতা চেয়েছিল, সরকার দিয়েছে। ক্রীড়াদপ্তর, যুবভারতী কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ যেটুকু নজর রাখার রেখেছিল। এর মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে মুখ্যমন্ত্রী কী করবেন? তিনি যাওয়ার আগে আয়োজকদের ব্যর্থতায় মানুষ ক্ষিপ্ত। কিছু অবাঞ্ছিত হ্যাংলার ছবি ওঠানোর ভিড়ে মেসিকে দেখতে না পেয়ে গোলমাল তুঙ্গে। সুযোগ নিয়েছে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান তোলা কয়েকজন। লজ্জাজনক পরিস্থিতি হয়েছে।
কিন্তু অন্যের ভুলের জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে কুৎসার মুখে ফেলা হচ্ছে কেন? তিনি কী করেছেন? তাঁর দিক থেকে মেসিকে কলকাতায় আনার আবেদনে যা অনুমতি বা সহযোগিতা, তা তো করা হয়েছে। কিছু লোক আচমকা হ্যাংলামি করবে আর অনেক বড়কর্তা উপস্থিত থাকলেও তাঁরা সামলাতে পারবেন না, এটা মুখ্যমন্ত্রী ভাববেন কী করে? অতীতে অনেক বড় কর্মসূচি হয়েছে। এই মেসিই খেলে গিয়েছেন মসৃণভাবে। ফলে এখন একটা সুযোগ পেয়ে যাঁরা মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণ করছেন, তাঁরা ঠিক করছেন না। তা হলে কুম্ভমেলা, বেঙ্গালুরু, গুজরাত বা এধরনের ক্ষেত্রে সেখানকার মুখ্যমন্ত্রীরা ছাড় পাবেন কেন? পহেলগাঁওতে জঙ্গি হানার পর কেন ছাড় পান প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী? যুবভারতীর ঘটনা ঘটল, না ভোটের আগে অন্য কিছুতে না পেরে রিমোট কন্ট্রোলে ঘটানো হল, তা নিয়ে চর্চা চলছে।
